E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮

সিপিআই(এম) ঝাড়গ্রাম সম্মেলনের আহ্বান

পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং শাসকশ্রেণির আক্রমণ প্রতিরোধে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হবে

সন্দীপ দে


ঝাড়গ্রাম জেলা সম্মেলনে রক্ত পতাকা উত্তোলন করছেন প্রবীণ নেতা বিনয় পান্ডে।
উপস্থিত আছেন বিমান বসু, সূর্য মিশ্র, অমিয় পাত্র, তরুণ রায়, ডহরেশ্বর সেন, পুলিন বিহারী বাস্কে সহ প্রতিনিধিরা।

বর্তমান পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং শাসকশ্রেণিগুলির সমস্ত রকমের অপচেষ্টা প্রতিরোধে সক্ষম, মতাদর্শগত চেতনায় সমৃদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ, গণলাইনসম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে শেষ হয়েছে সিপিআই(এম)-র ঝাড়গ্রাম জেলা দ্বিতীয় সম্মেলন। ৬ এবং ৭ ফেব্রুয়ারি ঝাড়গ্রাম শহরে বলাকা সাংস্কৃতিক মঞ্চে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রাম শহরের নামকরণ করা হয়েছিল কমরেড ভরত হেমব্রম নগর এবং সম্মেলন মঞ্চ নামাঙ্কিত হয়েছিল কমরেড তপন সেন রায়ের নামে।

সম্মেলনের আহ্বান

এই সম্মেলন থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্তসুলভ ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেস দল ও সরকারকে প্রতিহত করে রাজ্যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করো। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের জনস্বার্থ-বিরোধী আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তো‍লো, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে রক্ষা করতে ও চরম দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমবেত করো।

এছাড়াও এই সম্মেলন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে তীব্র করা এবং ভারত সরকারের মার্কিনমুখী বিদেশনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নয়া উদার আর্থিক নীতির আক্রমণ থেকে জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে স্থানীয়, আশু ও আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলনকে তীব্র করার আহ্বান জানিয়েছে। এই সম্মেলন মতাদর্শে বলীয়ান, সংগ্রামে আগুয়ান, লক্ষ্যে অবিচল ইস্পাতদৃঢ় পার্টি গড়ার ডাক দিয়েছে।

নতুন নেতৃত্ব

সিপিআই(এম)-র ঝাড়গ্রাম জেলা সম্মেলন থেকে আগামীদিনে পার্টি পরিচালনার জন্য ৩২ জনের নতুন জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়েছে। জেলা কমিটির প্রথম বৈঠকে জেলা সম্পাদক হিসাবে সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত হয়েছেন প্রদীপ সরকার। এই কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য রয়েছেন তিন জন এবং মহিলা সদস্য রয়েছেন পাঁচ জন।

এই সম্মেলনে ১৪১ জন প্রতিনিধি এবং ৩৭ জন দর্শকসহ মোট ১৭৮ জন উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে শ্রমিক ১৩ জন, খেতমজুর ৪১ জন, গরিব কৃষক ৬৯ জন, মাঝারি কৃষক ২৬ জন, মধ্যবিত্ত ১৯ জন এবং ধনী কৃষক ছিলেন ২ জন। সবচেয়ে পুরনো পার্টি সদস্য এবং প্রবীণ প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ডহরেশ্বর সেন। তিনি ১৯৬৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। তাঁর বয়স ৮১ বছর।

সম্মেলনের সূচনা

৬ ফেব্রুয়ারি রক্তপতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ পার্টিনেতা বিনয় পাণ্ডে। তিনি ছাড়াও শহিদবেদিতে মাল্যদান করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু, রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র, রাজ্য কমিটির সদস্য তরুণ রায়, মধুজা সেনরায়, পার্টির প্রবীণ নেতা ডহরেশ্বর সেন, বিদায়ী জেলা সম্পাদক পুলিনবিহারী বাস্কে সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ এবং সম্মেলনের প্রতিনিধিরা।

দু’দিনের সম্মেলন পরিচালনা করেন প্রশান্ত দাস, হেনা সতপথি, উদ্ধব মাহাতো এবং দিবাকর হাঁসদাকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। শহিদ স্মরণে ও শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন প্রশান্ত দাস।

সম্মেলনের উদ্বোধন

পার্টির ঝাড়গ্রাম জেলা দ্বিতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করে রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেন, মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম এবং সংগঠন - এই চারটি ভিত্তির উপর পার্টি পরিচালিত হয়। আমাদের মতাদর্শ মার্কসবাদ।এই মতাদর্শ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক এবং বৈপ্লবিক। এই মতাদর্শ বিকাশমান - এ‍‌কে আয়ত্ত করতে হয় প্রয়োগের জন্য। আবার সংগঠন না থাকলে সংগ্রাম করা যায় না। তিনি বলেন, সমালোচনা-আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা উন্নততর সিদ্ধান্তে উপনীত হই। পার্টির ভালোর জন্যই সমালোচনা করা জরুরি। সমালোচনার অর্থ সংশোধন করা, আত্মসমালোচনার লক্ষ্য হলো নিজেকে সং‍‌শোধন করা। লক্ষ্য রাখতে হবে এর মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে পার্টির উন্নতি হচ্ছে কিনা।

সূর্য মিশ্র বলেন, মানুষই আমাদের শিক্ষক। এই মানুষদের জীবন্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আমাদের কাজ‌ হচ্ছে শ্রেণিঐক্যকে সুদৃঢ় করা। জেলায় আদিবাসী, অ-আদিবাসী সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। বিজেপি-তৃণমূল নিজেদের স্বার্থে চাইছে এঁদের বিভক্ত করতে।

তিনি সংগ্রাম-আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের লড়াই-আন্দোলনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে লড়াইয়ে অভিজ্ঞ কর্মীরা পার্টিতে আসে। আশু ও আদায়যোগ্য দাবিতে আমাদের আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। কিছু কিছু দাবি গ্রামপ্রধান বা পৌরসভার চেয়ারম্যানের কাছ থেকেই আদায় করা যায়। সব দাবি নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের সরকারের কাছে যাবার প্রয়োজন নেই। যে সমস্যা সবচেয়ে বেশি মানুষকে আঘাত করে, যে দাবি নিয়ে অনেক বেশি মানুষ‍‌কে আকৃষ্ট করা যায়, তা নিয়ে আমাদের লড়াই-আন্দোলন চালাতে হবে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে দাবি নিশ্চয়ই জানাতে হবে। কিন্তু আদায়যোগ্য দাবি কী হবে এবং সেই দাবি আদায়ে আন্দোলন কীভাবে হবে, তা ঠিক করতে হবে।

এই সূত্র ধরেই তিনি বলেন, ছাত্র সংগঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনের চাপে স্কুল-কলেজ খুলেছে। বর্তমানে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে ছাত্রছাত্রীদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। আজ খাদ্য, শিক্ষা ও কাজের সংকট মানুষকে ভয়ংকর আঘাত করছে। কাজেই এসব নিয়ে এক-দু’ঘণ্টা ডেপুটেশন বা অবস্থান করলেই হবে না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি সংযুক্ত কিষান মোর্চার বছরভর লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, দলমত নির্বিশেষে ৫০০-র বেশি কৃষক সংগঠন যদি একসাথে রোদ, ঝড়, জল উপেক্ষা করে একবছর ধরে লড়াই চালিয়ে দাবি আদায়ের জায়গায় পৌঁছাতে পারে, তবে আমরা কেন দাবি আদায়ে পঞ্চায়েতে টানা অবস্থান করতে পারবো না? তাই আমাদের সংগ্রামের ধারাকে পরিবর্তন করতে হবে।

পরিশেষে তিনি বলেন, শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্র করার অর্থ হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে জোরালো করা। এজন্য পার্টি সদস্যদের মতাদর্শগত ভিত্তি ও গুণমানকে উন্নত করতে হবে। পার্টিতে বেশি বেশি করে তরুণ ও মহিলাদের নিয়ে আসতে হবে। মতাদর্শের ভিত্তিতে পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ ও সুদৃঢ় করে সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই করে এগিয়ে যেতে হবে। এই জেলায় পার্টির পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে এবং গরিব আদিবাসী জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে লড়াই করতে গিয়ে যে অসংখ্য কমরেড শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের লক্ষ্যপূরণে অবিচল থাকার আহ্বান জানান তিনি।

খসড়া প্রতিবেদন উত্থাপন

সম্মেলনে খসড়া সাংগঠনিক-রাজনৈতিক প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক পুলিনবিহারী বাস্কে। তিনি বলেন, মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন এবং সংগ্রাম-এর ভিত্তিতে জেলায় পার্টিকে পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই সময়কালে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করার নতুন অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। বিগত জেলা সম্মেলনের পর পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং তারপর লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে বিজেপি-আরএসএস বনাঞ্চলের আদিবাসীদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করেছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা বহু জায়গায় প্রার্থী দিতে পারিনি। এরপর ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়। তিনি বলেন, জেলার সামগ্রিক বিন্যাসে ৩১-৩২ শতাংশ আদিবাসী, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। এছাড়া ২০ শতাংশ তফশিলি সম্প্রদায়ের, কুর্মি সম্প্রদায়ের ১৮ শতাংশ, ওবিসি ১০ শতাংশ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪ শতাংশ মানুষ রয়েছেন। এই মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করতে আমাদের দুর্বলতা ছিল।

এই অঞ্চলে সন্ত্রাস-নৈরাজ্যে শহিদের মৃত্যুবরণ করার দীর্ঘ ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালে শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্টির যাত্রা শুরু হয়েছিল। তখন মাত্র ৯ জনের একটি ছোট্ট শাখা ছিল। ১৯৭০-এর দশক থেকেই সামন্ত প্রভুদের আক্রমণে খুন হতে হয় পার্টিকর্মীদের। আশির দশকে তীব্র জাতিসত্তার রাজনীতির বলি হতে হয়েছে পার্টি কর্মীদের। এরপর ২০০৪ সালে এ‌মসিসি-পিডব্লিউজি এক হয়ে মাওবাদী দল গঠন করে। এদের সাথে তৃণমূলীরা মিলে জনসাধারণের কমিটি তৈরি করে সিপিআই(এম)-কে আক্রমণের মূল লক্ষ্য হিসাবে স্থির করে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই প্রতিক্রিয়ার শক্তির হাতে প্রায় ৪৫০ জন সিপিআই(এম) কর্মীকে নৃশংসভাবে খুন ও অসংখ্য কর্মীকে অপহরণ করে খুন করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর যাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা, তাদের মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। আর যারা খুন-সন্ত্রাসে লিপ্ত ছিল, তাঁদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। এই সন্ত্রাস আক্রমণের মধ্যে তখন জঙ্গলমহলে লালঝান্ডা তোলা যেতো না। সেই অবস্থা অতিক্রম করে লালঝান্ডা নিয়ে সাধ্যমতো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই জারি রয়েছে।

তিনি কোভিড পরিস্থিতিতে সীমিতসাধ্যে বিপন্ন মানুষের পাশে থাকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, পার্টির বিভিন্ন এরিয়া কমিটিগুলি রেড ভলান্টিয়ার বা অন্য সংগঠনের নামে বিজ্ঞান মঞ্চকে সাথে নিয়ে সাধ্যমতো ভিনরাজ্য থেকে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করেছে। এর মধ্য দিয়ে অনেক নতুন কর্মী আমাদের কাছাকাছি এসেছেন।

রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তের মতো এই জেলায়ও শাসকদল তৃণমূলের স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্তসুলভ কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে যেভাবে ব্যাহত করছে তার উল্লেখ সহ তিনি বলেছেন, আসন্ন পৌর নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে ঝাড়গ্রাম পৌর অঞ্চলের মানুষের জীবনের মান উন্নত করার লক্ষ্যে এবং দুর্নীতিমুক্ত পৌরসভা গড়তে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রতিনিধিদের আলোচনা

সম্মেলনে উত্থাপিত খসড়া প্রতিবেদনের ওপর প্রতিনিধিদের আলোচনাতেও সর্বাগ্রে উঠে এসেছে তৃণমূল-মাওবাদী-জনসাধারণের কমিটির হিংসা-সন্ত্রাস ও নির্বিচারে খুনের কাহিনি এবং এই সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করার অকুতোভয় লড়াই ও লালঝান্ডা প্রতিষ্ঠার দুঃসাহসিক অভিযান। তাঁরা বলেছেন, পার্টিকর্মীরা তাঁদের প্রিয় সাথি, পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, তাঁদের ঘরবাড়ি, পার্টি দপ্তর ভাঙচুর হয়েছে, তাঁরা গৃহহীন হয়েছেন, তবুও তাঁরা মাথানত করেননি, পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন।

অনেক প্রতিনিধির আলোচনাতেই ঘুরে ফিরে এসেছে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে পার্টিকর্মী ও রেড ভলান্টিয়ারদের অসামান্য ভূমিকার কথা। ওই সময়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওডিশা, ঝাড়খণ্ড সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকরা যে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন, সেই অবস্থায় সাধ্যমতো তাঁদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে। অনেক জায়গাতেই তাঁদের আলাদা জায়গায় রেখে খাদ্য সামগ্রী সহ প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমরদা সহ কয়েকটা জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করতে গিয়ে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রতিনিধিরা বলেছেন, তখন রাজ্য সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।

প্রতিনিধিরা তাঁদের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, বাম আমলে জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গরিব আদিবাসীদের স্বার্থে যে সমস্ত কর্মোদ্যোগ চালু ছিল, তার অনেকগুলিই বন্ধ। শুধুমাত্র ভোটের আশায় সরকারি কোষাগারের অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা কিছু জায়গায় হলেও, পঞ্চায়েতের উদ্যোগে গ্রামীণ পরিষেবা নেই বললেই চলে। এমএসকে, এসএসকে প্রভৃতি কেন্দ্র বন্ধ। অনেক জায়গাতেই মিড ডে মিল চালু নেই। একশো দিনের কাজে ব্যাপক লুটপাট চলছে। খেতমজুরদের মজুরি মিলছে না। কৃষকরা পাচ্ছেন না ফসলের দাম। গ্রামে কোনো কাজের সংস্থান নেই। তাই দলে দলে যুবকরা পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে। প্রতিনিধিরা বলেছেন, বাম আমলে অনেক জায়গায় ভূমিহীনদের জমি বণ্টন করা হয়েছিল। সেই জমির পাট্টা মিলছে না, উলটে জমি কেড়ে নেওয়‌া হচ্ছে।

প্রতিনিধিরা বলেছেন, এই অবস্থার মধ্যেও জল, জঙ্গল, জমির অধিকার, ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবি সহ গরিব মানুষের বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিভিন্ন স্তরে স্মারকলিপি প্রদান, মিছিল, অবস্থান ইত্যাদি কর্মসূচি সংগঠিত করেছেন। তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও তার মোকাবিলায় পার্টিকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। এই লক্ষ্যে মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে, আদর্শে দৃঢ় থেকে ঐক্যবদ্ধ ও সুদৃঢ় পার্টি গড়ার কাজে ব্রতী হতে হবে।

মোট ২৩ জন প্রতিনিধির আলোচনা শেষে জবাবি ভাষণ দেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক পুলিনবিহারী বাস্কে। তিনি বলেন, পার্টির সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে উঠে মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠনকে গড়ে তুলতে হবে এবং আমাদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম গড়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতাগুলি কাটাতে হবে। পার্টিকে শক্তিশালী করতে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম জারি রাখতে হবে। আমাদের যে শ্রেণিশক্তি রয়েছে, সেই খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থে লড়াই-আন্দোলন পরিচালনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আসন্ন পৌর নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রামে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে।

জবাবি ভাষণের পর খসড়া প্রতিবেদনটি গৃহীত হয়।

নেতৃবৃন্দের ভাষণ

সিপিআই(এম) ঝাড়গ্রাম জেলা সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বিমান বসু এবং অমিয় পাত্র। বিমান বসু তাঁর ভাষণে পার্টির গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারার উল্লেখ সহ মতাদর্শগত চর্চা ও রাজনীতির অনুশীলনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, এর মধ্য দিয়ে পার্টির ভিত মজবুত হয়। তিনি বলেন, পার্টিকর্মী হিসাবে অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে, একইসঙ্গে জোর দিতে হবে পারস্পরিক আলোচনার। এর মধ্য দিয়েই আমরা সঠিক অবস্থানে যেতে পারব। মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হবো। মানুষের আস্থাও অর্জন করতে পারবো। আমি আশাকরব নতুন জলা কমিটি সেই কাজে অগ্রসর হবে, গরিব-আদিবাসী মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকা‍‌‍‌শের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। আগামী ২৭ এবং ২৮ মার্চ সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করতে উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

অমিয় পাত্র তাঁর ভাষণে বলেন, একটি সম্ভাবনাময় জেলা এই ঝাড়গ্রাম। এখানে তফশিলি, আদিবাসী, পিছিয়ে-পড়া মানুষ সহ অন্যান্য মেহনতি অংশের মানুষ রয়েছেন। তাঁদের সামাজিক বিন্যাস বৈচিত্র্যপূর্ণ। সীমান্তবর্তী এই জেলায় এই সম্ভাবনার দিকগুলিকে কাজে লাগিয়ে মতাদর্শের ভিত্তিতে পার্টিকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। ভাতের লড়াইটা এক ইঞ্চিও এগোনো যাবে না, যদি আন্দোলনের অধিকারই না থাকে। তাই সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। বর্তমানে তৃণমূল-বিজেপি’র বিকল্প একমাত্র বামপন্থীরাই। তাই এই বিকল্প হিসাবে পার্টিকে প্রতিষ্ঠা করাই একমাত্র কাজ। আসন্ন পৌর নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রামে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান তিনি।

গৃহীত প্রস্তাব

সিপিআই(এম) ঝাড়গ্রাম জেলা দ্বিতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রদায়িকতা, দেশবিরোধী ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এবং কেন্দ্র থেকে বিজেপি-কে হটানো; পেট্রোল-ডিজেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশ-ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে; সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলতে; বনাধিকার আইন (২০০৬-২)০৮) কার্যকর করা এবং ভূমিসংস্কারের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা; গ্রামীণ খেতমজুর ও অসংগঠিত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে রেগা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ চালু করা; সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম পরিচালনা করা; সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্বে পরিচালিত ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সাফল্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং আসন্ন পৌর নির্বাচনে দুর্নীতিগ্রস্ত গণতন্ত্র নিধনকারী তৃণমূল কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি-কে পরাস্ত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রাম শহরের বিভিন্ন অঞ্চল লালপতাকায় সাজানো হয়। সম্মেলনস্থল সংলগ্ন রাস্তার দু’পাশে পিসি যোশী, কল্পনা দত্ত, অরুণা আসফ আলি, বি টি রণদিভে, সতীশ পাকড়াশি, সুবোধ রায় প্রমুখ কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রতিকৃতিতে সাজানো হয়। শহিদবেদির সামনে জেলার শহিদদের নামের তালিকা সংবলিত ব্যানার সাজিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়েছে।