৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮
রেগা ও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পুকুর চুরি বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের
হারাধন দেবনাথ
ত্রিপুরায় এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চলছে। প্রায় প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে মৃতদেহ। কাজ খাদ্যের সংকটের সঙ্গে দুর্নীতির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে মানুষ বর্তমান এই দুর্বিসহ অবস্থার পরিবর্তন চাইছেন।
সম্পূর্ণ দিশাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকার চলছে রাজ্যে। বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের ৪৬ মাস শাসনকাল নিয়ে এই মন্তব্য করেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, শুরু থেকেই দিশা ছিল না বিজেপি-আইপিএফটি সরকারের। এখন সম্পূর্ণ দিশাহীন অবস্থা। প্রতিটি দপ্তরেই চলছে ব্যাপক দুর্নীতি।
বিভিন্ন সংবাদপত্র, সংবাদ চ্যানেল, সামাজিক মাধ্যমে নানা দুর্নীতির বিষয় উঠে আসছে। এর কোনো সীমা সংখ্যা নেই। জোট সরকারের ৪৬ মাসের শাসনে বিদ্যুৎ, গ্রামোন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্রসহ সমস্ত দপ্তরে অবাধে দুর্নীতি চলছে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচে বিজ্ঞাপন সেঁটেও সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করা সম্ভব হচ্ছে না।
সোশ্যাল অডিট নিয়ে পত্রপত্রিকায় নানা অভিযোগ উঠেছে। রেগা’র আইন অনুযায়ী একটা সামাজিক অডিটের ব্যবস্থা রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পোর্টাল বলছে, ত্রিপুরায় এক-চতুর্থাংশও অডিট হয়নি। রাজ্য সরকার বলছে অন্য কথা। দুটো’র মধ্যে কোনো মিল নেই। রাজ্যের সোশ্যাল অডিটের ডিরেক্টরের প্রাথমিক অভিমত রাজ্যের নানা পত্রপত্রিকায় উঠেছে। তাতে ১৮৩ কোটি টাকা গরমিল। যথারীতি সরকারের টনক নড়েনি। ঋষ্যমুখ, কাঞ্চনপুর, জম্পুইহিল, জম্পুইজলা সর্বত্রই একই অবস্থা। সামাজিক মাধ্যমে এনিয়ে হাসি-মস্করা, ঠাট্টা হচ্ছে। কোনো কোনো দপ্তর বাপ-পুতের লুটের আখড়া। কোনো কোনো দপ্তর আবার ভাই-ভাতিজার লুটের আখড়া।
সম্প্রতি প্রকাশ্যে এলো রেগা প্রকল্প রূপায়ণে এ রাজ্যে আর্থিক অপব্যবহার ও আর্থিক বিচ্যুতির বিষয়টি। হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক থেকেই সামনে এসেছে এখবর।
মন্ত্রকের নির্দেশিকায় স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে হাওয়া হয়ে যাওয়া মোট টাকার ৫০ শতাংশও যদি আদায় করা না হয়, তাহলে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রেগা প্রকল্পে শ্রমিকদের মজুরি এবং বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করবে না এমপাওয়ার্ড কমিটি। অর্থাৎ রেগায় কোনো বরাদ্দ মিলবে না ত্রিপুরার। এই চিঠি হাতে পেয়ে রাতের ঘুম উবে যাওয়ার অবস্থা সংশ্লিষ্ট আমলাদের।
বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার এবং দুর্নীতি সমার্থক। এটা উপলব্ধি রাজ্যের সাধারণ মানুষের। বাজার-হাট, পাড়ার আড্ডা সর্বত্রই মানুষের মুখে-মুখে ঘুরছে দুর্নীতির নানা কাহিনি। বিভিন্ন সংবাদপত্র, সংবাদ চ্যানেল, সামাজিক মাধ্যমেও প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়ছে দুর্নীতির নতুন নতুন ঘটনা। যা দেখে সাধারণ মানুষ বলছেন, বিদ্যুৎ নিগমের আর্থিক কেলেঙ্কারি ছাপিয়ে গেছে সবকিছু। বকেয়া বিল আদায়ে এমডি’কে ঘিরে ঠিকাদারদের বিক্ষোভ, নানা বিশেষণে ভূষিত করার মতো ঘটনা রাজ্যের ইতিহাস ঘেঁটেও দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন জোট শাসনে দুর্নীতির জাল কতোটা বিস্তার লাভ করেছে। সম্প্রতি সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক পূর্ত, বিদ্যুৎ, স্বরাষ্ট্র, গ্রামোন্নয়ন, কৃষিসহ বিভিন্ন দপ্তর ধরে ধরে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন জোট সরকারের বিরুদ্ধে। আজ পর্যন্ত এ নিয়ে সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া কিংবা স্পষ্টীকরণ চোখে পড়েনি সাধারণ মানুষের।
রেগার কাজে দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি সোশ্যাল অডিট শুরু হওয়ার পর। কিন্তু তা মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পোর্টালে সোশ্যাল অডিট নিয়ে দেওয়া তথ্যের সাথেও বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয় রাজ্যের সোশ্যাল অডিট ডিরেক্টরের ভাষ্যে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে কম করেও ১৮৩ কোটি টাকার ঘোটালা হয়েছে। এবার রাজ্য সরকারের এক বিশেষ সচিবের চিঠিতেই ফুটে উঠেছে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি। সমস্ত জেলাশাসকের (রেগার ডিস্ট্রিক্ট প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর) উদ্দেশে গত ২৫ জানুয়ারি জারি করা চিঠিতে বিশেষ সচিব স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন, রাজ্যের সোশ্যাল অডিটে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বেশ কিছু আর্থিক অপব্যবহার (ফিনান্সিয়াল মিসএপ্রোপ্রিয়েশন) এবং আর্থিক বিচ্যুতি (ফিনান্সিয়াল ডেভিয়েশন)-র বিষয় উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন বৈঠকে এ বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে এবং বিষয়গুলি কমিয়ে আনার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ রেখেছে। গত ৫ জানুয়ারি জারি করা কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সে চিঠিতেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফিনান্সিয়াল মিসএপ্রোপ্রিয়েশন এবং ফিনান্সিয়াল ডেভিয়েশনের ৫০ শতাংশ টাকাও যদি তুলে আনা না যায়, তাহলে এমপাওয়ার্ড কমিটি ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে এমজিএন রেগা প্রকল্পে এ রাজ্যের লেবার বাজেট এবং অ্যানুয়াল অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণ করবে না।
বিশেষ সচিবের চিঠিতে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী ধলাই জেলায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২ কোটি ২৫ লক্ষ ৯০ হাজার ৬৬৭ টাকা অপব্যবহার করা হয়েছে। গোমতী জেলায় সে পরিমাণ ৬৮ লক্ষ ৭৪ হাজার টাকা, খোয়াই জেলায় ৫৫ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা, উত্তর জেলায় ৫ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা, সিপাহিজলা জেলায় ১ কোটি ৯৯ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা, দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলায় ৬৬ লক্ষ ৫ হাজার টাকা, ঊনকোটি জেলায় ৫ লক্ষ ৬১ হাজার টাকা এবং পশ্চিম জেলায় ৩৬ লক্ষ ৯ হাজার টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ধলাই জেলায় ৫৩ লক্ষ ৭ হাজার টাকা, গোমতী জেলায় ৯৬ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা, খোয়াই জেলায় ৩৬ লক্ষ ১ হাজার টাকা, উত্তর জেলায় ৮০ হাজার টাকা, সিপাহিজলা জেলায় ৩৯ লক্ষ টাকা, দক্ষিণ জেলায় ৩৩ লক্ষ ২ হাজার টাকা, ঊনকোটি জেলায় ২৪ হাজার টাকা এবং পশ্চিম জেলায় ৪ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ধলাই জেলায় ৬৫ লক্ষ ৮৯ হাজার টাকা, গোমতী জেলায় ১ কোটি ৩১ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা, খোয়াই জেলায় ১৪ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা, সিপাহিজলা জেলায় ৭ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা, ঊনকোটি জেলায় ১ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা এবং পশ্চিম জেলায় ১২ লক্ষ ২২ হাজার টাকা।
রাজ্য প্রশাসনের সৎ, নিষ্ঠাবান আমলারা বলছেন, কোটি কোটি টাকা এভাবে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ সচিবের চিঠিতে শুধুমাত্র ফিনান্সিয়াল মিসএপ্রোপ্রিয়েশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সহজে বললে, কোনো কাজ অর্ধ সমাপ্ত রেখে টাকা উধাও করে দেওয়া হয়েছে। ফিনান্সিয়াল ডেভিয়েশন আরও বড়ো আর্থিক অপরাধ। সে তথ্য সামনে আসেনি। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কর্মকর্তাকে ঘুমে রেখে কোনো দপ্তরের বরাদ্দ অন্য কোনো দপ্তরে সরিয়ে নেওয়া। সব মেলালে দুর্নীতির বহর অনেক বড়ো। প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পুরো সময় কাজ করে যেতে পারেনি বামফ্রন্ট সরকার। ৯ মার্চ শপথ নিয়েছিল নতুন সরকার। ফলে ঐ অর্থ বছরের ফিনান্সিয়াল মিসএপ্রোপ্রিয়েশনের ঘটনাগুলিতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে যেতে পারেনি বামফ্রন্ট সরকার।
কয়েক দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর নিয়ে বাগাড়ম্বর করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকৃত যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রত্যেকটি মহকুমায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে ৫-৪০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই টাকা না দিলে সুবিধাভোগীদের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দেওয়া হবে না। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ্যে সুবিধাভোগীরা এসব কথা জানাচ্ছেন। বিধবা মা, জুমিয়া, খেতমজুর, সাধারণ মানুষ বলছেন। কিন্তু সরকারের কোনো হেলদোল নেই।
টিএসআর নিয়োগেও দুর্নীতি হয়েছে। সেখানে একজন মণ্ডল সভাপতির নাম এসেছে। অভিযোগকারিণীও শাসকদলের একজন নেত্রী। এ ক্ষেত্রেও কোনো এফআইআর নেই। কোনো তদন্ত নেই। শুধু তাই নয় যারা বিভিন্ন দপ্তরে ডি আর ডব্লিউ পদে কাজ করছেন, তারা বেতন পাচ্ছেন না।
সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ধান কেনার কথা বলছে। কিন্তু ধান কেনা উচিত ফসল ওঠার সাথে সাথে। কারণ ঋণ করে কৃষকদের ফসল বুনতে হয়, ট্রাক্টর ভাড়া করতে হয়, সার কিনতে হয়। ২-৩ মাস পর ধান কেনা হলে কৃষকরা এর সুবিধা পায় না। যেখানে যেখানে ধান কেনার জন্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে, সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়েদের দাপাদাপি। কৃষকরা সরাসরি গিয়ে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। এমনিতেই যে দাম দিচ্ছে, তা উচিত মুল্য নয়। তারপরেও স্থানীয় বিজেপি কেউকেটাদের দিয়ে ধান বিক্রি করাতে হচ্ছে। অর্থাৎ কিচ্ছু না করে এই সমস্ত ভুঁইফোড়রা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে অকাল বর্ষণ হয়েছে। এতে কৃষকদের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। এ সময়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে শুধু ধান নয়, যারা আলু, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি সহ নানা সবজি ফলিয়েছেন, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষকদের স্বার্থে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এখনও। সরকার সারকুলার দিয়েই খালাস। খবর লেখা পর্যন্ত কোনো মহকুমায় একজন কৃষকও ক্ষতিপূরণের এক নয়া-পয়সাও পাননি। এই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কথিত ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার নমুনা!
রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যখন এইসব চিত্র, তখন এডিসি পিছিয়ে থাকবে কেন? সেখানে তিপ্রামথা ক্ষমতায় এসেছে। ৯-১০ মাসের শাসনেই স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠে আসছে। ইঞ্জিনিয়ার সহ অন্যান্য পদে চাকরি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হচ্ছে। মূলত চেয়ারম্যান, মুখ্য কার্যনির্বাহী সদস্য, কার্যনির্বাহী সদস্যদের পরিবারের বাইরে কেউ চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না। মানুষের সমস্যা বাড়ছে। রাজ্য সরকার কিংবা তিপ্রামথা মানুষের পরিত্রাণে কোনো উদ্যোগ নিতে রাজি নয়।
রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিজেপি জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও দলীয় মুখপাত্ররা এক-একজন একেক রকম ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছেন। কারও সাথে কারও দেওয়া তথ্যের মিল নেই। আজ থেকে বছর-দেড়েক আগে শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেছিলেন ভিশন-ডকুমেন্টের ৮৭ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। ক’দিন আগে তাদের এক মুখপাত্র বললেন, ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী জানালেন, ৮০ শতাংশ কাজ হয়েছে। আবার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন ভিশন-ডকুমেন্টে যা বলা হয়েছিল, তার দ্বিগুণ কাজ করা হয়েছে। আসলে অগ্রগতির হার জিরো। কেন্দ্র ও রাজ্য বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে জোটবদ্ধ করছে সিপিআই(এম)। বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচিতে বাড়ছে মানুষের অংশগ্রহণ।