৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮
বাজেটে উপেক্ষিত আমজনতা
অর্ণব ভট্টাচার্য
মোদি সরকার এতদিন; আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখানোয় ব্যস্ত ছিল। কেন্দ্রীয় বাজেটে এবারে; অমৃত কালের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যা নাকি স্বাধীনতার এক শতক পূর্তির বছর অর্থাৎ ২০৪৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তবে সরকারি নীতির যে নমুনা দেশবাসী গত সাত বছর ধরে দেখছেন এবং এই বাজেটে যার প্রতিফলন ঘটেছে তাতে এটুকু বুঝতে কারোর কষ্ট হচ্ছে না যে, অর্থনীতি মন্থন করে যে অমৃত উঠছে তা পাচ্ছে মুষ্টিমেয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। আর জনগণ বিষপান করে নীলকণ্ঠ হতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন এদেশে সব থেকে বেশি আয় সম্পন্ন ১০ শতাংশ মানুষের আয় জাতীয় আয়ের ৫৭.১ শতাংশ। আর সব থেকে কম আয় সম্পন্ন ৫০ শতাংশ মানুষের মোট আয় জাতীয় আয়ের মাত্র ১৩.১ শতাংশ।
এই উৎকট বৈষম্যের সমাজে মোদি অমৃতকালের গল্প শোনাচ্ছেন! বাজেটের সমর্থনে গালভরা বুলি আওড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, এই বাজেট নাকি উন্নয়নের নতুন ভরসা জোগাবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আরও পরিকাঠামো গড়ে উঠবে, আরও বিনিয়োগ হবে, বিকাশ হবে আরও বেশি এবং বাড়তি কাজ পাওয়া যাবে। জল, রান্নার গ্যাস, শৌচালয় নাকি সবার জন্যই বরাদ্দ হবে। এককথায় গরিবের নাকি কল্যাণ হবে! আসলে এই অন্তঃসারশূন্য বাজেটে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতি, নদী সংযুক্তি, বিশ্বমানের পরিকাঠামো, জৈব চাষের প্রসার ইত্যাদি চটকদারি প্রতিশ্রুতির আড়ালে মৌলিক সমস্যাগুলি উপেক্ষা করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এবারের বাজেটে ফলাও করে ৩৫.৪ শতাংশ সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্ত এর জন্য উচ্ছ্বসিত হওয়ার কী কোনো কারণ আছে? কেননা এর ফলে মোট জাতীয় আয়ের অনুপাতে সরকারি ব্যয় ২.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২.৯ শতাংশ হয়েছে যা কীনা বিশেষ কোনো বৃদ্ধি নয় এবং বিগত বছরে প্রায় একইরকম বৃদ্ধি ঘটেছিল। প্রশ্ন ওঠে যে, এই ব্যয়বৃদ্ধির ফলে কী কর্মসংস্থানের কোনো লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটেছে? উত্তর, না। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির ঢক্কানিনাদের মধ্যে এই কথা চেপে যাওয়া হচ্ছে যে, বর্তমানে ভারতে সরকারি দপ্তরগুলিতে যে কয়েক লক্ষ শূন্য পদ রয়েছে তা পূরণ করবার ব্যাপারে সরকারের কোনো সদিচ্ছা নেই। তাছাড়া এই বরাদ্দের অনেকটাই ঋণ মেটাতে ব্যবহৃত হবে।
এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির জন্য টাটা গোষ্ঠীকে শর্ত বাবদ যে ৫১,৯৭১ কোটি টাকা সরকারকে দিতে হবে তাও এই ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধির সুফল আমজনতা পাচ্ছে না। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে বেকারি তীব্র আকার ধারণ করেছে। সরকার যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আগ্রহী হতো তাহলে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করত। কিন্তু বিগত বছরের সংশোধিত হিসেব অনুযায়ী যেখানে ৯৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল সেখানে এই বছর বাজেটে পূর্ববর্তী বাজেট বরাদ্দের মতোই ৭৩ হাজার কোটি টাকা রেখে দেওয়া হলো। অর্থাৎ বরাদ্দ কমল ২৫ হাজার কোটি টাকা। এখনো বিগত বছরের কয়েক হাজার কোটি টাকা মজুরি বকেয়া রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় এই প্রকল্পের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। অথচ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী এখন একশো দিনের কাজের চাহিদা অতিমারী-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বেশি। আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান জোগায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগ। এক্ষেত্রে সরকার কেবলমাত্র ঋণের সুযোগ বৃদ্ধি করেছে।
আর অসংগঠিত ক্ষেত্র যেখানে প্রায় ৯৩ শতাংশ মানুষ কর্মরত তা নিয়ে এবারের বাজেট একেবারে নিশ্চুপ। অর্থনীতিবিদরা বারবার বলেছেন যে, দেশের মানুষের হাতে টাকা না থাকলে অর্থনীতিতে চাহিদা সৃষ্টি হবে না এবং অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণকে সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেওয়া বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কোনো পরিকল্পনাই এই সরকার গ্রহণ করছে না। গত এক বছরে আমাদের দেশ সাক্ষী থেকেছে এক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের। কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়ে কার্যত কৃষিজীবী মানুষকে কর্পোরেটের দাসে পরিণত করার পরিকল্পনা আপাতত বানচাল করে দিয়েছেন লড়াকু কৃষকরা। তবে এ থেকে শিক্ষা নিতে নারাজ। কেন্দ্রীয় সরকার এই বাজেটে যথারীতি কৃষিবিরোধী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। গত ৬ বছর ধরে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করবার যে কথা মোদি সরকার বলেছিল তা নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য এবারে নেই। এবছর প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনায় বরাদ্দ বিগত বছরের তুলনায় ৫০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম অ্যান্ড প্রাইস সার্পোট স্কিমে ২০২১-২২ সালে বরাদ্দ ছিল ৩৫৯৫.৬১ কোটি টাকা যা কীনা এ বছরে কমে হয়েছে ১,৫০০কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর কৃষি সিঁচাই যোজনা অর্থাৎ সেচের জন্য প্রকল্পে বিগত বছরে সংশোধিত বরাদ্দ ছিল চার হাজার কোটি টাকা যা এবছরে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। মোদি সরকারের কৃষক দরদের এই নমুনা দেখে অবাক নন দেশের মানুষ, কেন না আম্বানি আদানির চৌকিদারের কাছে এটাই প্রত্যাশিত। এবছর বাজেটে অবশ্য কৃষিক্ষেত্রে নতুন চমক দেওয়ার সৃষ্টি হয়েছে কেমিক্যাল ফ্রি ন্যাচরাল ফার্মিং-এর কথা বলে। এই প্রকল্প নিয়ে কৃষকরা সন্দিহান, কেন না ফলন কম হওয়ার পর কৃষকদের জন্য কী আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকবে তা নিয়ে সরকার একেবারেই নীরব। অতিমারীর সময় অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত মানুষের স্বার্থে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
কিন্তু ২০২১-২২ সালে যেখানে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহের জন্য বরাদ্দ ছিল ২,১০,৯২৯ কোটি টাকা সেখানে এ বছরে তা কমে হয়েছে ১,৪৫,৯২০ কোটি টাকা। আগামী মার্চ মাস থেকে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাহলে কী সরকার ধরে নিয়েছে যে, অতিমারীজনিত দারিদ্র্যের প্রভাব ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে?
বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন এই ধরনের সরকারি হিসেব-নিকেশ মানুষকে আরও সংকটগ্রস্ত করে তুলছে। অতিমারীর সময় যখন সারাদেশে অপুষ্টি ক্রমবর্ধমান তখন মিড ডে মিল স্কিমে ১,২৬৭ কোটি টাকার বরাদ্দ ছাঁটাই পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গীন করবে।
সরকার দেশের ২৬ লক্ষ আশা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং ২৫ লক্ষ মিড ডে মিলের রাঁধুনি ও তাদের সহায়িকাদের কোনো বেতন বৃদ্ধি করেনি।
গত তিন বছরে শিশুরা সবচেয়ে বেশি দুর্গতির শিকার হলেও মোট বাজেট বরাদ্দের শতাংশ হিসেবে গত ১১ বছরে সর্বনিম্ন বাজেট বরাদ্দ এ বছর হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার যে কেবল ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে চলেছে তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ এই যে, গত একবছরে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও প্রকল্পে মোট বরাদ্দকৃত ৬২২ কোটি টাকার মাত্র ২৫ শতাংশ খরচ হয়েছে। এই সময়কালে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে, শিশু পাচারের ঘটনা বেড়েছে। সরকারের উচিত ছিল শিশু সুরক্ষায় বাড়তি নজর দেওয়া। কিন্তু ঠিক এর উল্টো পথে হেঁটে ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার প্রোগ্রামের বাজেট ১০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে মাত্র ৩০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
অতিমারীর ঘটনা থেকে সরকার যে কোনোরকম শিক্ষা নেয়নি তা এই বাজেট দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়।এই সময় জনস্বাস্থ্যে আরও বেশি করে নজর দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে মেডিক্যাল অ্যান্ড পাবলিক হেলথ খাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অজুহাত হিসেবে বলা হয়েছে যে, ভ্যাকসিনের চাহিদা কমেছে বলেই নাকি এই খরচা কমিয়েছে সরকার। ন্যাশনাল হেলথ মিশনের বক্তব্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় মোট জাতীয় আয়ের ২.৫ শতাংশ করতে হবে যা কীনা এখন মাত্র ১.৩ শতাংশ। কী করে আগামী তিন বছরের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে তার কোনো দিশা এই বাজেটে নেই। কেন্দ্রীয় সরকার ২০২২ সালের মধ্যে দেড় লক্ষ হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার তৈরির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারই বা কী হলো কেউ জানে না।
এ বছরের বাজেটে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার কথা ফলাও করে বলা হয়েছে। কিন্তু দেশের কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রী যারা ইন্টারনেটের সুবিধা না থাকায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো তাদের জন্য কী ব্যবস্থা করা হবে তা নিয়ে এই বাজেট নীরব। আবার মজার বিষয় এই যে, ডিজিটাল শিক্ষা নিয়ে এত বাগাড়ম্বরের মধ্যে এই খাতে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ব্যয় বরাদ্দ ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে। বিগত বছরে যেখানে এই খাতে খরচ হয়েছিল ৬৪৫ কোটি টাকা সেখানে এ বছরে বরাদ্দ ৪২১ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও ন্যাশনাল ডিজিটাল হেলথ মিশন নিয়ে সরকার মাতামাতি করছে। কিন্তু এখন চাই আরও বেশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র যা তৈরি করায় সরকারের অনীহা প্রকট হয়েছে।
এক ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে আমাদের দেশ। ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে। অন্যদিকে দেশের ১৪২ জন শীর্ষ ধনীর সম্মিলিত সম্পদ ৫৩ লক্ষ কোটি টাকা।
সরকার দাবি করেছে যে ৫ বছরে ৬০ লক্ষ কাজের ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ প্রতি বছর ১২লক্ষ কাজ হবে। অথচ প্রতি বছরে দেশের শ্রমবাজারে ৪৭.৫ লক্ষ মানুষ যুক্ত হয়। তাহলে কাজের চাহিদা ও জোগানের বিপুল ফারাক থেকেই যাবে। এ নিয়ে সরকারের কোনো বক্তব্য আছে? সরকার সংকটের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে গরিব-মধ্যবিত্তের ওপর, তাই আমজনতার কাঁধে আরও বোঝা চাপাতে মোট ভরতুকি বরাদ্দ ২৭ শতাংশ ছাঁটাই হয়েছে। অন্যদিকে দেশের বৃহৎ মালিকরা মোদি সরকারকে ধন্য ধন্য করছে কেন না তাদের আর্থিক দায় আরও কমিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ বছরের বাজেট আবার প্রমাণ করল যে, মোদি সরকার মানে কর্পোরেটের পৌষ মাস জনগণের সর্বনাশ।
তাই কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে মোদি সরকার জনগণকে বোকা বানানোর যতই চেষ্টা করুক দেশের সাধারণ মানুষ জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য মোদি সরকারকে ক্ষমা করবে না।