৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮
দেওচা-পাঁচামিতে কয়লা উত্তোলনঃ কিছু প্রযুক্তি ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্ন
(শেষাংশ)
তপন মিশ্র
এই অঞ্চলের বর্তমান প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে সমীক্ষা নিতান্তই প্রাথমিকস্তরে রয়েছে কারণ খনি প্রকল্প রূপায়ণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই তথ্য সরকারের কাছেও নেই কারণ মাটির নিচের তথ্য সংগ্রহের অনেক কিছুই বাকি। এই খনির কয়লা উত্তোলনের কাজ বেসরকারি সংস্থার হাতে দিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আদানি, আম্বানি, টাটা, এসারের মতো বড়ো বেসরকারি সংস্থাগুলি নিজেরা সাধারণভাবে কয়লা উত্তোলনের কাজ করে না বরং কাজ ভাগ করে ছোটো ছোটো সংস্থাকে দিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ওই ছোটো সংস্থাগুলির পরিবেশ রক্ষার আইনকানুন না মানার প্রবণতা অনেক বেশি। কারণ পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে যে যে ব্যবস্থাদি নিতে হয় তার জন্য যে খরচ তা এই বেসরকারি সংস্থাগুলি করার কোনো দায়বদ্ধতা নিতে চায় না।
শক্তি উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিতর্ক রয়েছে। কয়লা খনি এবং কার্বন নির্গমনের সমস্যা নিয়ে বিশ্বজোড়া বিতর্ক চলছে। ইয়োরোপের বেশ কিছু উন্নত দেশ ইতিমধ্যে হয় কোনো নতুন কয়লা খনি খুলছে না বা পুরনো এবং উৎপাদনশীল কয়লা খনি বন্ধ করে দিচ্ছে। অবশ্য আমেরিকার মতো উন্নত দেশ কয়লা পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন থেকে এখনও পিছু হটতে চায় না। ২০২১ সালের শেষের দিকে গ্লাসগোর ইউনাইটেড ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ওন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এ আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কয়লাখনি বন্ধের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হলো, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লা ব্যবহারের ফলে যে বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে জমা হয়, বিশ্ব উষ্ণায়নে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের ভাবায়ঃ
(ক) ইয়োরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি দেশের ঐতিহাসিক নির্গমন (historical emission)-এর ফলে ওই দেশগুলির যে দায়বদ্ধতা রয়েছে আমাদের তা না থাকার কথা। কিন্তু এই বিষের কবলে পড়ে সারা পৃথিবী এখন বিপদের মুখে। আমাদের দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ শক্তি আসে কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। তাই আমাদের কয়লা নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ বাস্তব নয়।
(খ) অন্য একটি যুক্তিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ যখন বিকল্প শক্তির গবেষণা এবং ব্যবহারের দিকে অনেকটা এগিয়েছে তখন আমাদের দেশের সে ধরনের উদ্যোগ শুরু হলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন দূষণের মাত্রা অনেকটা কমাতে পারত।
এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) তৈরি - ইআইএ সাধারণত রাপিড এবং পূর্ণাঙ্গ এই দুই ধরনের হয়। এই ধরনের বড়ো প্রকল্পে পূর্ণাঙ্গ ইআইএ বাঞ্ছনীয়। ইআইএ অর্থাৎ কয়লা খনিখননের পরিবেশগত অভিঘাত এবং ইএমপি (এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান) হলো এই অভিঘাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পদ্ধতি কী হতে পারে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি। পরিবেশগত অভিঘাত প্রস্তুতের পূর্বে প্রথমে দেখা দরকার হয় যে, এই এলাকায় প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র (natural ecosystem) কী কী আছে এবং কতটা রয়েছে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে বনভূমি, জলাভূমি ইত্যাদি রয়েছে। তা ছাড়াও কৃষি ভূমি, এবং অন্যান্য ভূমি ব্যবহার সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
ইআইএ প্রতিবেদন তৈরির পরবর্তী ধাপের ভিত্তি হলো ‘মাইনিং প্ল্যান’ এবং বিভিন্ন ঋতুতে জল, শব্দ, বায়ুর গুণমান নির্ধারণ, এই গুণমানের কী পরিবর্তন হতে পারে তা নির্ধারণ, প্রকল্পের পূর্বে জীববৈচিত্র্য, সেই অঞ্চলের সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এই তথ্য না জানলে বর্তমান পরিবেশের কতটা ক্ষতি হবে, বায়ুদূষণের (খনন কাজ এবং পরিবহণের কারণে বায়ুবাহিত ধূলিকণার জন্য) পরিমাণ কত হবে, খনন কাজ এবং তার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জলের চাহিদা কী হবে এবং তার সম্ভাব্য উৎস কী, এই সমস্ত প্রক্রিয়ায় জলদূষণের পরিমাণ কী হবে - তা জানা সম্ভব নয়। এই দূষণের প্রভাব মানুষের স্বাস্থ্যের উপর কতটা ফেলবে, প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রগুলিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে তার তথ্য ইআইএ-র একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এরপর ইএমপি তৈরি করতে হয় যার উদ্দেশ্য হলো, হৃত বাস্তুতন্ত্রের যতটা সম্ভব পুনরুদ্ধার এবং মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা। ভারত সরকারের বন, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক নিযুক্ত কোয়ালিটি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (কিউসিআই) এবং এনবিইটি দ্বারা অনুমোদিত সংস্থার দ্বারা ইআইএ তৈরি করতে হয়। এই প্রক্রিয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি (এনবিইটি তালিকাভুক্ত বিশেষজ্ঞ) নিযুক্ত করতে হয়।
এর সাথে প্রকল্প এলাকার আর্থ-সামাজিক তথ্য সংগ্রহও পরিবেশগত অভিঘাতের অংশ। এই সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে রিহাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট প্ল্যান (আর অ্যান্ড আর প্ল্যান) অর্থাৎ পুনর্বাসন এবং উচ্ছেদ হওয়া মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়। পরিবেশগত অভিঘাতের এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্স - যেহেতু এই অঞ্চলে সংরক্ষিত বনাঞ্চল (১৯২৭ সালের বন আইন অনুযায়ী রিজার্ভ ফরেস্ট এবং প্রোটেকটেড ফরেস্ট) আছে তাই ফরেস্ট (কনজারভেশন) অ্যাক্ট, ১৯৮০ অনুযায়ী বনাঞ্চল ধ্বংস করার জন্য ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্স-এর আবেদন ভারত সরকারের বন, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (MOEFCC)-এর তৈরি ফরেস্ট অ্যাডভাইসরি কমিটি (এফএসি)-র সামনে হাজির করতে হবে এবং সেই কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। এই আইনেরও কর্পোরেট-বান্ধব পরিবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্সের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ওয়াইল্ড লাইফ ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (ডব্লিউএমপি) অর্থাৎ যে বন্যপ্রাণ এই এলাকায় আছে তাদের সংরক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থার পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা এফএসি’র সামনে হাজির করতে হবে এবং তা কমিটি দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে।
এখানে যে অন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপুর্ণ তা হলো - নেট পেজেন্ট ভ্যালু (এনপিভি) অর্থাৎ অরণ্যে যে পরিমাণ বৃক্ষ কাটা যাবে তার মূল্য নির্ধারণ করে সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং অথরিটি বা কাম্পা’র তহবিলে জমা দিতে হবে। মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো অরণ্যের প্রকারভেদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এই মূল্য নির্ধারণ করবে বনবিভাগ। এছাড়াও ক্ষতিপূরণমূলক বৃক্ষরোপণের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী (বনাঞ্চল পরিষ্কার করতে হলে একরকম এবং বনাঞ্চলের বাইরে কোনো প্ল্যান্টেশন অঞ্চল হলে আরেক রকম) বৃক্ষরোপণের অর্থ এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ পরিকল্পনা রূপায়িত করার অর্থ বনবিভাগে জমা দিতে হয়।
অরণ্য সম্পদ ও সংরক্ষণের দায়
দেওচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিংহা কোল ব্লকে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ৩x০.৫=১.৫ বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৫০ হেক্টর। দেউচা এবং হিংলো পঞ্চায়েতের অধীনে নিশ্চিন্তপুর থেকে পচ্চনপুর ঘাট পর্যন্ত দ্বারকা নদীর দুই পাড়ে এই প্রোটেকটেড কপিস (coppice) শাল বনাঞ্চল এখানকার প্রাকৃতিক অরণ্য সম্পদ। মূলত ছোটোনাগপুর মালভূমির পশ্চিম অংশে লালমাটি (ল্যাটেরাইট মাটি) অঞ্চলে শুষ্ক পর্ণমোচী (dry-deciduous forest) বনাঞ্চলের এটি একটি অংশ। শুষ্ক বনাঞ্চল বলতে বৃষ্টিপাতের অপ্রতুলতা বোঝায় না। এখানে গড়ে বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০০ মিলিমিটারের কাছাকাছি। কিন্তু বৃষ্টিপাতের সিংহভাগ মূলত ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে আবদ্ধ থাকে ফলে বছরের অধিকাংশ সময় মাটি (forest-floor) শুষ্ক থাকে। বর্তমানের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আরাবাড়ির যৌথ বনপরিচালন ব্যবস্থার আন্দোলন সাফল্য লাভ করে এই ধরনের অরণ্য বাস্তুতন্ত্রে। প্রতি ১০ বছর অন্তর শাল গাছ কাটার ফলে যে ধরনের প্রাকৃতিক অরণ্য তৈরি হয় তাকে কপিস শাল বনাঞ্চল বলা হয়। এই অঞ্চলের শালের একটি অদ্ভুত ক্ষমতা হলো, কাটার পর গোড়া থেকে ফোড় উৎপাদনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিয়মে নতুন করে বনের সৃষ্টি হওয়া। তার জন্য রোপণ বা শাল বীজের অঙ্কুরোদ্গমের সম্ভাবনার উপর নির্ভর করতে হয় না। এই বনাঞ্চলে প্রজাতি বৈচিত্র্য নেহাত কম নয়। বর্ষার শেষে এই প্রজাতি বৈচিত্র্য সর্বাধিক হয়।
শাল ছাড়াও মহুয়া, পিয়াল, হরিতকী, কেন্দু, ভেলা,পড়াশি, করম ইত্যাদি কাষ্ঠল সম্পদ (timber resource) এবং বহু ধরনের অকাষ্ঠল বনজ সম্পদ (non-timber forest product) যেমন আটাং, কুড়চি, চুন আলু, বন আলু, সিয়া কুল, বন খেজুর, কালমেঘ, আলকুশি, রাম দাঁতন/কুমারিকা, শত মূল, অনন্ত মূল, ঈশ্বর মূল, বন তুলসী ইত্যাদি খাদ্য এবং ওষধি প্রজাতি এখানে পাওয়া যায়। শাল বনের কোনো কোনো স্থানে সেগুনের রোপণ করা হয়েছে, যা এখানকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের স্বাভাবিক প্রজাতি নয়। মূলত অকাষ্ঠল বনজ সম্পদের কারণে বনবাসী-আদিবাসী মানুষদের অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা বহুমাত্রিক। এই অরণ্য নির্ভরশীলতাই অরণ্য সংরক্ষণের একটি বড়ো উপাদান। এই বনাঞ্চল গণপুর এবং মহম্মদবাজার রেঞ্জ (Forest Range)-এর চরিচা ফরেস্ট বিটের অধীনে। এই বনাঞ্চলের অনেকগুলি বনরক্ষা কমিটি রয়েছে। এই সমস্ত বনরক্ষা কমিটির প্রায় ৯৫ শতাংশ সদস্য আদিবাসী। ফলে বলা যায় যে, আদিবাসীরাই দীর্ঘদিন ধরে এই বনাঞ্চলের রক্ষক (conservator)। বনরক্ষা কমিটির বনবাসী-আদিবাসী মানুষের বনাঞ্চলের অকাষ্ঠল বনজ সম্পদের উপর সম্পূর্ণ অধিকার এবং কাষ্ঠল বনজ সম্পদের উপর আংশিক অধিকার রয়েছে। এই অধিকার ১৯৮৮ সালের ভারত সরকারের বননীতি এবং তার উপর ভিত্তি করে ১৯৮৯ সালে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন-অধিনিয়ম (Forest Legislation) অনুযায়ী স্বীকৃত। ফলে খনির জন্য এই বনাঞ্চল ধ্বংস হলে আদিবাসীদের জীবিকার উপর এক বড়ো আঘাত আসবে।
আমাদের রাজ্যে শুষ্ক পর্ণমোচী শাল অরণ্যের মোট কার্বন স্টক (carbon stock)-এর পরিমাণ আনুমানিক প্রতি হেক্টরে ৪০-৫০ টন । অবশ্য এই পরিমাণ অনেকগুলি উপাদনের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যক্ষভাবে এই এলাকায় তথ্য সংগৃহীত না হলেও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার ল্যাটেরাইট কপিস শাল বনাঞ্চলে যে সমস্ত গবেষণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে হয়েছে সেই তথ্য ব্যবহার করে কার্বন নির্গমনের হিসাব করা যেতে পারে। যদি গড়ে এই অঞ্চলে প্রতি হেক্টরে ৪৫ টন ধরে নেওয়া হয় তাহলে ১৫০ হেক্টর বনাঞ্চলে ৬,৭৫০ টন কার্বন এই অরণ্যের বিভিন্ন স্তরে (বৃক্ষ+বিরুৎ এবং গুল্ম+মৃত্তিকা) জমা আছে বলে অনুমান করা যেতে পারে। আগেই উল্লেখিত হয়েছে, যেহেতু এই অঞ্চলে সরেজমিনে কার্বন স্টক সমীক্ষার সুযোগ আমরা পাইনি তাই অনুমানের কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। কার্বনের পরিমাণ কিছু বেশি বা কম হতে পারে। এই বনাঞ্চল ধ্বংস হলে এই বিপুল পরিমাণ কার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসবে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মাটিতে সঞ্চিত কার্বনের পরিমাণ অন্য দুটি স্তরের সঞ্চিত কার্বনের মিলিত পরিমাণের থেকে বেশি হয়। অরণ্য ধ্বংস হলে নিচের মাটি সূর্যালোকের সংস্পর্শে এসে দ্রুত জারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঞ্চিত কার্বন কার্বন ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়ে বায়ুমণ্ডলে জমা হবে। সৃজিত বন (plantation)-এ মাটিতে সঞ্চিত কার্বনের পরিমাণ অনেক কম।
এই কোল ব্লকের দেওয়ানগঞ্জ, হরিণসিংহা, মথুরাপাহাড়ি, সাগরবান্ধি, কেন্দ্রাপারা, গোবরবাথান, খুটেপারা গ্রামে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি ইত্যাদি প্রজাতির রোপণ নজরে পড়ে। হিসাব মতো এই পরিমাণ হলো প্রায় ২১,০০০টি গাছ। এগুলি ধ্বংস হলেও এক বড়ো পরিমাণের কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে জমা হবে। বনবাসীরা জ্বালানি সংগ্রহের জন্য এই সমস্ত সৃজিত বনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
শব্দ ও বায়ুদূষণ খনি এলাকার এক বড়ো সমস্যা। মানবদেহে এই দুইয়ের প্রভাব ব্যাপক। এই এলাকায় পাথর খনন এবং ক্রাসিংয়ের কারণে উভয় দূষণ ক্ষতিকর মাত্রায় পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে সিলিকোসিসের সমস্যা এক বড়ো সমস্যা হিসাবে সামনে এসেছে। কয়লা খনি হলে এই দূষণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তার কোনো স্বচ্ছ পরিকল্পনা সরকারের নেই।
ইআইএ-র আর একটি বড়ো উপাদান হলো প্রকল্প এলাকা থেকে মানুষের উচ্ছেদ এবং পুনর্বাসন সম্পর্কিত সরকারি পরিকল্পনা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯,০৩৪ আদিবাসী পরিবারকে স্থানান্তরিত করতে হবে এবং এই মানুষের সংখ্যা কম করে ২১,০০০।
একটি পূর্ণাঙ্গ ইআইএ-র অভাব, অস্বচ্ছতা এই সমস্ত ক্ষেত্রে খনি সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ তৈরি করে। উন্নয়ন বিরোধিতা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। অস্বচ্ছতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে মানুষ বিরুদ্ধ মত পোষণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। এব্যাপারে সরকারের দমনমূলক নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।