৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮
তেভাগার জং
মানবেশ চৌধুরী
কালী সরকার ছিলেন মহান তেভাগা সংগ্রামের একজন অন্যতম নেতা। বিশেষ করে খাঁপুর তেভাগা সংগ্রামের - যেখানে ২২ জন বীর শহিদ হয়েছিলেন।
জং অর্থ যুদ্ধ। মহরমের সময় সাধারণত গাওয়া হয়। সেই গানের সুরকে ভিত্তি করে ১৯৪৯ মতান্তরে ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে খাঁপুরের তে-ভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক কমরেড কালী সরকার এই গানটি রচনা করেন। এতে খাঁপুরের তে-ভাগা লড়াইয়ের কাহিনি বর্ণিত আছে। গানটি এখন ঐতিহাসিক নথির অন্তর্গত হয়ে গিয়েছে।
নিচে কালী সরকার লিখিত জং গানের পুরোটা তুলে দিলাম।
কালী সরকারের দরিদ্র মাটির ঘরে একটা বাক্সের মধ্যে এই গানের কপি মলিন হয়ে পড়েছিল। প্রায় ৫০ বছর আগে ‘গণশক্তি’ পত্রিকার তৎকালীন চিফ নিউজ এডিটর প্রয়াত অসীম বসু, কালী সরকারের শ্যালক প্রয়াত বিশ্বনাথ দাসের সাহায্যে এই অমূল্য ধন উদ্ধার করেন এবং ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির মুখপত্র ‘গণনাট্য’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। অসীম বসু এভাবে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সুযোগে কালী সরকার ও তাঁর উদ্দেশে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
১৯৯৭ সালে তেভাগা সম্পর্কিত কলকাতার জনসভায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রখ্যাত সংগঠক ও গায়ক কঙ্কণ ভট্টাচার্য এই জং গানটি পরিবেশন করেন।
সে জন্য তাঁকেও অনেক ক্লেশ সহ্য করতে হয়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে, আমাদের পাশের গ্রাম বুড়িদিঘি’র প্রয়াত রহিমুদ্দিন মণ্ডলের কাছ থেকে জং গানের বিশেষ সুর তাঁকে তুলে নিয়ে যেতে হয়। তাঁকে আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। এবার গানটি -
রণে সাজিল রে
রণ যায় রণ ডঙ্কা বাজিল রে।।
একে একে বলে যাই শোনেন বন্ধুগণ
খাঁপুর যুদ্ধের কথা করিব বর্ণন
১৩৫৩ সাল মাঘ মাসের শেষে
তেভাগার রণে কৃষক কুদ্দিল [১] সাহসে।।
ভালকা বাশেঁর ধনুক নিল হস্তেতে তুলিয়া
চোখা চোখা তীর নিল পৃষ্ঠেতে বাঁধিয়া
দলে দলে কৃষক সাজে বলে মার মার
কোমর বান্ধিয়া সবে হৈল তৈয়ার
ঘুটঘুটি আন্ধার রাতে ম্যাঘের ঝরে পানি
জালিমে [২] এই রাতে বুঝি করিবে দুশমণি।।
পৃষ্ঠে বান্ধি ধনুক তীর চোঙ লইয়া করে
ভ্যালান্টি [৩] পাহারা দ্যায় পতিরাম মোড়ে
এমন সময় দ্যাখ দূরে দেখা যায়
মটোর গাড়ির বাতি মিটিমিটি চায়
মিলিটারির গাড়ি আসে ভ্যালান্টি ভাবিল
হুশিয়ার বলি মর্দ চোঙে ফুঁক দিল।।
ডিংডিং শব্দে নাগরা উঠিল বাজিয়া
ইনক্লাব শব্দে আকাশ উঠিল কাঁপিয়া
না ঢুকে সৈন্যে গাড়ি রড় [৪] দিল রণে
পতিরামে ঢুকিলা মোড় নিল ডানে
কতক দূর হৈতে গাড়ি কতেক দূরে যায়
বড় রাস্তা ছাড়ি খাড়ি গাঁয়ের পথে যায়।।
এক ধারে উচা পাগাড় এক ধারে বাড়ি
শুলশুলি [৫] পথে মোটর যায় গুড়িগুড়ি।।
সম্মুখে ফাঁকা জায়গায় মোটর গাড়ি থুইয়া
নামিল কতেক সৈন্য বন্দুক কাঁধে লইয়া।
।। ২ ।।
আনধার রাতে চুপে চুপে বাড়িতে ঢুকিল
গোপেশ ডাক্তারের সাথে পাঁচজনকে ধরিল।
হাতেতে হাতকড়ি লাগায়ে কোমরে বান্দে দড়ি
কিল চড় মারি তাদের নিয়ে যায় ধরি।।
গ্রামের মহিলা যত ক্ষেপিয়া উঠিল
ঝাঁটা-বারণ হস্তে মোটর ঘেরিল।।
নারীগণ সৈন্যে কয় শোনরে গোলাম
সবারে ছাড়িয়া দাও করিয়া সেলাম
ঝাঁটার বাড়িতে নহে খতম হবে
বাপদায় [৬] দিয়া ঘরে ফিরে যাও সবে।
নারী ভলান্তিয়ার সাথে মরদ আসে জুটি
পৃষ্ঠে বানধি ধনুক-তীর হস্তে মোটা লাঠি।।
সৈন্যের গাড়ির পিছে দেখা নাহি যায়
ট্রেঞ্চে খোঁড়ে কতক বীর গেরিলা কায়দায়
সম্মুখে জনতা দেখি সৈন্যের কাঁপে হিয়া
নিজ নিজ ঘরে সবে যাহরে ফিরিয়া
মুখে বলে এই বাত ট্রাক পিছায় ধীরে
গিড়িত [৭] করে পলো গাড়ি গাড়িয়ার [৮] ভিতরে।।
প্রমাদ গনিল সৈন্য জান বুঝি গেল্
সম্মুখে তীরের ফালা পিছনেতে খাল
ফায়ার ফায়ার বলি কাপ্তান ডুকুরিয়া উঠিল
অঙ্গো কাঁপে ঘন মুতে প্যান্ট ভিজে গেল।।
বত্রিশটা বন্দুকের গুলি ছোটে ঝাঁকে ঝাঁক
প্রলয়ের আগুনে যেন ছাইল ব্যাবাক।।
সাজিল কতেক সৈন্য মালকোচা সাটি
ঝাপটে নিল তীর-ধনুক কোদ্দে [৯] ঘোরায় লাঠি।।
ডিং ডিং ডিং ডিং তাং ধিতাং নাগরা মাদল রবে
সাজিল কৃষক সৈন্য ভয়ঙ্কর সবে
ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছোটে লাঠি বন বনে
জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য ভয় নাহি মনে।।
সামনে গুলি মারে সৈন্য পিছনে জমিদার
ছুটিল গেরিলা দল সময় নাহি আর।।
ছুটিল চিয়ারসাই হস্তে মোটা লাঠি
জোয়ান মর্দ বাপের ব্যাটা আটত্রিশ ইঞ্চি ছাতি
দোহাতিয়া [১০] বাড়ি মারে সৈন্যের মাথায়
বাপ ডাক ছাড়ি সৈন্য টলে পড়ে যায়।।
হঠাৎ লাগিল গুলি বাম বাঁহার [১১] পরে
ক্রোধ ভরে বাপের ব্যাটা যায় নিজ ঘরে
ঘর হাতে [১২] চিয়ারসাই শাবল এক আনি।।
।। ৩ ।।
সবলে ট্রাকের চাকা ফাটিতে লাগিল
আর এক গুলি চিয়ারসায়ের বুকে ফোটে
আনধার হৈল দুনিয়াদারি চেতন গেল টুটে
ক্ষণে অচেতন মর্দ ক্ষণেতে চেতন
লাফ দিয়া ট্রাকে ওঠে সিংহের মতন
দুশমনের গুলি ফের লাগিল কপালে।।
বেহুশ হৈল মর্দ রুহু [১৩] ছেড়ে দিল
অভিমানে মায়ের বুকে আছাড়ি পড়িল।।
চিয়ারসাই পোল দেখে ক্ষেপিল সকলে
দিশা নাই হুশ নাই মার মার বলে
লম্ফ দ্যায় কোন মর্দ কেহ হামাগুড়ি
অন্য কথা নাহি মুখে মার মার বুলি।।
মটোরের চাকা কেহ দুহাত দিয়া টানে
কেহ আঁছড়ায় কেহ কামড়ায় হুশ নাহি মনে
তীর ধনুক শাবল লাঠি হাসিয়া কুঠার
মারিছে সবাই দ্যাখ যা ছিল যাহার
কেহ ছোঁড়ে ঢিল এক অন্ধ ছিটায় বালি
মার মার মার খালি মার মার বুলি।।
বন্দুকের গুলি মুখে টিকিতে না পারে
একে একে বীরগণ ঢোলে ঢোলে পড়ে
তিনখানি ট্রাকের মধ্যে অচল করলো দুই
শহীদের রক্তে রাঙা হয়ে গেল ভূঁই
একে একে একুশ বীর জান ছেড়ে দিল
শহীদের রক্তে রাঙা লাল ঝাণ্ডা হলো।।
যুগ যুগের রুদ্ধ রাগ এই মত করে
ফাটিয়ে পড়িল ভাই ঐ না খাঁপুরে
এই খানেতে আমার জং গান সাঙ্গ হয়ে গেল
ইন্ কিলাব জিন্দাবাদ সবাই মুখে বল।।
______________________________