E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮

ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম

নির্মল কান্তি দাস


বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা, রাষ্ট্রভাষা। বাংলাভাষার ক্রমবিকাশ বৈচিত্র্যময়। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলাভাষার এগিয়ে চলার গতি হচ্ছে সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষায় বিজড়িত। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেতে বহু জীবন বলি দিতে হয়েছে, সংগ্রাম করতে হয়েছে অবিরাম। ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রতিবেশী দে‍শের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষাকে মাতৃভাষার মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপক সংখ্যক তরুণের যে আত্মাহুতি ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বাস্তবে বাংলাভাষাকে স্বীয় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাস এরও আগে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়, সেই মুহূর্ত থেকেই তার ধ্বংসের বীজ অন্তরে নিহিত ছিল। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকালে তার বিভিন্ন অং‍‌শের জনসাধারণের একমাত্র বন্ধনসূত্র ছিল মুসলিম লিগ নেতাদের সাম্প্রদায়িকতা। দেশভাগের পর থেকে প‍‌শ্চিম পাকিস্তানের শোষক ও শাসকশ্রেণি পূর্ব বাংলাকে জাতিগত শোষণের উদ্দেশে, বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ক্রীতদাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। এরই বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ওদেশের সাধারণ মানুষ।

তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে বারংবার ‘উর্দু’-ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ফরমান জারি করে। তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করেছে।

ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়েছে। এককথায়, সারা পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু বাঙালিদের মধ্যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের জন্ম হয়। এই প্রতিবাদ তদানীন্তন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই পরিস্থিতিতেও কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুব-মধ্যবিত্ত জনসাধারণ স্থানীয়ভাবে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনায় কিংবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঝে মাঝেই আন্দোলনে অগ্রসর হয়েছে এবং চরম নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বস্তুত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি’র অভ্যুত্থান পূর্ববাংলার চার বছরের জমাটবাঁধা বিক্ষোভেরই ব্যাপক বিস্ফোরণ। ছাত্রসমাজ ওইদিন সকালে সভাশেষে ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল শুরু করে। পাইকারিহারে পুলিশ প্রথমে তাদের গ্রেফতার করলেও পরে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ৩ জন ছাত্রসহ মোট ৪ জন (এঁদের নাম বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার) এবং ১৭ জন আহত ও ৫২জন গ্রেফতার হন। ধর্মভিত্তিক এবং সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে, যে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল, তারই পরিণতি ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ, একনায়কতন্ত্রী শাসনের অবসান - স্বাধীন, সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র বাংলাদেশের উত্থান। এটি এমন কোনো একটি বিশেষ জাতি বা দেশের কাহিনি নয়, এই আন্দোলন এখন মুক্তিপিয়াসী সকল জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের আলোকবর্তিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই চার শহিদকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে নির্মিত ‘শহিদ মিনার’-এ ১৯৫৫ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ হাজার হাজার মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৭২ সাল (‘বাংলাদেশ’ হওয়ার পর) থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি জাতীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। বি‍‌শিষ্ট কবি আব্দুল গফফর চৌধুরী’র আবেগমথিত ‘একুশের গান’ শীর্ষক কবিতাটি লোকের মুখে মুখে ফেরে।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...
আমি কি ভুলিতে পারি...
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি...
আমি কি ভুলিতে পারি...
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি...
আমি কি ভুলিতে পারি...


তাই ইউনেস্কো’র সাধারণ সম্মেলনের ৩০তম অধিবেশন ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছে - প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি সারা দেশে গুরুত্ব সহযোগে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। এই দিবসের ভাবনা হোক স্ব স্ব দেশীয় ভাষার উন্নয়ন, শান্তি এবং পুনর্মিলন। জীবনের বিভিন্ন স্তরে মাতৃভাষার তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং নিজের মাতৃভাষার জন্য গৌরবান্বিত হওয়া।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটা কিন্তু এমনি আসেনি। এসেছে বিশ্বের নিজস্ব প্রয়োজন থেকে, আর এই প্রয়োজনটা হলো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। পুঁজিবাদ চাইছে বিশ্বকে বৈচিত্র্যহীন করতে, মাতৃভাষা দিবস বলছে ‘‘না-তা হবে না’’। বিশ্ব এক নয় এখানে বহু জাতিসত্তা আছে, এই জাতিসত্তার ভিত্তি হচ্ছে মাতৃভাষা। তাই পুঁজিবাদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, উত্তরোত্তর মাতৃভাষার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার।

ইউনেস্কো’র সাধারণ সম্মেলনের ৩০তম অধিবেশন ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছে - প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি সারা দেশে গুরুত্ব সহযোগে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। এই দিবসের ভাবনা হোক স্ব স্ব দেশীয় ভাষার উন্নয়ন, শান্তি এবং পুনর্মিলন। জীবনের বিভিন্ন স্তরে মাতৃভাষার তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং নিজের মাতৃভাষার জন্য গৌরবান্বিত হওয়া।