৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮
‘‘আলবিদা ওয়াসিম ভাই’’
সমুদ্র গুহ
সারারাত ধরে ছবি এঁকেছিলেন। কাইফি আজমি’র প্রতিকৃতি, পরেরদিন চলে গেলেন। কাইফি আজমি’র নাম শুনলেই অনেকগুলো নাম পরপর ভাস্বর হয়ে ওঠে। সাজ্জাদ জহির, মুলকরাজ আনন্দ, সাদাত হোসেন মান্টো - বোম্বের আন্ধেরিতে তখন চলছে আইপিটিএ-র কেন্দ্রীয় স্কোয়াডের কাজকর্ম। একজন কমিউনিস্ট শিল্পীর দায়িত্ব নিয়ে সেখানে আছেন সর্বক্ষণের কর্মী কাইফি আজমি, রবিশঙ্কর থেকে চিত্তপ্রসাদ - কে নেই! তৈরি হচ্ছে ‘কল অব দ্য ড্রামস’ থেকে অনেক কিছু। গণনাট্য সংঘের সেই ঐতিহাসিক সময়গুলোর অন্যতম কারিগরের ছবি এঁকে পরেরদিন চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন অসাধারণ চিত্রকর ওয়াসিম কাপুর।
কলকাতার প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে ওনার দোতলার চমৎকার খানদানি ড্রইংরুমে কে আসেননি, তা নয়। সবাইকে আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করতেন স্বয়ং ওয়াসিম ভাই। দরাজ হাসি, বিনম্র ব্যবহার, চমৎকার বাংলা বলতে জানা মানুষটার আদি ঠিকানা কিন্তু লক্ষ্ণৌ। ‘‘যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী -’’ সেই বিখ্যাত গজল গানটির মতো উনি বা ওনার পরিবার লক্ষ্মৌ ছেড়ে কলকাতা মহানগরের ফ্রেমে বাঁধা পড়লেও, কোথায় যেন কথার টানে মিশেল ছিল।
যেটা বলতে উনি খুব গর্ববোধ করতেন। কেন? একটু পিছিয়ে যেতে হবে। সালটা ১৮৫৭। ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের রণধ্বনি বেজে উঠেছিল। যাকে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা নাম দিয়েছিল ‘সিপাহী যুদ্ধ’। পল্টনের আগুন জ্বলে উঠেছিল বারাকপুরে। অতি দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ল বিঠুর থেকে সাতানা, ঝাঁসি - একটার পর একটা জায়গায়। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের মানচিত্র দুলে উঠেছিল। অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল লক্ষ্মৌ, কানপুর, আগ্রা, বেরিলির ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট, সামরিক ছাউনিগুলো। কিন্তু এ লড়াই শুধুমাত্র ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান রেজিমেন্টগুলোর ছিল না, তামাম হিন্দুস্তানের পায়ের তলার শুকনোমুখো ঘাস জ্বলে উঠেছিল। রাজত্ব হারানো বাদশাহ থেকে রাজা উজির যেমন ছিল, তেমনি বারাণসির বারবনিতারাও ছিল। এই মুখোমুখি লড়াইতে শামিল ছিলেন ওয়াসিম কাপুরের তৎকালীন পূর্বপুরুষরাও। হাসতে হাসতেই বলতেন এই মহাসংগ্রামে ওনাদের ভূমিকা। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কথা।
ওনার সৃষ্টিসুখের উল্লাস সেই রক্তাক্ত মহাবিদ্রোহের চেতনার স্পর্ধায় তৈরি হয়েছিল কিনা, সেটা ওনার কাজগুলো দেখলে বোঝা যায়। যে ছবিটার জন্য উনি পৃথিবীখ্যাত হয়ে গেলেন, তা হলো যিশুখ্রিস্ট। যে যিশুকে নিয়ে অজস্র জগদ্বিখ্যাত ছবি, গল্প, কথন, মিথ, সিনেমা, কবিতা, উপন্যাস তৈরি হয়েছে; এবং তৈরি করেছেন অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো না ধরলেও শুধু ছবি আঁকাতেই কিংবদন্তীসম শিল্পীরা। শুধু চিত্রকরই নয়, শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে মাইকেল এঞ্জেলো হয়ে টিনটোরেট্টো, গিয়েটো, বার্নিনি - কে নয়। ইয়োরোপের চিত্রকলায় একটা অতি-বিশিষ্ট স্থান হলো যিশুখ্রিস্টের। তাহলে এসবের পর এ শহর কলকাতার ওয়াসিম কাপুর এত আলোচিত হয়ে উঠলেন কেন?
কারণ ছবিটিতে এমন একটা বেদনার মূচ্ছর্না ছিল - যা সারা পৃথিবীর গভীরতম দুঃখ জীবনের অনুভূতির সাথে মিলে গিয়েছিল। অনেকটা বিখ্যাত চিত্র পরিচালক ইলমাজ গুনের ফিল্ম ‘‘পুওরের’’ মতো। যা দেখলে মনে হয় দুনিয়ার সমস্ত গরিব একইরকম। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। দেখানো হয়েছিল আরেকরকম ভাবনা, সেটা হচ্ছে যিশুর নগ্ন দু’পায়ের ওপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো চলে যাওয়া একটা রঙের রেখাও। কীভাবে এই অদ্ভুত ধরনের রঙ তৈরি হয়েছিল, তা বলতে পারব না। কিন্তু রঙটা ঠিক কোন কালার বলতে পারা মুশকিল। না লাল না মেরুন, না সোনালির মিশ্রণ না কমলা - অথচ সবই আছে। এটাই ওনার স্বকীয়তা, নিজস্ব মেজাজ।
একইরকম একটা বিমূর্ত ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছিল ওনার আঁকা কৃষ্ণ কানহাইয়ার ছবিতে। শ্যামলা রঙের কিছুটা অস্পষ্ট কৃষ্ণের ঠোঁটে ধরা বাঁশিটা সোনালি রঙের। কিন্তু সারা ফ্রেম জোড়া ওই সোনালি বাঁশিটা সবার চোখ টানবেই। যেন পরিষ্কার বলছে, কৃষ্ণের জীবনের পরম সুহৃদ হচ্ছে ওই বাঁশি। যার ডাক শুনে আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধা চঞ্চলা হয়ে পড়েন।
মুম্বাই ফিল্ম জগতে বলিউডের সাতজন বিখ্যাত নায়িকার পোট্রেট আঁকলেন। মধুবালা, নার্গিশ থেকে অনেকে। অসাধারণ ওই চিত্রকল্প দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে নানান বিভঙ্গে সাজানো ফ্রেমের নায়িকারা আপনার দিকেই তাকিয়ে কিছু যেন বলছে। একটা গোপন ইশারা - যা আপনাকে মাতোয়ারা করে দিতে পারে। লিওনার্দোর আঁকা ‘‘মোনালিসা’’র সাথে তুলনায় যাবো না। ওটা মানবসভ্যতার অন্যতম সেরা আঁকা ছবি। সৌভাগ্য হয়েছিল প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে যাবার। মোনালিসার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল - মোনালিসা তাকিয়ে আছে হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোনখানে। অর্থাৎ সেই রহস্যময় ইশারা। নারী তুমি রহস্যময়ী এটা যেন ওয়াসিমভাইও ধরতে পেরেছিলেন তাঁর রূপকল্পনার গোপন কন্দরে। তাই শরীরের রূপটানকেও যেন ছাপিয়ে গিয়েছিল ওনার তুলির টান।
ওয়াসিম কাপুরের তুলিতে কমরেড জ্যোতি বসু। ২০১০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেশহিতৈষী’তে প্রকাশিত।
এই পরিবর্তনের কুৎসিত জমানাতেও বিধানসভায় রাখা আছে জ্যোতি বসুর পূর্ণাবয়ব ছবি, যা এতটাই অসাধারণ যে, দলমত নির্বিশেষে সকলকেই মুগ্ধ করে। বোধহয় বিকাশ ভট্টাচার্য চলে যাবার পর এ বাংলার সেরা পোট্রেট আঁকিয়ে ছিলেন ওয়াসিম কাপুর।
ছিলেন কথাটা লিখতে কষ্ট হয়। এই তো সেদিন ফোন করলেই পরিচিত গলা, সম্ভাষণ - ‘‘বলুন বলুন, কেমন আছেন’’। ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের নামকরা ডিরেক্টর অতুল বোস ছিলেন ওনার শিক্ষক। আর্ট কলেজে ভরতি হন একটু পরিণত বয়সে। কারণ ছোট্টবেলার ১২টা বছর কেটেছে নানার অসুস্থতার জন্য হাসপাতালের বিছানায়।
অতুল বসু হচ্ছেন এদেশের তেলরঙের ছবির ইতিহাসে অত্যন্ত বিখ্যাত চিত্রকর। এছাড়াও পোট্রেট করতেও ছিলেন দক্ষ। ওনার বিশেষত্ব ছিল ল্যান্ডস্কেপ পোট্রেট। ওয়াসিম কাপুরের পোট্রেট আঁকারও পাঠ অতুল বসুর কাছে। অতুল বসুর আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমেত অনেকের প্রতিকৃতি নিঃসন্দেহে স্মরণীয়। যা শিখেছিলেন শিক্ষকের কাছে, তাকে যেন আরও বলিষ্ঠ করলেন নিজস্ব ভাবনায়।
কাইফি আজমি। ওয়াসিম কাপুরের আঁকা সর্বশেষ ছবি।
বাবা সালেখ লক্ষ্মৌভি ছিলেন এই হিন্দুস্থানের অন্যতম সেরা উর্দু কবি। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, সাহির লুধিয়ানভি, গুলজার - সবার সাথেই ছিল এক অকৃত্রিম মহব্বত। কেন? কীভাবে এটা সম্ভব হলো। ওয়াসিম ভাইয়ের কথায় - এর অন্যতম মূল কারণ ১৯৩৬ সালে তৈরি প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘ, যা তৈরি হয়েছিল লক্ষ্মৌতে এবং ১৯৪৩ সালের গণনাট্য সংঘ। এঁরা সবাই ছিলেন এদেশের প্রগতিশীল বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একেকটা লড়াকু খিদমতগার। আন্দোলন লড়াইয়ে বৈধতা তাঁদেরকে কোনোদিনই পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। উনি সারাজীবনই তাই মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। এখন এই কথাটা কীভাবে বিচার করব।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে উত্তাল পশ্চিমবাংলা। অনেক নামী-দামী শিল্পী-সাহিত্যিক একজন দুজন নয় বেশ হুড়মুড় করেই ভিড়ে যাচ্ছেন ঘাসফুল আঙিনায়। বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করতেই হবে। সে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের অন্তর্ঘাতের লাইনই হোক কিংবা জঙ্গলমহলে মাওবাদী-তৃণমূল যৌথ তৎপরতায় কুপিয়ে খুন করাই হোক। প্রতিদিনই টিভির পর্দায়, সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যাচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের সুশীল সমাজের নানান নতুন কুর্দন। গ্রামসি তাঁর রচনাতে বলেছিলেনঃ প্রত্যেক সমাজব্যবস্থায় জৈব বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়। নয়া উদার অর্থনীতির শোষণযন্ত্রকে গতিশীল করতে হলে তার পথের বাধাগুলিকে নির্মূল করো। এই নির্মূল করার বিরোধিতা করে যে অসংখ্য মানুষ রাস্তার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন, তার অন্যতম ছিলেন বগলে ক্র্যাচ নিয়ে চলা শিল্পী ওয়াসিম কাপুর। চলে যেতে পারতেন অনায়াসে মহুয়া নিকেতনে অমৃতফলের সন্ধানে। না যাননি। যেমন যাননি ‘আকালের সন্ধানে’র মৃণাল সেন।
এখানেই একজন শিল্পীর রাজনৈতিক সত্তা স্পর্ধায় পরিণত হয়। স্রোতের বিপরীতে হাঁটার সাহস। চারপা হাঁটলেই বাজার-ধন্য পত্রিকার সদর দপ্তর। যার পাতা না পড়লে নাকি কী সব হয়! না ওনাকে এসব তুতো সংলাপ ভর করেনি। সস্তায় কিস্তিমাত করার কোনো দরকার হয়নি। তাই বাজারের সরাব গলিতে ব্রাত্যই থেকেছেন। কিছু এসে যায় নি। এক নির্মোহ দৃষ্টিতে ছবি এঁকে যাচ্ছেন ‘কলকাতার রিকশাওয়ালা’। সাদা-কালোয় আঁকা সে ছবির মধ্যে ছিল অচলায়তনকে ভাঙার মেজাজ।
যখনই কেউ বা কোনো সংগঠন ওনার কাছে গেছেন সাহায্যের জন্য, অকৃপণ হাতে হাত মিলিয়েছেন। প্রকৃত বন্ধুর মতো বিশ্বস্ত থেকেছেন। নিজেকে কখনও মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি।
আসলে চিত্রকর, প্রতিভাবান চিত্রকর হন অনেকেই। কিন্তু শিল্পী হন তখনই, যখন তাঁর সৃষ্টিতে এক নতুনত্ব, অভিনবত্ব আসে, যা সমসাময়িককালে এক অজানা সংকেতকে হাজির করে। ছবি, প্রতিকৃতি কতজনই না করেন। কিন্তু ওয়াসিম কাপুরের ফ্রেমে তৈরি হতো এমন কিছু সৃষ্টিশৈলী, যা ধরতে পেরেছিল চলতি হাওয়ার বিপরীতে মরণপণ লড়াইতে ব্যস্ত মানুষদের। সেটা কোন রঙে, কত নম্বর তুলিতে, কত ফুট কত ইঞ্চির ক্যানভাসে তৈরি হবে - তার জন্য কোনো যাদুকর দরকার হয়নি। দরবার যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন পিদিমের আলো সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখে একদিন দাবানল হবে বলে। আলেকজান্দ্রিয়া, কনস্তানতিনোপলের পতনের পর নেমে এসেছিল মধ্যযুগের অন্ধকার। কিন্তু কোনোরকমে হাতের কাছে যে কটা বই পাওয়া যায়, তাই নিয়ে যারা পালাতে পেরেছিলেন, সেই অবশিষ্ট জ্ঞানী-শিক্ষকরাই ইয়োরোপের আনাচে-কানাচে জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছিলেন শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নত চেতনা। সেদিন সেই কাজটা করতে পেরেছিলেন বলেই তৈরি হয়েছিল রেনেসাঁ।
একদিন আসবেই। যেদিন ধর্মীয় নিপীড়ন, স্বৈরাচারী কুশাসন, মুনাফার দাঁত-নখকে উপড়ে ফেলবে মানুষ। সেদিন সেই খেটে-খাওয়া মানুষের তাজা রক্তের মিছিল চ্যালেঞ্জ জানাবে অত্যাচারীর সাদা রক্তকে। আর সেদিন, একমাত্র সেদিনই ষোলোআনা কবরে শায়িত শিল্পী ওয়াসিম কাপুরকে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারব।