৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮
লাখো হৃদয়ে আকাশ প্রদীপ হয়ে রয়ে গেলেন লতা মঙ্গেশকর
বিশেষ প্রতিবেদনঃ জীবনকালেই যিনি কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন প্রয়াত হয়েছেন সেই লতা মঙ্গেশকর। গত ১১ জানুয়ারি তাঁকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছিল। বয়সজনিত অসুস্থতা সহ কোভিড আক্রান্ত হলেও সুস্থ হয়ে উঠছিলেন তিনি। নিউমোনিয়ার কারণেই ফের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। ভেন্টিলেটর সাপোর্টে থাকলেও অবস্থার অবনতি হতে থাকে শুক্রবার ৪ ফেব্রুয়ারি থেকেই। ২৭ দিন পর ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। এদিন সকালেই তাঁর মৃত্যু র খবর পেয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। অকৃতদার লতা মঙ্গেশকরের পরিবারে রয়েছেন তাঁর এক ভাই তিন বোন এবং তাঁদের পুত্র কন্যারা। মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্দোরে জন্ম হয় লতা মঙ্গেশকরের। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই বড়ো ছিলেন। লতা মঙ্গেশকরের বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর এবং মা সেবন্তীর প্রথম সন্তান লতা। তাঁর বাবা ছিলেন একাধারে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী এবং মারাঠি থিয়েটারের পরিচালক-অভিনেতা। তাঁর কাছেই ছোটো বয়স থেকে গানের তালিম নেন লতা মঙ্গেশকর ও তাঁর ভাইবোনেরা। ন’বছর বয়সে বাবার সঙ্গে প্রথম মঞ্চে অনুষ্ঠান। শোনা যায়, গান গেয়ে মঞ্চেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ছোট্ট লতা। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের গুরুদায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সি লতা মঙ্গেশকরের। শুরু হয় একই সাথে সঙ্গীতের তালিম নেওয়া এবং গান গেয়ে রোজগার। ১৯৪২ সালে মারাঠি ছবি কিটি হাসলি সিনেমায় প্রথমবার নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান করেন তিনি।
সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ায় প্রথমদিকে নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারেননি। বাবার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর নিজের রোজগারে প্রথম একটি রেডিয়ো কিনতে পেরেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এ প্রসঙ্গে পত্রপত্রিকা এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি, আর ভীষণ খিদে পেত আমার। তখন রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে ক্যান্টিন থাকত।... সারাদিনে এক কাপ চা আর দু-চারটে বিস্কুট খেয়েই কেটে যেত। এমনও দিন গেছে, যে দিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত - যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে। ...স্টুডিয়ো থেকে রেলস্টেশনে ফেরার সময় টাঙ্গা চড়ে না এসে সেই ভাড়া বাঁচিয়ে বাড়ির জন্য সবজি কিনে ফিরতাম আমি।’...
ক্লাসিকাল গান শেখার প্রবল আগ্রহ থাকলেও সেই পথে সংসারের চাপে বেশিদূর এগোনো হয়নি তাঁর। শোনা যায় তাঁর কণ্ঠসীমা তারসপ্তকে বিস্তৃত করার পেছনে কারণ ছিল মহম্মদ রফি সহ বিভিন্ন পুরুষ গায়কদের স্বভাবসিদ্ধ চড়া গলার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। কারণ ওই উঁচু স্কেলে গাইতে না পারার সঙ্গে কাজ না পাওয়ার অনিশ্চয়তা জুড়ে ছিল যে!
প্রচুর বই পড়তেন তিনি। অনুবাদে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের লেখা। একাধিকবার বলেওছেন যে শরৎচন্দ্র তাঁর প্রিয় লেখক। রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি অবলম্বনে ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবিতে প্রথম তার সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনায় গান গাওয়া। ভারতের সিনেমা জগতে নিউ ওয়েভ বা নব তরঙ্গ ধারার নজির গড়া ওই ছবিতে রাশিয়ার লালফৌজের সামরিক কুচকাওয়াজের বিখ্যাত গান মিডোল্যান্ড পলিনস্কুর অনুসরণে গান বেঁধেছিলেন সলিল চৌধুরী, ‘ধরতি কহে পুকার কে’। দেশজুড়ে ঝড় তুলেছিল সেই ছবি এবং ছবির গান। সলিল চৌধুরীর ঘরানার সঙ্গে যা যোগসূত্র গড়ে দেয় লতা মঙ্গেশকরের। এর আগেই অবশ্য মহল (১৯৪৯) ছবির ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গান এবং আনারকলি (১৯৫৩) ছবির গান তাকে বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে পায়ের তলায় মাটি শক্ত করে দিয়েছিল।
১৯৫৮ সালে বিমল রায় প্রোডাকশনস-এর ‘মধুমতি’ ছবির গানের জন্য লতা মঙ্গেশকর প্রথমবার ঐতিহ্যপূর্ণ ফিল্ম ফেয়ার প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড পান, যে ছবির সুরকার ছিলেন সলিল চৌধুরী। শোনা যায়, তার আগে নেপথ্য গায়ক গায়িকাদের জন্য কোনো পুরস্কারের বিভাগ না থাকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অ্যাওয়ার্ড ফাংশনগুলিতে লতা মঙ্গেশকর পারফর্ম করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার ফলশ্রুতিতেই এই বিভাগ চালু হয়। বহুবার সেরা গায়িকার পুরস্কার পাবার পর তিনি অবশ্য ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড আর নেবেন না বলেও জানিয়েছিলেন, এমন ছিল তাঁর উদারতা।
এরপর আর অনিশ্চয়তা ছিলনা তাঁর জীবন-জীবিকায়। অনিল বিশ্বাস থেকে মদন মোহন, শচীন দেববর্মণ, খৈয়াম, নৌশাদ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কল্যাণজি-আনন্দজি, রামচন্দ্রনের মতো অগুনতি পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন লতা। তারপর ষাটের দশকে লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল জুটি থেকে রাহুল দেব বর্মণ হয়ে নব্বইয়ের দশকে এ আর রহমান পর্যন্ত প্রায় ৭৩ বছর ধরে তাঁর সুর পরিক্রমায় সঙ্গীত পরিচালকরা তাঁকে দিয়ে গাইয়েছেন ৩০ হাজারেরও বেশি গান, কমবেশি ৩০টি ভাষায়।
সঙ্গীত পরিচালকরা তাঁদের যাবতীয় দুরূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য লতা মঙ্গেশকরকে বেছে নিয়েছেন এরকম নিদর্শন রয়েছে ভুরি ভুরি। প্রতিটিতেই নিজের সাবলীল গণ্ডির বাইরে গিয়ে বারবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি।
বাবার পরিচালিত নাটকে ছোটোবেলায় তার অভিনয়ের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে একাধিক সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন তিনি। তবে অভিনয় তার প্রথম পছন্দ নয় তা জানিয়ে দিয়েছেন বহুবার। কিন্তু সিনেমার গানের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী তাঁর কন্ঠ প্রক্ষেপণে গানকে অভিনয়ের ভাষায় উত্তরণ ঘটাতেন। এমনভাবে গাইতেন যে, অভিনেত্রীদের সেই গানে আবেগ ফুটিয়ে তোলা সহজ হয়ে যেত। তবে তাঁর গানের লিরিক থেকে দৃশ্যায়ন কেমন হবে সে সম্পর্কে তাঁর খুব সজাগ দৃষ্টি এবং ভূমিকা ছিল।
ভিন্ন প্রজন্মের সুরকারদের ভিন্ন ধারার কম্পোজিশন রপ্ত করে গান গাইবার জন্য নিজেকে বারবার ভেঙেচুরে সমস্ত রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে তৈরি করেছেন, সঠিক উচ্চারণের জন্য ভাষা চর্চা করেছেন। তর্কাতীতভাবে দর্শক শ্রোতার পছন্দের সেরা গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। সাফল্যের জন্য বেছে নেননি কোনও সহজ রাস্তা। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত থেকে লোকগানের আঙ্গিক সহ সমস্ত দেশজ প্রকরণ তাঁর অধীত ছিল। তাই চল্লিশের দশকের সানুনাসিক তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গাইতে অভ্যস্ত থাকা গায়কদের সঙ্গে গাওয়া শুরু করেও পরবর্তীতে তিনি গায়কিতে আধুনিকতা এনে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন নিজেকে। তাই দেশভাগের আগে থেকে গাইতে শুরু করেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েও নেপথ্য গায়িকা হিসেবে তাঁর স্থান অনন্য ছিল।
পরাধীন ভারত তার ঔপনিবেশিক জড়তা নিয়ে স্বাধীনতার পর যখন স্বনির্ভরতার দিকে পা বাড়াচ্ছিল, ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ আভিজাত্যের পীঠস্থান লন্ডনের রয়াল অ্যালবার্ট হলে ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় সংগীত শিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠান করে ঘা দেন ব্রিটিশ অহমিকায়।
অনেকেই জানেন না, ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন তিনি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বার বার যখন ‘আনন্দ ঘন’ নামের কাউকে ডাকা হচ্ছিল, ডকুমেন্ট বলছিল তিনি এখানে উপস্থিত, কিন্তু কেউ পুরস্কার নিতে উঠছিল না স্টেজে। অবশেষে লতা উঠে পুরস্কার নেন। মারাঠি চলচ্চিত্রের রহস্যময় সঙ্গীত পরিচালক আনন্দ ঘন-র রহস্য এ ভাবেই সবার সামনে আসে।
সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘...সলিলদা বোম্বেতে ইয়ুথ কয়্যার যখন তৈরি করলেন তখন লতাজি তাতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে প্রচণ্ড ব্যস্ততা ছিল তাঁর। সময় পাওয়াটাই তখন মুশকিল ছিল তাঁর। ফলে নিয়মিত অনুষ্ঠানে আসবেন তা সম্ভব ছিল না। ...ষাটের দশকে খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা অবস্থায় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের একটি গানের কোরাসে গলা মিলিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর - যা ভাবাই যায় না।
সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র লতা মঙ্গেশকরের সাংগীতিক ক্ষমতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, খুব উঁচুদরের কম্পোজিশন নয় এমন গানকেও তিনি অবিশ্বাস্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন।
কল্যাণ সেন বরাট লতা মঙ্গেশকরের গান সম্পর্কে বলেছেন, সলিল চৌধুরী সবসময়ই গানে একটা গণমুখী বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। লতাজি সেটা উপলব্ধি করে নিজের গায়কীতে তা ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণভাবে। শুধু মিষ্টত্ব নয়, ভাবে অনুভবে আমরা পেয়েছিলাম সেটাই।
এ প্রসঙ্গে বাংলা মৌলিক বা বেসিক গানে লতা মঙ্গেশকরের সাফল্যের কথা উল্লেখ করা যায়। সাত ভাই চম্পা জাগো রে জাগো রে’র রূপকথার অণুষঙ্গ থেকে সত্তরের দশকের আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের... মতো গানগুলি কার্যত গণসঙ্গীতের ঐতিহ্য এবং বক্তব্যকেই বহন করেও জনপ্রিয়।
তাঁর কৃতি ভাইবোনদের মধ্যে রয়েছেন মীনা, আশা, ঊষা এবং হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। তাঁর গাওয়া গান সমৃদ্ধ ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে বৈজু বাওরা, মাদার ইন্ডিয়া, বরসাত, শ্রী ৪২০, দেবদাস প্রভৃতি।
২০০১ সালে তাঁকে ভারতরত্ন পুরস্কার দেওয়া হয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে দেওয়া হয় ১৯৮৯ সালে। ২০০৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাকে লিজিয়ন অব অনার পুরস্কারে ভূষিত করেন।
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সহ দেশের অন্যান্য নেতৃবর্গ এবং বিশিষ্টজনেরা।
তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও তিনি কখনও এড়িয়ে যাননি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ ফুটে উঠেছে বিভিন্ন জায়গায়, যা তার অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করে। একটি সাক্ষাৎকারে ২০২১ সালে তিনি বলেছেন, ‘সত্যি বলতে আমার মনে বড়ো দুঃখ। আমাদের দেশে এত বিভাজন। মানুষ বেশি বেশি করে আমি হিন্দু ও মুসলমান এই ভাবনায় ঢুকে যাচ্ছেন। সন্দেহ ও শত্রুতার এই পরিবেশের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে।’