৫৮ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১১ জুন, ২০২১ / ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
বিরোধীদের দাবি ও আদালতের তীব্র সমালোচনার জেরে বিনামূল্যে টিকার ঘোষণা কেন্দ্রের
বেসরকারি ক্ষেত্রের বরাদ্দ বাতিল ও সর্বজনীন গণটিকাকরণের দাবি সিপিআই(এম)’র
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বিভিন্ন রাজ্য ও রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ ও দাবিতে এবং সুপ্রিম কোর্টের তীব্র সমালোচনার জেরে শেষ পর্যন্ত বিনামূল্যে টিকাকরণের কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আঠারো বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিকের ৭৫ শতাংশকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হবে। আগামী ২১ জুন থেকে এই ব্যবস্থা চালু হবে বলে জানিয়েছেন। তবে বেসরকারি ক্ষেত্রের টিকাকরণের বরাদ্দ কমাননি তিনি। বলেছেন, উৎপাদনের ২৫ শতাংশ টিকা বেসরকারি ক্ষেত্রকেই দেওয়া হবে। তার জন্য দাম দিতে হবে নাগরিকদের। গত ৭ জুন এই ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য ২৫ শতাংশ করোনা টিকা বরাদ্দের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। সেইসঙ্গে বিনামূল্যে সর্বজনীন, গণটিকাকরণ অভিযান চালুর দাবি জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। ৮ জুন এক বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো বলেছে, রাজ্যগুলির তীব্র বিরোধিতা, চাপ এবং সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনার মুখে মোদী সরকার তার ভ্রান্ত ও বিপর্যয়কর 'মুক্ত টিকা নীতি' প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। সমস্ত নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে টিকা প্রদানের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সম্প্রচারের মাধ্যমে ভাষণে যেভাবে রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এবং এই দায়িত্ব চাপানোর যে নিন্দনীয় প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তাও মানুষ প্রত্যাখ্যান করবেন। কারণ এই 'মুক্ত টিকা নীতি' কেন্দ্রীয় সরকারের এক তরফা সিদ্ধান্ত ছিল।
পলিট ব্যুরো বলেছে, তবে ব্যর্থ টিকা নীতি পুরোপুরি পরিবর্তন করেনি কেন্দ্রের সরকার। বরং করোনা টিকার দ্বৈত মূল্য নীতি চালিয়ে যেতে চাইছে। এখনও উৎপাদিত টিকার ২৫ শতাংশ বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এটা বেসরকারি উৎপাদনকারীদের অতি মুনাফার জন্য লুটপাটের লাইসেন্স দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। টিকার তীব্র আকালের মধ্যে কেন্দ্রের এই নীতি করোনা ভাইরাসের তৃতীয় তরঙ্গ প্রতিরোধে সর্বজনীন টিকাকরণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগকে গুরুত্বহীন ও দুর্বল করবে। সরকারের অনুমতির ভিত্তিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে টিকার যে অত্যধিক দাম হবে, তা কেবল ধনী ব্যক্তিরাই বহন করতে পারবেন।
বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য ২৫ শতাংশ টিকা সংরক্ষণের নীতি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। পলিট ব্যুরো দাবি জানিয়েছে, ভারতে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে কেনা সমস্ত টিকা কেন্দ্রীয় সরকারকেই সংগ্রহ করতে হবে। রাজ্যগুলির সাথে আলোচনার ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকেই বণ্টন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, সিপিআই(এম) সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের উদ্যোগ নেওয়া সহ রাজ্যগুলিকে টিকা কিনতে বাধ্য করার নীতি থেকে সরে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেয় কেরালা সরকার। তারা এই মর্মে বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবও পাশ করে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এগারোটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে একযোগে সরব হবার হওয়ার আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠান। রাজ্যগুলোকে বিনামূল্যে টিকা সরবরাহের জন্য অনেক মুখ্যমন্ত্রীই সোচ্চার হন। এমনকী কেন্দ্রের অন্যতম শরিক, বিজেপি ঘনিষ্ঠ ওডিশার বিজেডি এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রীরাও সরব হন। এ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে মামলাও হয়েছে। ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (এসএফআই) বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের নির্দেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। সিপিআই(এম) সাংসদ এবং আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যও এ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন।
এর আগেই সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে তাদের টিকাকরণ নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বলেছিল। একই সঙ্গে বয়সের ভিত্তিতে টিকার দাম নির্ধারণ নিয়ে কেন্দ্রের নীতির সমালোচনা করেছিল শীর্ষ আদালত। ৪৫ ঊর্ধ্ব দেশবাসীকে বিনামূল্যে টিকাকরণ এবং তার কম বয়সিদের দাম দিয়ে টিকা দেওয়ার নীতিকে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের 'খামখেয়ালি' এবং 'অযৌক্তিকতা'য় ভরা বলে সমালোচনা করেছিল। এমনকী সুপ্রিম কোর্ট টিকাকরণের যাবতীয় হিসাবনিকেশ চেয়ে পাঠিয়েছিল কেন্দ্রের কাছ থেকে। এমনই একটা পরিস্থিতিতে ৭ জুন হঠাৎই প্রধানমন্ত্রী এক ভাষণে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সকলের টিকা কেন্দ্রই কিনে রাজ্যগুলিকে নিখরচায় দেবার কথা ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে করোনা সংক্রমণের প্রতিরোধে গণটিকাকরণ কর্মসূচি চালু হয়। তখন কেন্দ্রই সব টিকা সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল। উৎপাদনে যুক্ত করা হয়েছিল সিরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেক - কেবল এই দু'টি বেসরকারি সংস্থাকে। এপ্রিল মাসে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে সংক্রমণের তীব্রতা শুরু হবার সময় থেকেই টিকা জোগান কমে যেতে দেখা যায়। আবার এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে টিকাকরণ কমে যেতে থাকে। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে 'উদার টিকা নীতি' ঘোষণা করে কেন্দ্র। বলা হয়, উৎপাদনের ৫০ শতাংশ টিকা ওই দুই বেসরকারি সংস্থা সরাসরি কেন্দ্রকে বিক্রি করবে নির্ধারিত দামে। ২৫ শতাংশ সংস্থা দু'টির কাছ থেকে সরাসরি কিনবে রাজ্য। রাজ্যকে বিক্রির জন্য বাড়তি দাম ঘোষণা করতে দেওয়া হয় দুই বেসরকারি সংস্থাকে। বাকি ২৫ শতাংশ রাখা হয় বেসরকারি ক্ষেত্রে টিকাকরণের জন্য। কেন্দ্রের এই নীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এরপরই কেন্দ্র বিনামূল্যে টিকাকরণের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
তবে মোদী এই ঘোষণা করলেও নিজের অপদার্থতা ঢাকতে বড়াই করতে পিছপা হননি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে যাবতীয় সাফল্য নিজের ঝুলিতে নিয়ে সব 'ব্যর্থতা' রাজ্যগুলির উপরে ঠেলে দিতে কসুর করেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম)'র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, অজুহাত ছেড়ে কেন্দ্র বরং আন্তরিকতার সঙ্গে বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণটা করুক। একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, যখন দেশের মানুষ জীবন দিয়ে খেসারত দিচ্ছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি-কে অবশ্যই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করা শিখতে হবে। তিনি বলেছেন, বিতর্কিত টিকা নীতি আড়ালের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন মোদী। রাজ্যগুলির ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকার ভয়ে পিছিয়েছেন তিনি।
কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, রাজ্যগুলিকে বিনামূল্যে টিকা সরবরাহের দাবি জানিয়েছিল কেরালা। প্রধানমন্ত্রী সেই দাবি মেনে নিয়েছেন। কঠিন সময়ে সেই সিদ্ধান্ত জরুরি ছিল।
এদিকে সকলের জন্য বিনামূল্যে টিকার দাবিতে আন্দোলনে জয়ের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছে এসএফআই। গত ৭ জুন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের নির্দেশিকা জারির মাধ্যমে আইনি হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে ১০ মে, ২০২১ সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন জানানো হয়েছিল। ওই আবেদনের কথা বিবেচনা করে শীর্ষ আদালত সরকারকে তার টিকা নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বলেছে।
সুপ্রিম কোর্টে আবেদনে এসএফআই অভিযোগ তুলেছিল, কেন্দ্রের নীতি যে কেবল রাজ্যগুলির মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছে তাই নয়, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সি নাগরিকদের বিনামূল্যে টিকা গ্রহণের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করছে। জনগণের চাপ এবং আদালতের পর্যবেক্ষণের জেরে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয়েছে মোদী সরকার। এটি একটি বড়ো যুদ্ধ জয় বলে মন্তব্য করেছে এসএফআই। একইসঙ্গে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ত্রুটিপূর্ণ নীতির দায় রাজ্য সরকারগুলির উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, রাজ্যগুলি নাকি এই নীতি চেয়েছিল! তাঁর এই কথা আদৌ সত্যি নয়। বরং বিরোধী দলগুলি পরিচালিত প্রতিটি রাজ্য সরকার কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে টিকা দাবি করে চিঠি দিয়েছিল। কেবল বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলিই কেন্দ্রের নীতিতে সায় দিয়েছিল। সুতরাং এই বিপর্যয়কর এবং ত্রুটিপূর্ণ নীতিটি যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের মস্তিষ্কপ্রসূত, তা খুবই স্পষ্ট। তবে নয়া নীতিতেও কেন্দ্র যেভাবে ২৫ শতাংশ টিকা বেসরকারি সংস্থার হাতে দেওয়ার ঘোষণা করেছে, তারও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এসএফআই। তারা বলেছে, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সারা দেশে টিকা বণ্টনে সমতা থাকবে না। কারণ বড়ো বড়ো বেসরকারি সংস্থাগুলি মূলত মেট্রোপলিটন শহরে থাকায় বিপুল পরিমাণে টিকা সেখানেই কেন্দ্রীভূত হবে। বঞ্চিত হবেন দেশের শ্রমজীবী গরিব মানুষই। তাই বেসরকারি সংস্থার হাতে করোনা টিকা তুলে দেবার নীতি পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে এসএফআই।