E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১১ জুন, ২০২১ / ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

চিরবিদায় চলচ্চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বিদায় নিলেন বাংলা ও ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক ব্যতিক্রমী বিশিষ্ট পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। কবিতা থেকে সিনেমায় একই মসৃণতায় সৃজনের অনন্য উদাহরণ রেখে বিদায় নিলেন ৭৭বছর বয়সে। কিডনির অসুখে অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘ সময়। ১০ জুন, বৃহস্পতিবার ভোরে তাঁর জীবনাবসান হয়। নিজের বাড়ি হালতুর কালিকাপুরে ঘুমের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ‘দূরত্ব’ থেকে ‘স্বপ্নের দিন’, দাশগুপ্তের নির্মাণে উঠে আসা ভাঙাচোরা সমাজ, ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা এবং শ্রেণির সংঘাত সমকালীন থেকে চিরকালীন হয়ে রয়ে গেল।

এদিন তাঁর জীবনাবসানের খবরে চলচ্চিত্র মহলে গভীর শোকের আবহ তৈরি হয়। শোক জ্ঞাপন করেছেন সমাজের অন্য অংশের মানুষও। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র তাঁর প্রয়াণে শোক জানিয়ে বলেছেন, সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যে তিনি অমর থাকবেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর বাড়ি যান সিপিআই(এম) নেতা মৃদুল দে, রবীন দেব, এসএফআই নেতা সৃজন ভট্টাচার্য। প্রয়াত দাশগুপ্তের স্ত্রী, কন্যা রয়েছেন। এদিনই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

তিনি ১৯৪৪ সালে জন্মেছিলেন পুরুলিয়ায়। তাঁর পিতা ছিলেন রেলে কর্মরত চিকিৎসক। বুদ্ধদেবের ১২ বছর বয়সেই তিনি চলে আসেন কলকাতায়। কিন্তু পুরুলিয়া, বীরভূমের লাল মাটির মায়া কাটাতে পারেননি কোনোদিন। তাঁর চলচ্চিত্রে বারবার ফিরে এসেছে সেই দৃশ্যপট। ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। পরে বর্ধমানের শ্যামসুন্দর কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটি কলেজে অধ্যাপনাও করেছেন। কিন্তু সিনেমার প্রতি অমোঘ টান একসময় তাঁকে জীবনের পথ বদলাতে বাধ্য করে। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর গভীর পরিচয় ঘটিয়ে দেয়।

সত্যজিৎ রায়-মৃণাল সেন-ঋত্বিক ঘটকের পূর্ণগগনেই ১৯৭৮-এ বুদ্ধদেবের ‘দূরত্ব’। সাতের দশকের উত্তাল কলকাতা, রাজনৈতিক টানাপড়েন ও ব্যক্তিসম্পর্কের জটিলতার সেই ছবি দেখেই দর্শক বোঝেন এক যোগ্য উত্তরাধিকার এসে গিয়েছেন। এই ছবি তাঁকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও পরিচিতিও এনে দেয়। দ্বিতীয় ছবি ‘নিম অন্নপূর্ণা’ এক দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের শহরে এসে বাঁচার চেষ্টার গল্প। আলো-রঙে এই ছবিকে ঘিরে রেখেছে এক অম্লান বিষাদ। ‘গৃহযুদ্ধ’ নিয়ে চলে যায় শ্রেণির যুদ্ধের মধ্যিখানে, কার কোন্ নৈতিক অবস্থান হবে, সেই প্রশ্নকে ঘিরে আবর্তিত হয়। ‘বাঘ বাহাদুর’-এ ঘুনুরাম লোকনৃত্যে বাঘ সাজে কিন্তু সার্কাস দলের সত্যিকারের বাঘের মুখে সে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এই ছবি জনপ্রিয়তা পায়।

বুদ্ধদেবের ছবি স্বস্তি দেবার জন্য ছিল না। বিনোদন তো নয়ই। ‘তাহাদের কথা’, ‘ফেরা’, ‘লাল দরজা’, ‘উত্তরা’, ‘কালপুরুষ’, ‘স্বপ্নের দিন’, ‘জানালা’, ‘চরাচর’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘উড়োজাহাজ’-এর কোনোটিতে লিরিক-ভাষা, কোনোটিতে পরাবাস্তবতা। অনেক পর্যবেক্ষকই বলেন, সমান্তরাল ভারতীয় ছবির এই অগ্রণী পরিচালকের ছবিতে জাদু বাস্তবতা দেখেছে ভারতীয় সিনেমা। তাঁর চরিত্ররা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, হয়ত কিছুটা অসংলগ্ন, জীবনের বৃত্ত বারবার ভেঙে যেতে থাকে। নিজেই বলেছিলেন, জীবনানন্দ বা নিজের কবিতা থেকে একটি ছবি বানানোর ইচ্ছা ছিল।

মোট পাঁচটি ছবি সেরা ছবির জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। ‘উত্তরা’, ‘স্বপ্নের দিন’-এর জন্যপেয়েছেন সেরা পরিচালকের পুরস্কার। ‘উত্তরা’-র জন্য ভেনিসে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বহুবার পেয়েছেন সেরা ছবির মনোনয়ন এবং ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড। দুটি হিন্দি ছবি ‘আন্ধি গলি’, ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’।

একাধিক তথ্যচিত্রও করেছিলেন তিনি। ক্ষীরোদ নট্ট ও সুন্দরবন নিয়ে তাঁর তথ্যচিত্র বিশিষ্টতা পেয়েছে।

কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত হয়তো খানিকটা আড়াল হয়েছেন সিনেমার বুদ্ধদেবের কাছে। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে গভীর আড়ালে, কফিন কিংবা সুটকেস, হিমযুগ, রোবটের গান, বেঁচে থাকা জিন্দাবাদ।

এদিন তাঁর জীবনাবসানে শোক জ্ঞাপন করেছেন মমতাশঙ্কর, দীপ্তি নাভাল, শঙ্কর চক্রবর্তী, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, পাওলি দাম, সুদীপ্তা চক্রবর্তী প্রমুখ তাঁর ছবিতে অভিনয় করা শিল্পীরা।

কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-র পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে।