E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১১ জুন, ২০২১ / ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

আর্থিক সঙ্কটকালে দেশের মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই

ঈশিতা মুখার্জি


আমাদের দেশের আর্থিক সঙ্কট সারা বিশ্বে আজ আলোচিত। যতই মোদী সরকার বলুক না কেন যে, দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার বিপজ্জনক হলেও তা আগামীদিনে আশার আলো দেখাবে, এ কথা কোনো অর্থনীতিবিদ মানতে রাজি না। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা এই আর্থিক বিপর্যয় নিয়ে যা বলছেন তার বিপরীতে গিয়ে কথা বলছেন দেশের অর্থমন্ত্রী। এটাই হলো ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির বিপদ - ক্রমাগতই সত্যকে অস্বীকার করে সজোরে মিথ্যা নির্মাণ, উত্তর সত্য নির্মাণে চেষ্টা হয়। সেটাই হচ্ছে আমাদের দেশে।

২০২০ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ যোশেফ স্টিগ্লিটস দেশের বণিক সম্প্রদায় আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বলেন যে, মোদীর আর্থিক নীতি ভুল। মোদী সরকারের করোনা মোকাবিলা নীতিও ভুল বলে তিনি মনে করেন। দেশে অতি ধনীর অভাব নেই। কোটিপতিরা এই করোনার মধ্যেও তাঁদের সম্পদ বাড়িয়েছেন। তাই তিনি মনে করেছিলেন যে, সরকারের উচিত তাঁদের উপর কর আরোপ করে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়িয়ে দেশের মানুষের হাতে দেওয়া। এইভাবে দেশের গরিব ও সাধারণ মানুষের হাতে টাকা আসবে। আর্থিকভাবে একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখবে এই পরিবারগুলি। তাঁদের চাহিদা বাড়বে, ফলে সেই চাহিদা মেটানোর জন্য উৎপাদন বাড়বে। এটি আদতে হলো এক কেনসিয় নীতি বেকারি ও মন্দা মোকাবিলা করার জন্য যা অতীতে মহামন্দার সময়ে গ্রহণ করা হয়েছিল। স্টিগ্লিটসের মতে এটি ছিল ভারতের মতো দেশে আদর্শ পথ। তিনি সরকারের আত্মনির্ভরতার স্লোগানকেও কটাক্ষ করেন। ২০২০-২১ সালে দাঁড়িয়ে এই কথার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই - তিনি একথা মনে করেছিলেন। আজ যখন কেনিয়া আমাদের দেশকে করোনার টিকা দিয়ে সাহায্য করবে বলে, তখন এই উক্তি আমাদের মনে পড়ে। তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি অতিমারী মোকাবিলা করতে পারেনি - উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত। আজ আমরা দেখি যে ওনার আশঙ্কাগুলি কত সত্যি ছিল।

২০২১ সালের মার্চ মাসে দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক আলোচনাসভায় অন্য একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রগম্যান বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য এত বেড়ে গেছে যে এই অবস্থায় দেশে আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। এই এপ্রিল মাসেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেন, এখন দেশে স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড়ো অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা চলছে। দেশের গরিব মানুষের কথা মাথায় না রাখলে দেশের আর্থিক উন্নতি সম্ভব নয়। গরিব মানুষ সহজেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বেন, যে ঋণ তাঁরা শোধ দিতে পারবেন না। এতে আদৌ দেশের আর্থিক সুরাহা হবে না। তাই রাষ্ট্রকে গরিব মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে। গরিব মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে রাষ্ট্রকে। এটা খুবই দুঃখের। তিনি মনে করেন যে, যেভাবে নোটবন্দি আর পণ্য পরিষেবা কর নিয়ে দেশের মানুষের হেনস্তা হয়েছিল, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল। দেশের প্রাক্তন অর্থনৈতিক প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক কৌশিক বসু একটি তালিকা প্রকাশ করেন বিভিন্ন দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার এবং করোনা মোকাবিলার হার সম্পর্কিত। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশ জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলির চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাতেও এই দেশগুলির চেয়ে পিছিয়ে ভারত। ভারতের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তো প্রকাশ্যেই মোদিীর নীতির সমালোচনা করেছেন।

যাঁরা সমালোচনা করেছেন তাঁরা কেউই বামপন্থী অর্থনীতিবিদ নন বা কেউই নয়া উদারিকরণ বা বাজার অর্থনীতির সোচ্চার বিরোধী নন। তাঁরা ভারত বিদ্বেষীও নন। তাহলে সবাই গড়ে এক কথা বলছেন কেন? করোনা মোকাবিলা করার সময় সারা পৃথিবীতে বাজার অর্থনীতির একছত্র আধিপত্য প্রশ্নের সামনে পড়েছে। পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও রাষ্ট্রের গুরুত্ব বেড়ে স্পেন তাঁর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে জাতীয়করণ করল করোনা মোকাবিলা করার জন্য। নতুন করে সরকারের ব্যয়বরাদ্দের গুরুত্ব বুঝতে পারছে এই দেশগুলি। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এগুলিকে সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে না বেসরকারি সংস্থাগুলি। করোনা অতিমারী পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ কদর্য রূপ চোখেরসামনে এনে দিয়েছে।

ভারতের মতো একটি দেশের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে পৃথিবীতে। ভারতের অর্থনীতি বিপন্ন হলে তা সারা বিশ্বে প্রভাব ফেলবে, তাই আজ সারা বিশ্ব চিন্তিত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী কী সেই পরিমাণ চিন্তিত? এখানেই ধন্ধ।

মোদী যে দেশের মানুষের, বিশেষকরে গরিব মানুষের সম্পর্কে কোনো তথ্য বা খবর পাননি তা তো নয়। রাষ্ট্রসংঘ তো প্রতি বছর মানবোন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০২০ সালের সেই রিপোর্টে আছে যে, মানবোন্নয়ন সূচকে ভারতের স্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩১। প্রতি বছর এই স্থান নেমে যাচ্ছে। ভারত এর ফলে মাঝারি উন্নয়নশীল দেশ বলে ঘোষিত হলো। আরও নিচে নামলে সবচেয়ে কম উন্নয়নশীল দেশ বা উপ-সাহারা গোষ্ঠীর দেশগুলির সমগোত্রীয় হয়ে যাবে। আমাদের দেশের কী এই পরিণতি অনিবার্য ছিল না তাকে এই স্থানে দেশের শাসক মোদীর সরকার ঠেলে দিল, এ কথা আজ দেশের মানুষের বলবার সময়। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অশিক্ষা বাড়ছে। স্বাস্থ্যে বেহাল দশা বললেও কম বলা হয়। অপুষ্টি বাড়ছে। মহিলাদের প্রতি শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বৈষম্য বাড়ছে। এগুলি সবকিছুই পিছিয়েপড়া অর্থনীতির লক্ষণ। বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪। বলা যেতেই পারে, এ দেশে মানুষের ক্ষুধা মেটানো যায় না। তাই দেশে অপুষ্টি ব্যাপ্তি লাভ করেছে যদিও দেশের গুদামে খাদ্যশস্য রয়েছে। বেকারি রেকর্ড পরিমাণে দাঁড়িয়ে আছে।

বিশ্বের মধ্যে অপুষ্টি আর ক্ষুধায় ভারতের মতো দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন । ২০১৯ সালেই অর্থাৎ করোনা অতিমারীর আগেই ১৯ কোটি দেশবাসী অভুক্ত থাকার খবর ছিল। অভুক্ত শিশু, অ্যানিমিয়ায় ভোগা বেশিরভাগ মহিলা, না খেতে পেয়ে মৃত্যু - এটাই এখন দেশের চেহারা। বিহার, ওডিশার থেকে অনাহারে মৃত্যুর খবর থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গেও একই চিত্র আমরা দেখতে পাই। অন্নসংস্থান নেই - আত্মহত্যা বাড়ছে। লকডাউনে এই আত্মহত্যার ঘটনা বিরল নয়, যদিও সব খবর সামনে আসে না।

এই পরিস্থিতিতে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলগুলি প্রথম থেকে দাবি করে আসছিল যে, সরকারের এখুনি উচিত আয়করের আওতায় নেই এইরকম পরিবারগুলির কাছে সরাসরি ৭৫০০ টাকা দেওয়া। দাবি এও ছিল যে, গুদামে মজুত খাদ্যশস্য ভাণ্ডার থেকে পরিবারগুলির কাছে রেশনের ব্যবস্থা করা, দাবি এও ছিল বিনামূল্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টীকা দান কর্মসূচি রূপায়িত করা। এর কোনটাই আজ এক বছরে করা গেল না। মোদী সরকার কোনভাবেই কী এই দায় এড়াতে পারে? অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় একসাথেই দেশের উপর আছড়ে পড়ল। এর ফল ভুগছে আজ দেশের কোটি কোটি মানুষ। সিএমআইই’র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, ২০২১ সালের মে মাসেই বেকারি ছিল প্রায় ১২%। শহরে বেকারির হারও তেমনই ছিল। দেশের মধ্যে কারখানাগুলি থেকে শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত। কারখানাজাত উৎপাদন গত দশ বছরে সর্বনিম্ন। অনাহার, বেকারি দিয়ে দেশের কোন্ উন্নতির কথা বলছেন মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী। মানুষের এই চাহিদাগুলি বা এই বাবদ সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি একমাত্র পথ দেশের সামনে। এই বিষয়ে কিভাবে অন্য মত থাকতে পারে, তা আজ বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের কাছে বিস্ময়। দেশের মানুষের কল্যাণ সাধনের রাজনীতি থেকে সরে আসতে আসতে ভারত আজ এক বিধ্বংসী জায়গায় পৌঁছে গেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, ওদিকে মোদী দেয়ালটাই ভেঙে দিচ্ছেন তাঁর ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির পথ ধরে। ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের কথাই বলে, ভারতের ক্ষেত্রেও সেই অভিজ্ঞতা আমাদের হচ্ছে। বিকল্প আর্থিক নীতি নিয়ে গণআন্দোলনের তো এখনই সময়।