E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১১ জুন, ২০২১ / ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে সঙ্কটে অর্থনীতি, নির্বিকার সরকার

অর্ণব ভট্টাচার্য


সম্প্রতি বিভিন্ন সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে যে, ভারতের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-র দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়েছে। অথচ কয়েক মাস আগে যখন কোভিড অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রথম লক্ষণ দেখা দিয়েছিল তখন এমন পূর্বাভাস শোনা গিয়েছিল যে, অর্থনীতিতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব প্রথম ঢেউয়ের মতো মারাত্মক হবে না, কেননা দেশে নাকি ভ্যাকসিনের জোগান আছে এবং দেশজুড়ে লকডাউন চালু করার কোনো ভাবনা সরকারের নেই। কিন্তু কোভিড-১৯-র দ্বিতীয় ঢেউ যখন সারাদেশে আছড়ে পড়ল তখন দেখা গেল যে, সরকারের কাছে ভ্যাকসিনের জোগাড় নেই এবং দেশের সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও সরকার করেনি। এছাড়া দেশে সামগ্রিকভাবে লকডাউন ঘোষণা না হলেও বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে লকডাউন বলবৎ করা হয়েছে তাতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উপরে এইসব বিধিনিষেধের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। স্বাস্থ্য সঙ্কটের সময় বিধিনিষেধ জরুরি হলেও মানুষকে আর্থিক সঙ্কট থেকে রক্ষা করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের যে নেই তা দেখলেন দেশের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই সমীক্ষাগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, দেশের নিম্নবিত্ত মানুষ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এই সময়কালে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জনগণের সিংহভাগের আয় ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। অর্থনীতিতে চাহিদার অভাব দেখা দিয়েছে এবং উৎপাদন মার খেয়েছে।

এই সময়ে সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় যে আঞ্চলিকভাবে লকডাউন হয়েছে তার জেরে কর্মসংস্থানের সঙ্কট ও অর্থনৈতিক দুর্দশার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জাঁ দ্রেজ। তাঁর মতে, গত বছরের তুলনায় এ বছরে মানুষের সঞ্চয় আরও কমেছে এবং বেড়েছে ধারের পরিমাণ। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য মানুষের কাছে সম্পদের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মোদী সরকারের কাজে অত্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেছেন যে, যখন দেশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় গুরুতর দুর্বলতা লক্ষ করা গিয়েছিল এবং করোনার প্রকোপ মারাত্মকভাবে বাড়ছিল তখন সরকার এই বিষয়টিকে স্বীকার না করে মিথ্যে স্তোকবাক্যে জনগণকে বুঝিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। সরকারের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

বিভিন্ন রেটিং সংস্থা এবং স্টেট ব্যাঙ্ক ২০২১-২২ অর্থবর্ষে জিডিপি নিয়ে যে মতামত ব্যক্ত করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, আর্থিক বিকাশের গতি উল্লেখজনকভাবে যে কমবে তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। আমেরিকান রেটিং এজেন্সি S&P-র মতে আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে বছরের শেষে জিডিপি আরও ১.২ শতাংশ কমে যেতে পারে।

করোনার প্রথম ঢেউয়ে অর্থনীতির সংকোচন ঘটেছিল ৭.৩% যা কিনা আমাদের দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক। এই সময় দেশজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা সকলের নজরে আসে। বিপুলসংখ্যক মানুষ সে সময়ে কাজ হারিয়েছিলেন। পথেই প্রাণ হারিয়েছিলেন সাড়ে আট হাজারেরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও দেশজুড়ে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এই বিপুল কর্মহীনতাই বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রধানতম দিক।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ তাদের জন্য চরম বিপদ ডেকে এনেছে। গরিব মানুষ দুবেলা-দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু এই অতিমারীর সময়ে গত দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা বেড়েছে ২১২.৪%। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ করে জানানো হয়েছে যে, মূলত শ্রমিকদের মজুরিখাতে খরচ কমিয়েই মুনাফার হার অতিমারীর আগের বছরের থেকেও বাড়াতে পেরেছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। গত একবছরে নির্বিচারে শ্রমিক ছাঁটাই, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ, মজুরি হ্রাস করে মুনাফার পাহাড় বানিয়েছে কর্পোরেট মালিকরা আর ক্রমশ নিঃস্ব হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ।

এবারে সিএমআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি)-র হিসাব অনুযায়ী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ইতিমধ্যেই এক কোটিরও বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গত বছর দেশের ৯৭%পরিবারের আয় কমে গিয়েছিল। এবারে কোনো উন্নতি তো দূরস্থান, পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় কৃষি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলেছিল যা কিনা ভারতের অর্থনীতিকে কিছুটা আলোর দিশা দেখাতে পেরেছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় কৃষি অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাক্তন চিফ স্ট্যাটিস্টিসিয়ান প্রণব সেন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই বছরে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট সঙ্কট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে কেননা গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে এবং রোজগারের অভাব দেখা দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ফসল তোলার কাজ শেষ হলেও কৃষি ক্ষেত্রে ফসলের দাম না পাওয়া ও অভাবী বিক্রির নানা ঘটনা সামনে আসছে।

অকৃষি ক্ষেত্রেও রোজগারের পথ সংকুচিত হয়েছে। তাই মজুরির ওপর নির্ভরশীল যে বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ মানুষ, তাদের আয় গত তিন মাসে সংকুচিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। এসময় সারা দেশে ১০০ দিনের কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেখানে গত বছর মে মাসে ৩ কোটি ৭৩ লক্ষ পরিবার কাজের আবেদন করেছিল সেখানে এবছর মে মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৭৬ লক্ষ পরিবার। রাজস্থানে গত ১০ মে থেকে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ, উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত গঠন না হওয়ায় থমকে গেছে রেগা প্রকল্পের কাজ। কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প রূপায়ণ করানোর জন্য রাজ্য সরকারগুলির ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষ চরম অর্থ সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন যা থেকে পরিত্রাণের পথ দেখাতে পারছে না সরকার।

আমাদের রাজ্যে পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্গীন হচ্ছে রাজ্য সরকারের উদাসীনতা ও মালিকদের প্রতি আনুগত্যের কারণে। আমাদের রাজ্যে এক মাস হয়ে গেল বোরো ধান উঠেছে, কিন্তু সরকার আদৌ ধান কেনায় আগ্রহী হচ্ছে না। এমন অবস্থায় বিপদে পড়ে চাষি কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের রাজ্যে ৬০ কেজি ধান মিল মালিকরা কিনছে ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায়। আর এই ১২-১৩ টাকা কেজি দরে ধান কিনে ২৬ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে ধানের তুষ। এই সময়ে বাংলার চালকল মালিকরা যে পরিমাণ মুনাফা করছে তা গত দশ বছরে সর্বাধিক। আর অন্যদিকে ধুঁকছে রাজ্যের কৃষক। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী দুজনেই দাবি করছেন কৃষকের আয় নাকি কয়েকগুণ বেড়েছে আর বাস্তবে কৃষক মহাজন আর মিল মালিকদের নিদারুণ শোষণের শিকার হচ্ছেন।

বর্ধমানের রাইস মিলে অতিমারীর সময় শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রাপ্য টাকা থেকেও তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে কৃষক সভার নেতৃত্ব অভিযোগ করেছেন।

বর্তমানে রাজ্যে ৫৪টি চটকলের মধ্যে ১৬টি বন্ধ। এই লকডাউনের সময় চটকলে ৩০% শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন চলবে বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার, কেননা চটকলগুলিতে করোনা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম উৎপাদিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সচেতন মানুষ এই প্রশ্ন উত্থাপন করছেন যে, চটকলগুলির ভূমিকা যখন এই অতিমারীর সময় গুরুত্বপূর্ণ সেখানে ১৬টি চটকল বন্ধ থাকছে কেন? ইতিমধ্যেই এই বন্ধ চটকলগুলিতে ৭৫ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন। লকডাউনের বিধিনিষেধের জন্য কাজ হারিয়েছেন আরও প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। এদের ভরণপোষণের কোনো দায়িত্ব নেবে না রাজ্য সরকার? লক্ষণীয়, গত বছর করোনা অতিমারীর প্রকোপ চলাকালীন, দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রিলিফ প্যাকেজের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছরে সেইরকম কোনো রিলিফ প্যাকেজের কথা কী রাজ্য সরকার কী কেন্দ্রীয় সরকার কারো তরফে শোনা যাচ্ছে না। যদিও এই সমস্ত রিলিফ প্যাকেজ বাস্তবে কার্যকরী নয় এবং শ্রমজীবী মানুষের আর্থিক সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন। তবু রিলিফ প্যাকেজের মাধ্যমে সীমিত আর্থিক সুরাহা দেওয়ার কথাও যখন সরকার উচ্চারণ করছে না তখন বোঝা যায় যে, দেশের আমজনতা সম্পর্কে সরকারের উদাসীনতা কী পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গত এক মাসে আমাদের রাজ্যে অটো, টোটো, রিক্সা চালক, ভ্যান চালকের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষদের যে চরম আর্থিক ক্ষতি হলো, নির্মাণ ক্ষেত্রসহ নানারকম ছোটখাটো কাজে যাঁরা যুক্ত থাকেন কিংবা ইলেকট্রিক বা কলের মিস্ত্রির মতো নানা পেশার মানুষ যাঁরা পুরোপুরি কর্মহীন হয়ে রইলেন তাদের আর্থিক সুরক্ষার কী হবে? কে তাদের পাশে দাঁড়াবে? এই বিপুলসংখ্যক কর্মহীন মানুষের সামাজিক সুরক্ষার কথা কী আদৌ সরকার ভাবছে?

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন রাজ্যে কর্মসংস্থানের সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সিএমআইই-র রিপোর্ট অনুযায়ী গত মে মাসে এ রাজ্যে কর্মহীনতার হার ছিল ১৯.৩ শতাংশ যা কিনা জাতীয় গড় ১১.৯ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। গত বছর লকডাউনের সময় সেখানে বেকারত্বের সর্বোচ্চ হার ছিল ১৭.৪ শতাংশ, সে ক্ষেত্রে এই বছরে তা প্রায় দুই শতাংশ বেশি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের যে পরিমাণ ছদ্ম বেকারত্ব রয়েছে তাতে অনুমান করা যায় যে আগামীদিনে বেকারত্বের হার কুড়ি শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ রাজ্যের বর্তমান সরকার নির্বাচনের সাফল্যের মৌতাত নিতে এতটাই ব্যস্ত যে, তারা এই সঙ্কটের কথা স্বীকার করছে না বা তাকে নিয়ে কোনোরকম পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবছেও না।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতির কঙ্কালসার এই চেহারা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এরই মধ্যে মোদী সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক ও সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ককে বিক্রির পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে। আরেকটি বিমা সংস্থা বেসরকারিকরণের কথাও ঘোষিত হয়েছে। সব মিলিয়ে একথা স্পষ্ট যে, দেশ রসাতলে যাক, কিন্তু নয়া-উদারবাদের রথের গতি যাতে স্তব্ধ না হয় তা দেখাই মোদী-শাহ সরকারের প্রধানতম কাজ।