৫৮ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১১ জুন, ২০২১ / ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
দুয়ারে রেশন নয়, এবার দুয়ারে নম্বর নিয়ে সরকার
অমর বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজ্য সরকার একটি ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল গত পয়লা জুন। এই বিশেষজ্ঞ কমিটি ৫ জুন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন কীভাবে হবে সে সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করেছে। এর ভিত্তিতে ৬ জুন এবারের করোনা অতিমারীতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হবে কিনা তা নিয়ে অভিভাবক, ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে মতামত জানতে চাওয়া হয়। মতামত পরের দিন অর্থাৎ ৭ জুন, সোমবার বেলা ২টার মধ্যে তিনটি ইমেল মারফত জানানোর কথা বলা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও একই আবেদন করেন। তিনি লেখেনঃ আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ আমার কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে কিনা তা নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে আমরা অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, সমাজ, ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাদের মতামত জানতে চাইছি।’
লক্ষণীয়, গত ৯ জুন সরকারিভাবে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সূচি ঘোষিত হওয়ার কথা ছিল। সেইমতো পরীক্ষার সূচি তৈরি হয়ে গিয়েছিল বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। কিন্তু আগের দিন অর্থাৎ ৮ জুন রাতে সিবিএসই এবং আইসিএসই পরীক্ষা বাতিল করার পর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পিছিয়ে আসা হয়। তখনই বোঝা গেছিল যে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পরীক্ষা নেওয়ার মতো হিম্মত নেই।
সিবিএসই এবং আইসিএসই বোর্ড অনেক আগে থেকেই লিখিত পরীক্ষার বিকল্প হিসাবে কিছু ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে এদের মূল্যায়ন করা নিয়ে তেমন অসুবিধা নেই। তাছাড়া, এদের মোট ছাত্র ছাত্রী আমাদের রাজ্য সরকারের অধীনে যে কোনো একটি জেলার ছাত্রছাত্রীর মোট সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। এই বোর্ডগুলো অনেক আগে থেকেই স্কুলগুলোতে অনলাইন পঠনপাঠন ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন চালু রেখেছে। অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের জন্য তারা পার্বিক পরীক্ষাগুলিও নিয়েছে।
কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে ফলাফল তৈরি, নম্বর দেওয়ার প্রক্রিয়া ও তার পদ্ধতি সম্পর্কে নিয়মিত নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে ১০০ নম্বরের মধ্যে ইন্টার্নাল অ্যাসেসমেন্ট বা অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের যে কুড়ি নম্বর স্কুলের হাতে রয়েছে তাতে ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বর যা ছিল তাই থাকবে। বাকি ৮০ নম্বরের জন্য বিভাজন করা হয়েছে এমনভাবে - স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা থেকে ১০ নম্বর, ষান্মাসিক পরীক্ষা থেকে ৩০ নম্বর এবং প্রি-টেস্ট বা টেস্ট পরীক্ষা থেকে ৪০ নম্বর। এভাবেই তারা স্কুলগুলো থেকে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্তরে নম্বর সংগ্রহ করে নিয়েছে।
এই কথাগুলি পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে জানায়। কোভিড অতিমারীর প্রকোপ এখন কমছে। একটু সময় হাতে নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব। এতে হয়ত পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ একটু পিছিয়ে দিতে হতে পারে, কিন্তু একদম কোনো পরীক্ষা না নিয়ে ঢালাও নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা করলে তা হবে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এবিটিএ-র সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে যে চিঠি দিয়েছেন, সেই চিঠিতে পরিষ্কারভাবেই এই কথাগুলো উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করে না দিয়ে পরীক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দিয়ে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে যাতে পরীক্ষার বন্দোবস্ত করা যায় এবং তা সরকারকে করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন এস এফ আই-র এর পক্ষে রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য একই মত পোষণ করে বলেন, পরীক্ষা নিয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না যাতে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
কিন্তু আমাদের রাজ্যের মাধ্যমিক বোর্ড অথবা উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ কেন্দ্রীয় বোর্ডের মতো কোনো আগাম পদক্ষেপ নেয়নি। ২৭ মার্চ নির্বাচনের প্রথম দিনে কোভিডে রাজ্যে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ছিল ৮১২ এবং মৃত্যু হয় মাত্র ২ জনের এবং যখন ২ মে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়, সেই দিন রাজ্যে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৫১৫ এবং মৃত্যু হয় ৯২ জন মানুষের। এই মধ্যবর্তী সময় রাজ্যে কোনো শাসন ছিল না এমন তো নয় এবং নির্বাচিত বোর্ড ও উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ বহাল ছিল। তারা এই সময়টাতে বিদ্যালয়গুলোকে কিছু কার্যকর নির্দেশ দিতে পারতো, কিন্তু ক্ষমতা কার হাতে আসবে সেই চিন্তায় শাসকদলগুলো মশগুল ছিল। আগে ক্ষমতা, পরে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ - এমন ভাবনা থেকেই আজকেই ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
অবশেষে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজকে বেকুব বানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী গত ৭ জুন, সোমবার নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে পরীক্ষা বাতিলের কথা ঘোষণা করলেন। সরকার নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির পরীক্ষা বাতিলের সুপারিশকে বলির পাঁঠা করে মুখ্যমন্ত্রী পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা যেন গণতন্ত্রের জামা গায়ে স্বৈরাচারীর কণ্ঠস্বর! বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের সঙ্গে যুক্ত মাস্টার মশাইদের কোনো মতামত নেওয়া হলো না। আমজনতার মতামত জানানোর জন্য মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে অভিভাবক সমাজ ও সাধারণ মানুষকে মেল করে জানাতে হবে তাদের মতামত। এটা প্রকৃতপক্ষে ধোঁকা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বাভাবিকভাবে আমজনতার মধ্যে অতি ক্ষুদ্র অংশ (মুখ্যমন্ত্রী নিজে ৩৫ হাজার মেলের কথা জানিয়েছেন) মত দিয়েছেন স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার বিপক্ষে । যদিও কে আর তদন্ত করে দেখতে যাবে! আর আর কার ঘাড়ে ক'টা মাথা আছে যে মুখ্যমন্ত্রীর মুখের উপরে কথা বলবে! অতএব পরীক্ষা বাতিল।
পরীক্ষা হবে কি হবে না - এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে বছরের পর বছর যাঁরা ছেলেমেয়েদের তৈরি করেন তাঁরা যুক্ত থাকতে পারলেন না, এ দৃষ্টান্ত সাধারণের বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে একদিন বিপন্ন করে তুলবে না তো? এই কথা বলছিলেন একজন স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক। আমি জানতে চাইলাম এমন ভাবনা আপনার মাথায় এলো কেন? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় মূল্যায়নের যে সুপারিশ তিনি করেছেন সেটা কি আপনি তলিয়ে দেখেছেন? আমি বললাম আপনি বলুন না কী ভাবছেন আপনি - আমি শুনছি।
প্রথমত, এবছর যেসব ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক দিচ্ছে তারা ২০১৯ সালে শেষ নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছিল। তারপর থেকে এই বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা অন্য কোনো পরীক্ষায় বসার সুযোগ পায়নি । করোনা মহামারীর কারণে দশম শ্রেণিতে সামেটিভ ফরমেটিভ, প্রিটেস্ট অথবা টেস্ট পরীক্ষা কোনোটাই হয়নি। তাছাড়া ২০১৯ সালের নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ভিত্তিতে যদি মূল্যায়ন করা হয় তাতে পরীক্ষার্থীদের মান নির্ধারণের যথাযথ মূল্যায়ন হবে কী? কারণ মাধ্যমিক পরীক্ষা দশম শ্রেণির সিলেবাসের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত, কিন্তু দশম শ্রেণিতে একটিও ক্লাস হয়নি, পাঠক্রম-পাঠ্যসূচি শেষ হয়নি। আবার, মাধ্যমিক পরীক্ষার ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন সম্ভব নয় কারণ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ইন্টিগ্রেটেড সিলেবাস অনুসরণ করে উচ্চমাধ্যমিক প্রস্তুতি না নিয়ে পরীক্ষায় নম্বর দেওয়া হলে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা জীবন হত্যা করারই শামিল হবে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স বা অন্য সর্বভারতীয় পরীক্ষায় সফল হতে হলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ভালো প্রস্তুতি প্রয়োজন।
তবু বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ কিছুটা মান্যতা পেলেও অন্য সুপারিশটি একদমই 'দুয়ারে নম্বর' দেওয়ার মতো একটি পপুলিস্ট রাজনৈতিক কর্মসূচিও বটে।
আমি জানতে চাই - কেমন ভাবে? তিনি বলেন - বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করেছিলেন নবম শ্রেণির মূল্যায়নে বিষয় ভিত্তিক প্রাপ্ত নম্বরের ৭০ শতাংশ এবং দশম শ্রেণির অন্তর্মূল্যায়নের ৩০ শতাংশ যোগ করে একজন শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর ঠিক করতে হবে। এই সুপারিশে তবু কিছু যুক্তি ছিল। নবম শ্রেণিতে ছেলেমেয়েদের ক্লাস হয়েছে, অন্তর্মূল্যায়ন ও বহির্মূল্যায়ন অর্থাৎ স্কুলে লেখা পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু দশম শ্রেণিতে বড়োজোর দু'মাস ক্লাস হয়েছে। বিদ্যালয়ে বাস্তবিক কিছু পড়া হয়নি। অন্তর্মূল্যায়ন হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে দশ নম্বরের মধ্যে নম্বর দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ উলটে দিয়ে দশম শ্রেণির প্রাপ্ত নম্বরের ৭০ শতাংশ যোগ করতে বলেছেন,আর নবম শ্রেণির ৩০ শতাংশ নিয়ে একশো নম্বরের বিষয় ভিত্তিক মূল্যায়নের প্রস্তাব দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী নম্বর দেওয়া হলে মনে করুন একটি ছাত্র বা ছাত্রী নবম শ্রেণিতে প্রাপ্ত নম্বর হলো শতকরা ৭০, তাহলে সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় নম্বর পাবে শতকরা ৪৯,আর যদি সে অন্তর্মূল্যায়ন অর্থাৎ প্রজেক্ট ও ভাইভা মিলিয়ে সর্বমোট শতকরা ৯৫ নম্বর পায় (যা প্রায় সব মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা পেয়ে থাকে), তাহলে এর তিরিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৮-২৯ নম্বর গড়ে সে পাবে। তখন তার প্রাপ্ত নম্বর হবে গড়ে ৭৭-৭৮।
এই ব্যাপারটা মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশে কী হয় দেখুন। দশম শ্রেণিতে প্রাপ্ত নম্বর ৯৫ এর ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৬-৬৭ নম্বর এবং নবম শ্রেণির প্রাপ্ত নম্বর ৭০-এর ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ২১ যোগ করলে মোট প্রাপ্ত নম্বর হবে ৮৭-৮৮। সুতরাং শতকরা ১০ শতাংশ নম্বর প্রতিটি বিষয়ে বেড়ে যাবে । মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৬০০ নম্বরের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশে গড়ে ৬০ নম্বর করে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী বেশি পাবে। এই ঢালাও নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা হলে এই বিদ্যালয়গুলোর উপর অভিভাবকদের আস্থা থাকবে? তারা সন্তানসন্ততিদের আর সাধারণের বিদ্যালয়ে ভরতি করতে চাইবে? শিক্ষক সমাজ ব্রাত্য হবেন সমাজের কাছে, কারণ জ্ঞান-প্রয়োগ-দক্ষতার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন এবং তারপর ধারাবাহিক মূল্যায়ন - এই ব্যবস্থাটিই উঠে যাবে এবং লিখিত পরীক্ষার আর কোনো প্রয়োজন হবে না। এই সাধারণ বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়গুলো রমরমিয়ে উঠবে এবং সামর্থ্য থাক বা না থাক সমস্ত অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে সেসব বিদ্যালয়গুলোতে ছুটবে। এর ফলে একদিকে শিক্ষার ব্যাপক বেসরকারিকরণ ঘটবে এবং অপরদিকে সাধারণের বিদ্যালয় তার অস্তিত্ব হারাবে। 'দুয়ারে নম্বর' দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সর্বনাশ ডেকে আনছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে কোথায় সরব বুদ্ধিজীবী ও বাংলাপ্রেমী মানুষ!