E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১১ জুন, ২০২১ / ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

পরিবেশ আলোচনা

স্টারলাইট থেকে অক্সিজেনঃ কেন চোরের মুখে নীতিকথা?

তপন মিশ্র


স্টারলাইট কারখানার সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ২০১৮ সা‍‌লের‍‌ ২২ মে মানুষের প্রতিবাদ।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সময় তামিলনাডুর থোথুকুডি (Thoothukudi, পুর্বের নাম তুতিকোরিন)-র স্টারলাইট তামা তৈরি কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের কথা মনে পড়ছে। বিশেষকরে সেই সময়ে যখন কুখ্যাত স্টারলাইট কারখানা তামা ছেড়ে মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদনের প্রস্তাব নিয়ে আসে। সন্দেহ হয়, কেন হঠাৎ কারখানার দূষণের মধ্য দিয়ে অনেক মানুষের যন্ত্রণা বৃদ্ধি ও মৃত্যুর কারণ হয়েছে যে বহুজাতিক তামা তৈরির (Copper smelting) কারখানা সেই কারখানা দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হলো কী করে?এই সন্দেহ উঁকিমারে বিভিন্ন কারণে। প্রথম কারণ হলো, ১৯৯৬ সাল থেকে লাগাতারভাবে প্রশাসন এবং এলাকার মানুষ বার বার বলা সত্ত্বেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্টারলাইট উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি। দ্বিতীয়ত, কারখানার প্রায় ৫ কিলোমিটার ব্যসার্ধ যুক্ত অঞ্চল জুড়ে কারখানার দূষণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে মানুষের প্রমাণিত যে ক্ষতি হয়েছে তার কোনো ক্ষতিপূরণ করেনি স্টারলাইট।

স্টারলাইট বহুজাতিক বেদান্তের অন্যতম একটি সংস্থা। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এরা খনিজ সম্পদ আহরণ এবং আকরিক থাকে ধাতু নিষ্কাশন (smelting) করার কাজ করে। এই বেদান্তের ওডিশার কালাহান্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ের নিয়ামগিরি অঞ্চলে বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশনের কারখানা বনভূমি এবং আদিবাসীদের জমি দখল করে করার অপরাধে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট কারখানা বন্ধের নির্দেশ দেয়। এখানে ডোঙ্গরিয়া কোন্ধ নামে এক প্রাচীন আদিবাসীদের বাস।

স্টারলাইটের শুরু

থোথুকুডির তামার কারখানার কাজ স্টারলাইট শুরু করে ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই কারখানা থেকে সালফার ডাই অক্সাইড লিক হয়ে প্রায় ৯০ জনেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে বিভিন্ন দিক থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর তামিলনাডু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কারখানা বন্ধের নির্দেশ দেয়। এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদই ১৯৯৪ সালে থোথুকুডির মতো এক উপকূলবর্তী জেলায় কারখানা স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল। প্রথম প্রতিবাদ আসে মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকে। কারখানার মধ্যে তামা ছাড়াও সালফিউরিক অ্যাসিড, ফসফরিক অ্যাসিড এবং নিজস্ব চাহিদা পূরণ করতে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের জন্য ১৬০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। অবশ্য এর প্রত্যেকটি তামা উৎপাদনের জন্য আবশ্যক। কিন্তু উৎপাদন শুরুর সময় থেকেই বোঝা যায় যে, দূষণ নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বেদান্ত গ্রহণ করেনি। ২০১৩ সালে আবার সালফার ডাই অক্সাইড লিক হওয়ার ঘটনা ঘটায় মানুষের ক্ষোভের মুখে কারখানা বন্ধ করে দেয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দিল্লির ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল থেকে উৎপাদনের ছাড়পত্র আদায় করে নেয় স্টারলাইট। এর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে, মাদ্রাজ হাইকোর্ট স্টারলাইটের দূষণের বিরুদ্ধে এক মামলায় রায় প্রদান করে এবং কারখানা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। স্টারলাইট এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে এবং তিন দিনের মধ্যে হাইকোর্টের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ পেয়ে যায়। আদালত নিরি বা ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (NEERI)কে দূষণের মাত্রার মূল্যায়ন করার নির্দেশ দেয়। নিরি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে স্টারলাইটকে ক্লিনচিট দিয়ে দেয়, যদিও আরও কয়েকটি সূত্রে পাওয়া তথ্য নিরির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারেনি। নিরির প্রতিবেদনটি ২০১১ সালের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয় হয়েছিল। তিরুনেলভেলি মেডিক্যাল কলেজের ২০০৬-০৭-এর সমীক্ষা কিন্তু অন্য কথা বলছে। সমীক্ষা বলছে, কারখানার ৫ কিলোমিটার এলাকায় শ্বাসরোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ এবং নাক, কান, গলার রোগের পরিমাণও অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির নিচের জলে লোহার পরিমাণ ১৭ থেকে ২০ গুণ বৃদ্ধি ঘটেছিল। তখন যদিও স্টারলাইটের বছরে ৪ লক্ষ টন তামা উৎপাদন করার কথা তবু সেই লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪২ শতাংশ উৎপাদন করছিল। অর্থাৎ পুর্ণমাত্রায় উৎপাদন করলে দূষণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি হতো। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত সম্ভবত নিরির অনুসন্ধানে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই আদালত মাদ্রাজ হাইকোর্টের কারখানা বন্ধের নির্দেশ খারিজ করে কিন্তু কারখানাকে ১০০ কোটি টাকার জরিমানারও নির্দেশ দেয়। ফলে কারখানা আবার খুলে যায়।ঠিক তার।পরেই স্টারলাইটের পরিবেশ ছাড়পত্র আরও ২ বছরের জন্য বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়।

ধোঁয়া থেকে আগুন

এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ২০০৯ সালে স্টারলাইট ইন্ডাস্ট্রিজ, বর্তমানে স্টারলাইট কপার তৈরি কারখানার ২০০৬ সালের তৈরি নতুন এনভাইরনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (EIA) আইন অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির আবেদন জানায় এবং সহজে অনুমতি পেয়েও যায়। এই সহজে পাওয়ার কারণ ছিল যে, রাজ্য সরকারের (State Industries Promotion Corporation of Tamil Nadu Ltd বা SIPCOT)-র তৈরি এই শিল্প তালুক পুর্বেই পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছিল। কিন্তু এই আইন অনুযায়ী দূষণ রোধের যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, এই কারাখানা সেই ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে মানুষের ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে।আবার ২০১৮ সালে যখন স্টারলাইট কারখানা তার উৎপাদন বছরে ৪ লক্ষ টন থেকে বাড়িয়ে ৮ লক্ষ টন অর্থাৎ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তামা উৎপাদনকারী কারখানায় রূপান্তরিত করার কথা ঘোষণা করে তখন সেই ক্ষোভ আগুনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। মানুষের এতো আপত্তি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের দেওয় পরিবেশগত ছাড়পত্র জানাজানি হওয়ায় মানুষ সংগঠিত হতে থাকেন। দূষণ কয়েকগুণ বৃদ্ধির আশঙ্কায় থোথুকুডির মানুষ ভিত হয়ে পড়েন এবং ১০০ দিনের ধরণা ও অনশনের মধ্যদিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন।মানুষের প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল তৎকালীন তামিলনাডু সরকার। ২০১৮ সালের ২২ মে ক্রুদ্ধ মানুষ যখন জেলাশাসকের দপ্তর ঘেরাও করে তখন পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় এবং পুলিশের গুলিতে ১৪ জন নাগরিক মারা যায়। এছাড়াও গুলির ঘায়ে ১০২ জন আহত হয়।একথা পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে।এরপরেই ঘটনায় প্রলেপ দেওয়ার জন্য গুলিচালনার ৬দিন পর তামিলনাডু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কারাখানা বন্ধের বিঞ্জপ্তি দেয় এবং সরকার কারখানার দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়।

অসৎ উদ্দেশ্যে সৎ কাজ নয়তো?

স্টারলাইট তামার কারখানা গালফ অফ মান্নার সামুদ্রিক ন্যাশনাল পার্ক, যা পরিবেশের দিক দিয়ে সংবেদনশীল অঞ্চল, সেখান থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২০১৮ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট থোথুকুডিতে তামার কারখানা পুনরায় খোলার অনুমতি চেয়ে বেদন্তের আবেদন নাকচ করে দেওয়ার অন্যতম একটি কারণ ছিল এই অবস্থান। পরিবেশ দূষণজনিত কারণে মানুষের প্রতিবাদ এবং গুলিচালনার কারণে ২৮ মে, ২০১৮ সালে তামিলনাডু সরকার এই প্ল্যান্টটি সিল করে দিয়েছিল। এত বড়ো হত্যকাণ্ডের পরও নির্লজ্জ বেদান্ত কিছুদিনের মধ্যে মাদ্রাজ হাইকোর্টে কারখানা খোলার আবেদন জানায়।

বিচারপতি টি এস শিভজ্ঞানাম এবং ভি ভবানী সুব্বরোয়ন-এর বেঞ্চ বেদান্তের যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন যে, গালফ অফ মান্নার সামুদ্রিক ন্যাশনাল পার্ক-এর মতো একটি ইকো সেনসিটিভ জোন কাছে থাকায় এই কারখানার দূষণ তার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে। ২০০৩ সালে গালফ অফ মান্নারকে একটি সামুদ্রিক ন্যাশনাল পার্ক হিসাবে ঘোষণা করা হয়। আদালতের মতে, এই ঘোষণা দেরি হওয়য় কারণেই কারখানাটি কাজ শুরু করার অনুমতি পেয়ে যায়। আদালত কারখানাটির স্থানান্তরণের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি। এই রায়টি স্টারলাইটের মূল সংস্থা বেদান্তের জন্য হয়তো একটি ধাক্কা। তবে সংস্থাটি কারখানাকে তামিলনাড়ু থেকে সরিয়ে নেওয়র পক্ষে নয়। স্টারলাইট কপারের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক পঙ্কজ কুমার ‘দ্য হিন্দুকে’ বলেন, “কিছুই স্থানান্তরিত করার আমাদের ভাবনায় নেই। স্থানান্তরণের চিন্তা করার আগে আমাদের সমস্ত আইনি বিকল্পগুলি খতিয়ে দেখতে হবে”। ২০১৯ সালে বেদান্ত আবার মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই আবেদন গ্রহণ করেনি। এমনিতেই তামা বা স্টিল উৎপাদনের কারখানায় উৎপাদনের নিজস্ব প্রয়োজনে তরল অক্সিজেন তৈরির ব্যবস্থা থাকে। ২০১৮ সাল থেকে আদালতের রায়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টারলাইট সম্প্রতি রাজ্য, কেন্দ্র এবং আদালতের কাছে তরল এবং চিকিৎসায় ব্যবহারযোগ্য অক্সিজেন তৈরির অনুমতি চায়। সরকার এবং আদালত ৪ মাসের জন্য এই অনুমতি দেয়। মে মাসের শেষ নাগাদ ২০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন তৈরি করেছে এই কারখানা। কিন্তু যে প্রশ্ন এলাকার মানুষের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে তা হলো, এক মারাত্মক অপরাধে বন্ধ করে দেওয়া কারখানাকে পেছনের দরজা দিয়ে আবার খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করার অসৎ ইচ্ছে বেদান্তের নেইতো? অতীতে প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় রেখে অনেক জনবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা এই বহুজাতিকের হঠাৎ এই সাধু সাজা কেন?এমন একটা অবস্থায় বেদান্তের অতিমারীর জন্য অক্সিজেন তৈরির দরদ কেন উতলে উঠল, তা ভাবার বিষয়।

কর্পোরেটদের মুনাফাই সরকারের একমাত্র লক্ষ্য

দেশে যখন বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমবর্ধমান,এবছর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত এক নয়া ফরমান জারি করল কেন্দ্রীয় সরকার। ফরমানে বলা হলো যে, কোনো শিল্প কারখানা যদি তার উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চায় তাহলে তাকে পূর্ব থেকে কোনো অনুমতি নিতে হবেনা। কেবল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে চিঠির মারফত জানিয়ে দিলে হবে যে, উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে দূষণের মধ্যদিয়ে পরিবেশের উপর কোনো বাড়তি চাপ পড়বেনা। ২০২০ সালে একটি নতন ইআইএ আইন এনে সরকার পরিবেশ রক্ষায় কর্পোরেটদের সমস্ত দায়বদ্ধতা লঘু করতে চাইছে। বেদান্তকে তামা উৎপাদন বার্ষিক ৪ লক্ষ মেট্রিক টন থেকে ৮ লক্ষ মেট্রিক টনে সম্প্রসারণ করতে পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে হয়েছিল। তাতে স্থানীয় মানুষ দূষণ বৃদ্ধির প্রতিবাদ করায় থোথুকুডিতে হত্যলীলা ঘটানো হয়। নতুন আইনের ফলে এবার আর কোনো কর্পোরেটের পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার কোনো দায়বদ্ধতা থাকল না। ফলে থোথুকুডির মতো আরও যে কত হত্যা আমাদের দেখতে হবে তা ভাবতেও কেমন লাগে।