৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ রুখতে ২৮-২৯ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করতে হবে
শংকর মুখার্জি
গত তিন দশকে উদার অর্থনীতির বেপরোয়া প্রয়োগে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের অস্তিত্ব গভীর সংকটে। উদারনীতির প্রায়োগিক দিকের অন্যতম অভিমুখই হচ্ছে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলোপসাধন। ভারতেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। ১৯৯১ সালের জুলাই মাস থেকে ভারতের অর্থনীতি আনুষ্ঠানিকভাবে উদার অর্থনীতির পথে চলতে শুরু করে।তখন কেন্দ্রে পি ভি নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। প্রথম থেকেই দেশের শাসকশ্রেণিগুলির এই প্রায়োগিক দিকের প্রতি বিশেষ নজর ছিল। বিলগ্নিকরণ দিয়ে এই প্রক্রিয়ার শুরু। এখন তারা চাইছে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ কিংবা সিংহভাগ শেয়ার বেচে পরিচালনাভার করপোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিতে। স্বাধীনতার পর স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার যে চেষ্টা হয়েছিল তার মূল ভিত্তি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নির্মাণ। গত তিন দশক ধরে সেই ভিত্তিমূলেই আঘাত করে চলেছে প্রতিটি কেন্দ্রীয় সরকার। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের আমলে আরও আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এই আক্রমণ। তারা এমনকী ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইনের নামে দেশের পরিকাঠামোকেও করপোরেটদের কাছে জলের দরে বেচে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এবং বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন প্রথম দিন থেকেই এই নীতির বিরুদ্ধে। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি এই বেসরকারিকরণের নীতির বিরুদ্ধে কখনও ক্ষেত্রওয়াড়ি আন্দোলন-ধর্মঘট করেছে আবার দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘটের পথে গেছে। প্রথম থেকেই যে তারা দেশের সমগ্র ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন কিংবা শ্রমিক-কর্মচারী মেহনতি মানুষের আন্দোলনকে পাশে পেয়েছিল তা বলা যাবে না। তবে সিআইটিইউ সহ বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ছিল সমগ্র শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করা। ২০০৯ সালে সেই প্রচেষ্টা সফল হয়। গড়ে ওঠে সাধারণ মঞ্চ। সেই মঞ্চ বর্তমানে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সম্প্রসারিত হয়েছে। এই মঞ্চ এখনও পর্যন্ত ৮টি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সংঘটিত করেছে। যদিও, আগামী ২৮-২৯ মার্চের ৪৮ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘট দেশে উদার অর্থনীতির যুগ শুরু হওয়ার পর ২১ তম। এই দীর্ঘসময়ের আন্দোলনে দাবিসনদে একাধিক নতুন দাবি সংযোজিত হয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ করার দাবি দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দাবিসনদে প্রথম থেকেই থেকেছে। এবারে ধর্মঘটের ১২ দফা দাবির অন্যতম হলোঃ “ সরকারি সংস্থা, ব্যাঙ্ক, বিমা সহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ করো”।
এই দীর্ঘ তিন দশকের লড়াই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণকে একেবারে বন্ধ করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এই প্রক্রিয়াকে অনেকাংশে মন্দীভূত করেছে। আন্দোলনের চাপে বহু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ আটকানোও গেছে। যদিও বালকো, আইপিসিএল, এইচসিএল প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সম্পূর্ণ বিক্রি হয়ে গেছে।এবং মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে থাকলেও ৭১টি সংস্থার বিভিন্ন অংশ শেয়ার বিক্রি হয়েছে। সবমিলিয়ে অর্থের দিক দিয়ে এই বিলগ্নিকরণের পরিমাণ ৫ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর ৪৫টির মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিক্রির তালিকা করেছিল। এখনো পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়া কোনো সংস্থাকে বিক্রি করতে তারা সফল হয়নি।
এই তালিকায় ওডিশার নালকো এবং তামিলনাডুতে নেভেলি লিগনাইট, সালেম স্টিল প্ল্যান্ট, কর্ণাটকের বিইএমএল, পশ্চিমবঙ্গে অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, ব্রিজ অ্যান্ড রুফ, উত্তরপ্রদেশে শাহিবাবাদে সেন্ট্রাল ইলেকট্রনিকস লিমিটেড এবং অন্ধ্রপ্রদেশে বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্টের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আছে। উপরে উল্লিখিত প্রতিটি সংস্থাতেই শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে কেন্দ্রীয় সরকারের বেসরকারিকরণের চেষ্টাকে রুখে দিয়েছে। সালেম স্টিল প্ল্যান্ট এবং বিইএমএল-এর ইচ্ছুক ক্রেতারা পরিদর্শনে এলে শ্রমিকরা তাদের শারীরিকভাবে বাধাদিয়ে প্ল্যান্টে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজ্যের জনগণও শ্রমিকদের সেই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। নালকো এবং নেভেলি লিগনাইটের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্টের বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করেছে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার প্রতিটা রাজনৈতিক দল। শ্রমিকরা প্রায় এক বছর ধরে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে রয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং শিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা গত আড়াই দশকে ৪০টিরও বেশি ধর্মঘট সংঘটিত করেছে। ইতিমধ্যে, বিজেপি সরকার দেশের ২৭ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে সংযুক্ত করে ১২টি করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো এই সংখ্যা আরও কমিয়ে ৪টি করা। মূল উদ্দেশ্য একটাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শিল্পের বেসরকারিকরণ। কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কিছু পরিমাণ শেয়ার কেন্দ্রীয় সরকারগুলি বেচতে পারলেও বেসরকারিকরণ করতে তারা সফল হয়নি। ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি মোদি সরকার এলআইসি’র ৫ শতাংশ শেয়ারের বিলগ্নিকরণের ঘোষণা করেছে। নিশ্চিতভাবেই এটা এক অশনিসংকেত। এখনো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা সংস্থাগুলির অস্তিত্ব বজায় থাকার জন্য বিমা কর্মচারীদের আন্দোলনের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ, কয়লা, হাইড্রোকার্বন এবং ইস্পাত ক্ষেত্রেও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেসরকারিকরণ বিরোধী আন্দোলনই এখনো পর্যন্ত সংস্থাগুলির রাষ্ট্রায়ত্ত চরিত্র অটুট রেখেছে।
এবারের বাজেটে বিলগ্নিকরণ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৬৫ হাজার কোটি টাকা। গত আর্থিক বছরে ছিল ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। সে লক্ষ্যমাত্রা তারা পূরণ করতে পারে নি। সরকারের এবাবদ আয় হয়েছিল মাত্র ৯,২৯১ কোটি টাকা। আগামী আর্থিক বছরে তাদের মূল লক্ষ্য বিপিসিএল’র বেসরকারিকরণ। এর বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত হাইড্রোকার্বন ক্ষেত্রে আন্দোলন চলছে। বিপিসিএল বাঁচানোর লড়াই শুধু হাইড্রোকার্বন ক্ষেত্রের শ্রমিক- কর্মচারীদের একার লড়াই নয়, এই লড়াই দেশের সমগ্র ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের।
অভিজ্ঞতা বলছে, একমাত্র ঐক্যবদ্ধ দুর্বার জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই পারে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াকে আটকাতে। এই আন্দোলনে সরাসরি শাসকশ্রেণির সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। আগামী ২৮-২৯ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট সেইরকমই এক রণাঙ্গন। এই ধর্মঘটকে সার্বিক সফল করার মধ্যদিয়ে সেই লড়াইয়ের বার্তাই শাসকশ্রেণির কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
২৮-২৯ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটের দাবিসমূহ -
(১) ‘শ্রম কোড’ এবং ‘এসেনসিয়াল ডিফেন্স সার্ভিসেস অ্যাক্ট’ বাতিল করতে হবে।
(২) সরকারি সংস্থা, ব্যাঙ্ক, বিমা সহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ করো।
(৩) আইসিডিএস সহ বিভিন্ন প্রকল্প কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করতে হবে।
(৪) বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকা কর্মীদের স্থায়ীকরণ সাপেক্ষে স্থায়ী শ্রমিকদের মতন বেতন দিতে হবে।
(৫) আয়করের বাইরে থাকা সকল নাগরিকদের মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা দিতে হবে এবং বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে।
(৬) সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে।
(৭) পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমাতে কেন্দ্রীয় অন্তঃশুল্ক কমাতে হবে।
(৮) নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমাতে হবে।
(৯) জাতীয় পেনশন প্রকল্প বাতিল করতে হবে। প্রবীণদের পেনশন চালু করতে হবে। ন্যূনতম পেনশন যথেষ্ঠ পরিমাণে বৃদ্ধি করতে হবে।
(১০) কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেটে আরও ব্যয়-বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
(১১) অতিমারী সময়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের জন্য সুরক্ষা এবং পেনশন চালু করতে হবে।
(১২) মনরেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করো এবং তা শহরেও লাগু করো।