E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮

সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা সম্মেলনের আহ্বান

পার্টিকে ত্রুটি ও নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত ও শক্তিশালী করে সংগ্রামী ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে

সন্দীপ দে


সম্মেলনে রক্তপতাকা উত্তলোন করছেন পার্টির প্রবীণ নেতা নিরঞ্জন চ্যাটার্জি।

ত্রুটি ও নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত পার্টি গড়ে তোলো এবং শ্রমজীবী মানুষকে সমবেত করে শ্রেণি আন্দোলন ও গণ আন্দোলন গড়ে তোলো - সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা ২৫তম সম্মেলন থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। এই সম্মেলন পার্টি ও গণ সংগঠনের সক্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি পার্টির কাজের ধারার উন্নতি ঘটানো ও নীতি-আদর্শে বলীয়ান ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ার ডাক দিয়েছে। এছাড়াও সম্মেলন বামঐক্যকে শক্তিশালী করারও আহ্বান জানিয়েছে।

গত ৩ থেকে ৫ মার্চ কমরেড রাজদেও গোয়ালা, কমরেড বাদল কর, কমরেড দেবব্রত বিন্দু নগরে (প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবন) এবং কমরেড নির্মলচন্দ্র দে মঞ্চে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩ মার্চ সকালে সম্মেলনের রক্তপতাকা উত্তোলন করেন পার্টির প্রবীণ নেতা নিরঞ্জন চ্যাটার্জি। শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধিরা। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু, রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, সুজন চক্রবর্তী, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অনাদি সাহু সহ পার্টি নেতা অসীম দাশগুপ্ত, দীপক দাশগুপ্ত প্রমুখ।

এই সম্মেলন পরিচালনা করেন কেষ্ট সরকার, দীপঙ্কর দে, আনোয়ারা মির্জা, দেবাঞ্জন চক্রবর্তী এবং রূপা বাগচীকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।

জেলা সম্মেলন উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন শমীক লাহিড়ী।

নতুন কমিটি

সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা ২৫তম সম্মেলন থেকে আগামী দিনের লড়াই-আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৬৫ জনের নতুন জেলা কমিটি সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হয়েছে। সম্মেলন মঞ্চে জেলা কমিটির প্রথম বৈঠকে জেলা সম্পাদক হিসেবে কল্লোল মজুমদার পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা কমিটিতে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে থাকছেন কেষ্ট সরকার, দীপঙ্কর দে এবং রতন ভট্টাচার্য।

সম্মেলন থেকে পার্টির আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের জন্য ২১জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া ৬জন বিকল্প প্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছেন।

গৃহীত প্রস্তাব

এই সম্মেলন থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও পরিষেবায় মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে; কর্মসংস্থান ও বন্ধ কলকারখানা খোলার দাবিতে; ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সপক্ষে; শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণের বিরুদ্ধে; মোদি সরকারের গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সপক্ষে; রাজ্য সরকারের দুর্নীতি,সন্ত্রাস ও গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে; শ্রমকোড, পণ্য পরিষেবা কর বাতিলের দাবিতে; কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে পরিচালিত গৌরবজনক, সফল কৃষক আন্দোলনকে অভিনন্দন জানিয়ে; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার সপক্ষে ও সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে; তপশিলি জাতি ও আদিবাসীদের উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা; কলকাতার পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের দাবিতে; তৃতীয় লিঙ্গের ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সমানাধিকারের পক্ষে ও তাদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলা; কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ও পার্টির অভ্যন্তরে স্থায়ী আইসিসি গঠনের সপক্ষে; ২৮-২৯ মার্চ, ২০২২ সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট সফল করার আহ্বান জানিয়ে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সশস্ত্র বিরোধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার সপক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এছাড়া আগামী ১৫ থেকে ১৭ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিতব্য পার্টির রাজ্য ২৬তম সম্মেলন সফল করার লক্ষ্যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।

উন্নত চেতনাসম্পন্ন মতাদর্শে দৃঢ় পার্টি গড়ে তুলতে হবে

এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শমীক লাহিড়ী। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, একটা প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের পার্টির কাজ পরিচালনা করতে হচ্ছে। আমাদের উপর দৈহিক, মতাদর্শগত আক্রমণের পাশাপাশি রুটি-রুজির উপরও আক্রমণ নেমে আসছে। এই সমস্ত আক্রমণ মোকাবিলা করে আমরা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে লড়াই-আন্দোলন সংগঠিত করছি। সম্মেলনে আমাদের বোঝাপড়া করতে হয় কোন শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে,তাদের চেহারাটা কী? আমাদের মূল লক্ষ্য পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই। পুঁজি একরূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় না। তার শোষণ করার কায়দার রূপান্তর ঘটে। নব্বইয়ের দশক থেকে একমুখী বিশ্ব হবার সু্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক ফাটকা পুঁজি প্রতিরোধহীন বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে। এই ফাটকা পুঁজিই দেশে দেশে ধান্দার ধনতন্ত্র তৈরি করে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনই একটা ব্যবস্থায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, শ্রমিকের মজুরি কমছে, অন্যদিকে কর্পোরেট পুঁজির মুনাফা বিপুল পরিমাণে বাড়ছে। এদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে কেন্দ্রের মোদি ও রাজ্যের মমতা সরকার। এরা মানুষের মতামতকেও নিয়ন্ত্রণ করছে, প্রভাবিত করছে। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় ‘আগে রাম পরে বাম’ ও রাজ্যের বিধানসভা ভোটের সময় ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ইত্যাদি স্লোগানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেখা গেছে উভয় ক্ষেত্রেই মানুষ যা চেয়েছেন, তা না করে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে অন্যত্র ভোট দিয়েছেন। তাই এদের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে লড়াই চালাতে হবে। এজন্য শক্তিশালী ও আদর্শে দৃঢ় পার্টি গড়ে তোলা প্রয়োজন।

বর্তমান পরিস্থিতিতেও যেভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠছে তার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, দিল্লিতে যে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে তা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। এই আন্দোলনের সলতে পাকানোর ক্ষেত্রে বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই আন্দোলনের আগে মুম্বাইয়ে সারা জাগানো কিষান লং মার্চ হয়েছে, রাজস্থানে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে ২৩ দিন ধরে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখার মতো বিভিন্ন আন্দোলন এবং মন্দসৌরে ৬ জন শ্রমিকের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর প্রতিবাদে আন্দোলন ইত্যাদি দিল্লির কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তাই শুধুমাত্র কর্মসূচি পালন নয়, মানুষের কাছে দাবি আদায়ের আন্দোলনকে নিয়ে যেতে হবে।

শমীক লাহিড়ী বলেন, নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ধান্দার ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে পার্টিকে নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত করতে হবে। পার্টির কলকাতা প্লেনামে যে গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হয়েছে সেই লক্ষ্যে মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পার্টির দৃশ্যমানতা জনমনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনের লক্ষ্যে উন্নত চেতনাসম্পন্ন মতাদর্শে বলীয়ান ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তুলতে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পাদকীয় প্রতিবেদন

সম্মেলনে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করে বিদায়ী সম্পাদক কল্লোল মজুমদার উল্লেখ করেন, বর্তমান সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বহু ধারায় প্রবাহিত সামাজিক কার্যকলাপ, গণআন্দোলন ও গণসংগঠন গড়ে তুলতে না পারলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিটা আমাদের কাছে বড়ো চ্যালেঞ্জ আকারেই থেকে যাবে। শত্রুপক্ষের কোটি কোটি টাকার প্রচারকে মোকাবিলা করে পার্টি, শ্রেণি ও জনগণের অ্যাজেন্ডা আমাদের সামনে আনতে হচ্ছে। আমাদের সামর্থ্য উজাড় করে দিয়ে কার্যকরী নিবিড় প্রচারের সবরকম কৌশল আমাদের উদ্ভাবন ও আয়ত্ত করতে হবে। তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, পুরনো ঐতিহ্যবাহী প্রচার কৌশলের পাশাপাশি সোশ্যাল নেট ওয়ার্ক ও মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত আধুনিক প্রচারের কৌশলগুলি আরও তৎপরতার সাথে ব্যবহার করার উপযোগী উদ্যোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

তিনি শ্রমজীবী মানুষ, সংখ্যালঘু, হিন্দিভাষী, মহিলা ও তরুণদের আরও বেশি করে পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, শাসকশ্রেণির লাগাতার আক্রমণের মুখেও লড়াইয়ের ময়দানে থাকা কমরেডদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং দোদুল্যমান কমরেডদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বুথভিত্তিক সংগঠন ও সারা বছর কাজের জন্য বুথ ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

কল্লোল মজুমদার কঠিন পরিস্থিতিতে উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণের জন্য পার্টি কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও মতাদর্শগত চেতনায় উন্নীত করার কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি নিষ্ক্রিয়তামুক্ত পার্টি, গণলাইনসম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলনের পাশাপাশি আশু ও স্থানীয় আদায়যোগ্য দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

সম্মেলনে আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রাহুল ভট্টাচার্য।

প্রতিনিধিদের আলোচনায় মূর্ত হয়েছে লড়াইয়ের বার্তা

খসড়া প্রতিবেদনের উপর ৮৪ জন প্রতিনিধির প্রাণবন্ত আলোচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে সম্মেলন। প্রতিনিধিরা সমালোচনা-আত্মসমালোচনার আলোকে যে মূল অভিমুখ স্থির করেছেন তা হলো, পার্টিকে আদর্শগত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে মানুষের দাবিদাওয়ার আন্দোলন, মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাবার পথ রচনা করতে হবে। গণ আন্দোলন-শ্রেণি আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কলকাতা মহানগরীর সংগ্রামী ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রতিনিধিদের আলোচনায় করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের অভিঘাতে মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, মৃত্যুর ভ্রূকুটি, বিশেষকরে গরিব শ্রমজীবী অংশের মানুষের দুর্বিষহ অবস্থার কথা বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তাঁরা বলেছেন, অতিমারীর সময়ে কেন্দ্রের সরকার আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে একের পর এক জনবিরোধী আইন নিয়ে এসেছে। আক্রান্ত মানুষদের পাশে না দাঁড়িয়ে রাম মন্দিরের শিলান্যাসের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিকে দেশের বুকে প্রোথিত করতে চেয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে। তিনটি শ্রমকোডের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির উপর মারাত্মক আঘাত নামিয়ে এনেছে। কিন্তু মানুষ ঘরে বসে থাকেনি। অতিমারীর ভয়াবহতার মধ্যেও পার্টি ও বামপন্থীদের আহ্বানে সাধ্যমতো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলনে শামিল হয়েছে,বিপন্ন-আক্রান্ত মানুষদের পাশে থেকেছে। এই প্রসঙ্গেই প্রায় সমস্ত এরিয়া কমিটির প্রতিনিধির আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ ও মৃত্যু মিছিলের আবহে জীবন বিপন্ন করে বামপন্থী ছাত্র-যুবদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘রেড ভলান্টিয়ার’দের অনন্য ভূমিকার কথা। তাঁরা বলেছেন, এই মানবিক উদ্যোগে বামপন্থী পরিবৃত্তের বাইরেরও অসংখ্য ছাত্র-যুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। তাদের উদ্যোগেই কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে শ্রমজীবী ক্যন্টিন, শ্রমজীবী বাজার, স্বাস্থ্য শিবির, রক্তদান শিবির ইত্যাদি। এছাড়াও রেড ভলান্টিয়াররা অতিমারী সংক্রমণের বিভীষিকার মধ্যেও আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসা, আকস্মিক লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত, বিপন্ন মানুষদের ত্রাণ-সাহায্য দেওয়া, খাবার ও সুরক্ষা সামগ্রী বণ্টন, এলাকায় এলাকায় স্যানিটাইজেশনের পাশাপাশি ভিন রাজ্য থেকে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের নানাভাবে সাহায্য প্রদান ইত্যাদি বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নজির গড়েছেন। প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে অতিমারীর সময়ে যখন রাজ্য সরকারের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোগ গ্রহণ বিশেষভাবে জরুরি ছিল, তখন এসব উদ্যোগ নিতে সরকারকে দেখা যায়নি।

বেহালা, কসবা, বেলেঘাটা সহ বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে কীভাবে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে বাইরে থেকে দুর্বৃত্তদের এনে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ভোট লুট করে নির্বাচনকে কার্যত প্রহসনে পরিণত করেছে। তাঁরা বলেছেন, বিভিন্ন অঞ্চলে এই লুটেরা বাহিনীকে প্রতিরোধ করে মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পার্টিকে তীব্র লড়াইয়ের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে পার্টির অনেকটা সাফল্য এসেছে, ভোটের হার বিগত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে এবং বিজেপি’র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পিছনে ফেলে শাসকদলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বামফ্রন্টকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।

প্রতিনিধিরা বলেছেন, এন্টালির পটারি শিল্প, বেলেঘাটা অঞ্চলের অসংখ্য ছোটো ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়েছে। বাকি শিল্প ধুঁকছে। এদিকে বন্ধ কারখানার জায়গাগুলোতে গড়ে উঠছে আবাসন। তাতে শাসকদলের কাটমানির কারবার চলছে রমরমিয়ে। অন্যদিকে বন্ধ কারখানার শ্রমিকেরা দুঃসহ অবস্থার মধ্যে পড়ে চলে গেছেন অন্যত্র। অনেকেই পরিবার নিয়ে তীব্র সংকটের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। একইভাবে এই জমানায় বস্তিগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেই জমি প্রমোটারদের হাতে তুলে দেবার চক্রান্ত চলছে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মূল লক্ষ্য ছিল বস্তি রেখে বস্তির উন্নয়ন। এছাড়া ওই আমলের ১৯৮১ সালের ঠিকা টেনান্সি অ্যাক্টকে নস্যাৎ করে গরিব বস্তিবাসীদের জীবনে সংকট নামিয়ে এনেছে। অনেক বস্তিকে প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘাঁটিতে পরিণত করার চক্রান্ত চলছে। বস্তির কিছু এলাকার মধ্যে ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তানে’র স্লোগান দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিভাজনের রাজনীতিতে মেতে উঠেছে। এছাড়া তৃণমূল-বিজেপি উভয়েই সংখ্যালঘুদের নিয়ে স্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। সোশ্যাল মিডিয়া সহ নানাভাবে চলছে অপপ্রচার। এই অবস্থায় গরিব শ্রমজীবী ও বস্তিবাসীদের অধিকার রক্ষায় লড়াই চালাতে হচ্ছে পার্টিকে।

প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে অতিমারীর সময়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন অসংগঠিত শ্রমিকরা। এছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় শ্রমিকদের অধিকারের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নেমে এসেছে। কোথাও নতুন নিয়োগ নেই। বন্দর, বিদ্যুৎ, কলকাতা কর্পোরেশনে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে ঠিকা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এই নিয়োগও হচ্ছে শাসকদলের মাধ্যমে। নিজেদের পছন্দ অনুয়ায়ী শ্রমিকদের কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ডিপোতে গিয়ে পরিবহণ শ্রমিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ক্রমান্বয়ে সরকারি পরিবহণ কমতে থাকায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। প্রতিনিধিরা বলেছেন, গরিব সাধারণ মানুষের স্বার্থে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই,তারা ভোটের স্বার্থে সরকারি কোষাগার ভেঙে পাইয়ে দেবার রাজনীতি করছে।

এই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা, শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষায় বেসরকারিকরণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে ও ফি কমানো এবং কর্মসংস্থানের দাবিতে, এসএসসি-টেট সহ নিয়োগে দুর্নীতির প্রতিবাদে, রাজ্যে শিল্পস্থাপনের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দাবির পাশাপাশি সাম্প্রতিক ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যার প্রতিবাদে ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে ছাত্র-যুবদের দুরন্ত লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন প্রতিনিধিরা। একইসঙ্গে তাঁদের উপলব্ধি, তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীদিনে স্থানীয় ও আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলনে জয়কে ছিনিয়ে আনতে হবে।

প্রতিনিধিরা বলেছেন, বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদী আগ্রাসন ও শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াইকে তীব্র করা জরুরি। সেজন্য শ্রেণি ঘৃণাকে জাগাতে হবে। এই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে। তাঁরা পার্টির শতবর্ষ অতিক্রান্ত হওয়ায় গর্ব অনুভব করার পাশাপাশি পার্টির রাজনীতির যে মূল ভিত্তি শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা ও শ্রেণি সংহতিকরণের কথাও দৃঢ়তার সঙ্গেই উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা এই উপলব্ধির কথাও বলেছেন যে, মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের কথা ধৈর্যের সাথে শুনতে হবে। পার্টির রাজনীতি ও বক্তব্যকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পার্টির পত্র-পত্রিকার প্রচার, অবাঙালি বিশেষ করে উর্দুভাষী অঞ্চলে পার্টির বক্তব্যকে তুলে ধরতে তাদের ভাষায় মুখপত্র ও প্রচার পুস্তিকার প্রচারের গুরুত্বের কথা তাঁরা ব্যক্ত করেছেন। প্রতিনিধিরা মনে করেন, কেবল রুটিন মাফিক কর্মসূচি করলে হবেনা, দাবি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই লড়াই-আন্দোলনের প্রবাহের মধ্য দিয়ে শ্রেণি চেতনাকে বৃদ্ধির পাশাপাশি পার্টিকে আরও শক্তিশালী করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রতিনিধিরা। প্রতিনিধিরা দেশ ও মানুষের স্বার্থে আগামী ২৮-২৯ মার্চ শ্রমিক-কর্মচারীদের ডাকা সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট সফল করতে সর্বশক্তি নিয়ে পথে নামার কথাও দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন।

জবাবি ভাষণ

প্রতিনিধিদের সজীব ও প্রাণবন্ত আলোচনা শেষে জবাবি ভাষণ দেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক কল্লোল মজুমদার। তিনি প্রতিনিধিদের বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্টির নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি পার্টির নিজস্ব কার্যকলাপের বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। তা দিয়েই সব আক্রমণকে মোকাবিলা করা যাবেনা। তাই বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে সংহত করাও জরুরি। রাজ্যে বামফ্রন্টের শক্তিও বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বিগত কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, সেই নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সংহত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন,আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আন্দোলনের আঙ্গিকও প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে হবে। দিল্লির কৃষক আন্দোলন থেকে প্রেরণা নিয়ে সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের আগামীর লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হতে হবে।

রাজ্য নেতৃত্বের পর্যবেক্ষণ

পার্টি নেতা রবীন দেব আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে চীনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, কোভিড পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে চীন যেমন সাফল্য অর্জন করেছে, তেমনি বিকাশের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটিয়েছে। বিগত নির্বাচনগুলিতে পার্টির রণকৌশলগত লাইন ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, সিপিআই(এম) গড়ে ওঠার সময় থেকেই মূল শত্রুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার কৌশল গ্রহণ করে এসেছে। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি ৩৬২ জনের মধ্যে ৩৩২ জনই ছিলেন বাংলার। তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে যোগ দিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জেলারও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। শতবর্ষ-উত্তীর্ণ এই পার্টির জন্য আমরা গর্বিত।

তিনি বলেছেন, তৃণমূল-বিজেপি সহ সমস্ত প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উপযুক্ত পার্টি গড়ে তুলে শত্রুর বুকে কাঁপন ধরাতে হবে। আগামী ২৮-২৯ মার্চ সর্বভারতীয় ধর্মঘটকে সর্বতোভাবে সফল করে কলকাতার সংগ্রামী ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সম্মেলনের সমাপ্তি পর্বে সূর্য মিশ্র পার্টির বিভিন্ন স্তরে বয়ঃসীমা সংক্রান্ত বিধি ব্যাখ্যা করেন।

প্রতিনিধি পরিচিতি

সম্মেলনের শেষ পর্বে প্রতিনিধি পরিচিতি সংক্রান্ত রিপোর্ট পেশ করেন পরিচিতি কমিটির আহ্বায়ক দেবেশ দাস। সম্মেলনে ৩৪৭ জন প্রতিনিধি ও ৯৯ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ছিলেন দিলীপ সেন, বয়স ৮২ বছর, দর্শকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ ছিলেন নিত্যগোপাল রায়,বয়স ৮৯। নিত্যগোপাল রায় স্বাধীনতা আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছেন। প্রতিনিধি ও দর্শকদের মধ্যে দীর্ঘ পার্টি জীবন তাঁরই। তিনি ১৯৫২ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। সম্মেলনে সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৩ বছর এবং দর্শকদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছিলেন আফরিন বেগম, ২৫ বছর। সম্মেলনে শ্রমিক প্রতিনিধি ছিলেন ৩৪ জন এবং দর্শক ৮ জন। রাজনৈতিক কারণে জেলে গেছেন ৪৪ জন প্রতিনিধি এবং দর্শকদের মধ্যে ১৯ জন। সবচেয়ে বেশি সময় কারাবাসে কাটিয়েছেন প্রদীপ গাঙ্গুলি, ১ বছর ৬ মাস, দর্শকদের মধ্যে প্রভাত চ্যাটার্জি, ১ বছর ২ মাস। রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ১২২ জন প্রতিনিধি এবং ২৭ জন দর্শক। বিগত তিন বছরে রাজনৈতিক কারণে আক্রান্ত হয়েছেন ১২১ জন প্রতিনিধি এবং ২৭ জন দর্শক। পার্টির কাজে আত্মগোপনে ছিলেন ৩০ জন প্রতিনিধি ও ১২ জন দর্শক।