৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮
সিপিআই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্মেলনের আহ্বান
পরিস্থিতির চাহিদা পূরণের উপযোগী আদর্শে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী পার্টি গড়ে তুলতে হবে
সন্দীপ দে
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ২৫তম সম্মেলনের উদ্বোধন করছেন শ্রীদীপ ভট্টাচার্য।
পার্টিকে আরও ঐক্যবদ্ধ,শক্তিশালী ও পরিস্থিতির চাহিদা পূরণের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। সমস্ত জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে শ্রেণি আন্দোলন ও গণ আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তন করতে হবে। সিপিআই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ২৫ তম সম্মেলন থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। ৭ থেকে ৯ মার্চ কমরেড রঞ্জিত কুণ্ডু নগরে (নৈহাটি), কমরেড রবীন মণ্ডল মঞ্চে (ঐকতান মঞ্চ) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনের রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ পার্টি নেতা সুবোধ দে। তিনি ছাড়াও শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, রেখা গোস্বামী, রাজ্য কমিটির সদস্য অলকেশ দাস প্রমুখ। পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম এবং পার্টি নেতা গৌতম দেব সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
এই সম্মেলন পরিচালনা করেন গৌতম দেব, সুভাষ মুখার্জি, নেপালদেব ভট্টাচার্য, মহম্মদ সেলিম গায়েন, মানস মুখার্জি, রমলা চক্রবর্তী, নিরাপদ সর্দার ও পঙ্কজ ঘোষকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।
প্রতিনিধি সম্মেলনের সূচনায় শহিদ স্মরণে ও শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন নেপালদেব ভট্টাচার্য। আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন পলাশ দাস।
সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক মলয় ভট্টাচার্য প্রতিনিধিদের উদ্দেশে স্বাগত ভাষণ দেন।
গৃহীত প্রস্তাবাবলি
এই সম্মেলন থেকে বেশকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ সমাজতন্ত্রই মানব সমাজের ভবিষ্যৎ - আসুন আমরা সেই পথ ধরে চলার অঙ্গীকার করি; সাম্রাজ্যবাদ ও লগ্নি পুঁজির বিরুদ্ধে; সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে; শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী শ্রমকোড বাতিলের বিরুদ্ধে; কৃষকের ফসলের ন্যায্য দামের দাবির সপক্ষে; খেতমজুরদের দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি ও বছরে ২০০ দিনের কাজের দাবিতে ও দুর্নীতির প্রতিবাদে; কৃষক আন্দোলনের জয়কে অভিনন্দন জানিয়ে; জাতীয় শিক্ষানীতি ও ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে; অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে; জনবিরোধী কর্পোরেট দরদি মোদি সরকারের সর্বনাশা নীতির বিরুদ্ধে তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে তোলার সপক্ষে; নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে; কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়নের দাবিতে; বন্ধ কলকারখানা খোলার দাবিতে; কোভিড অতিমারী মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে; আদিবাসীসহ সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নততর জীবন-জীবিকার দাবিতে; সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলার সপক্ষে; পরিবেশ সচেতন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে; কু-সংস্কার মুক্ত যুক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞানমনস্ক মনন গড়ে তোলার অঙ্গীকার গ্রহণের পক্ষে; চাই নিরক্ষরতা মুক্ত দেশ; জনবিরোধী অগণতন্ত্রিক স্বৈরাচারী তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে; ২৮ ও ২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী অধিকারের সপক্ষে একটি প্রস্তাব সম্মেলনে গৃহীত হয়।
এই সম্মেলনে জেলার ১৯,৯৭৯ জন সদস্যের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি ও দর্শক মিলিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলন থেকে পার্টির আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের জন্য ৩৫ জন প্রতিনিধি ও দুজন দর্শক নির্বাচিত হয়েছেন। সময়াভাবের জন্য সম্মেলন মুলতবি রাখা হয়। রাজ্য নেতৃত্ব অধিবেশন ডেকে সম্মেলনের বাকি কাজ সম্পন্ন করবেন বলে ঠিক হয়েছে।
সম্মেলন উদ্বোধন
সিপিআই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ২৫তম সম্মেলন উদ্বোধন করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। তিনি তাঁর বক্তব্যের সূচনায় কমিউনিস্ট পার্টিতে সম্মেলনের গুরুত্ব, রাজ্যের গণ আন্দোলন, শ্রেণি আন্দোলনের ইতিহাসে এই জেলার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্ব পুঁজিবাদ আজ গভীর সংকটের আবর্তে পড়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলায় সাফল্য দেখাতে পারলেও এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী দেশগুলো চরম ব্যর্থ হয়েছে। ১৯১৬ সালে লেনিন লিখেছিলেন, পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়। আজকে শিল্পপুঁজি ও ব্যাঙ্ক পুঁজির মিলনে লগ্নিপুঁজির ফাটকামুখী কার্যধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমেই মুনাফা অর্জন করছে। মার্কস দেখিয়েছিলেন পুঁজির লুঠেরা চরিত্র। আজকের দিনে যা ধান্দার ধনতন্ত্র বা লুঠেরা পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ তার বর্তমান সংকটের বোঝা থেকে পরিত্রাণ পেতে শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষের উপর সংকটের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দেশে দেশে প্রতিবাদী আন্দোলনও তীব্র হচ্ছে।
তিনি দেশের পরিস্থিতির উল্লেখ করে বলেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ভারতের বৃহৎ পুঁজি ও কর্পোরেটদের মদতে চলছে। এরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে শাসন চালাচ্ছে। এদের শাসনে ধনী আরও ধনী, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এই শাসনে বেকারি, কর্মহীনতা, স্বাস্থ্যহীনতা আরও প্রকট হয়েছে। এরা জিডিপি নিয়ে রঙিন ছবি আঁকার চেষ্টা করছে, কিন্তু বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন দেশের অর্থনৈতিক সংকট কতটা তীব্র হয়েছে। এই অবস্থায় সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বনাশা কৃষি আইন এনেছিল, যদিও প্রবল আন্দোলনের চাপে এই আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে। এছাড়া শ্রমকোডের মধ্যদিয়ে শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। জনগণের সম্পদকে দেশি-বিদেশি পুঁজির কাছে বিকিয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের জনগণের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইও তীব্র হচ্ছে। দেশের কৃষক আন্দোলন দেশের লড়াই-আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রেরণা সঞ্চার করছে। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটে নতুন ইতিহাস রচিত হবে।
তিনি বলেন, এই সময়ে মতাদর্শের উপর আক্রমণ, শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ মারাত্মকভাবে আক্রমণ করছে। জাতি, ধর্ম, ভাষার নামে মানুষের মধ্যে নানাভাবে বিভেদকে জাগিয়ে তুলে শ্রেণি চেতনাকে অবদমিত করতে চাইছে। আমাদের দেশে আরএসএস সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি সংখ্যালঘুদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। রাষ্ট্র তাতে মদত দিচ্ছে।
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন, এখানে চরম স্বৈরাচারী একটা সরকার চলছে। এরা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে তৃণমূল-বিজেপি-এই দ্বি-দলীয় তত্ত্বের প্রচারকেই তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা ছাড়াও শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবদের আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। বিশ্ব পুঁজিবাদ আজ মন্দার জন্য চাইছে উন্মুক্ত বাজার। সেখানে প্রধান বাধা সিপিআই(এম)। তাই সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা যাতে এগোতে না পারে তাই পুঁজিবাদ এই সমস্ত শক্তিকে মদত দিচ্ছে। একদিন নিশ্চয়ই এই সত্য উদঘাটিত হবে। এই সমস্ত কিছুকে মোকাবিলার লক্ষ্যেই পশ্চিমবঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। তিনি সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, শাসকদলের সন্ত্রাস মোকাবিলা করেই আমরা এগিয়েছি,কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা সত্ত্বেও সাফল্যও এসেছে।
তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গে আমাদের গুরুতর সমস্যা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার সমস্যা। আমাদের শ্রেণি ও জনগণ থেকে যে বিচ্ছিন্নতা হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করতে হবে। মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যা শত্রুর বুকে কাঁপন ধরাতে পারে। স্থানীয় ও আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে আমাদের। তাই এই লক্ষ্যে এগোতে গেলে চাই বিপ্লবী পার্টি, প্লেনাম যে গণ লাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ার নির্দেশ দিয়েছে। মার্কসবাদী হিসেবে উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সৃজনশীলতাকে যুক্ত করে শ্রেণি আন্দোলন গণ-আন্দোলনকে তীব্র করেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে আমাদের। এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সম্মেলন থেকে এই অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের।
খসড়া প্রতিবেদন উত্থাপন
সম্মেলনে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন পার্টির বিদায়ী জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলিতে আমরা অসংখ্য আন্দোলন কর্মসূচি সংগঠিত করেছি। তৃণমূল পঞ্চায়েত, পৌর সভায় কাটমানি, স্বজন পোষণ, তোলাবাজি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে লুঠের রাজত্ব চালাচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে আমাদের ভূমিকায় ঘাটতি রয়েছে। তবে কোভিড পরিস্থিতিতে আক্রান্ত ও বিপন্ন মানুষদের স্বার্থে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি। আমফান ঝড়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের কোটি কোটি টাকা লুটের বিরুদ্ধে আমরা বঞ্চিত ও অসহায় মানুষদের নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত করতে পেরেছি। তিনি বলেন,আমরা কর্মসূচি করেছি অনেক। কিন্তু কর্মসূচি আর আন্দোলন এক নয়। সারদা, নারদা সহ তৃণমূলের দুর্নীতি, গণতন্ত্র হত্যা থেকে বর্তমানে আনিস খান হত্যার প্রতিবাদে অসংখ্য বিষয় আমাদের সামনে রয়েছে। সেই সমস্ত আন্দোলনগুলিকে সফলতার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে আমাদের।
তিনি বলেন কর্পোরেট মিডিয়া আমাদের বিরুদ্ধে নানাভাবে অপপ্রচার করছে। তৃণমূল-বিজেপি এই দ্বি-দলীয় তত্ত্বকেই সামনে আনছে। এর ফলে মানুষও বিভ্রান্ত হচ্ছে। আন্দোলনের ময়দানে যে মানুষদের আমরা সঙ্গে পাচ্ছি, তাদের কথা শুনতে হবে, সংগঠিত করতে হবে। আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে হলে শাখা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, বুথ সংগ্রাম কমিটিকে সবল করতে হবে। তিনি মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন - এই চারটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বর্তমান পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য লড়াইকে তীব্র করার আহ্বান জানান।
পরিস্থিতি পরিবর্তনের উপযোগী শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে
প্রতিবেদনের উপর আলোচনায় প্রতিনিধিরা সর্বাগ্রে নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। প্রায় প্রতিটি এরিয়া কমিটির প্রতিনিধির আলোচনায় উঠে এসেছে তৃণমূল রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকে পার্টির উপর কীভাবে অত্যাচার-নির্যাতন নামিয়ে এনেছে। ভোটলুট, সন্ত্রাস, বামপন্থীদের উপর আক্রমণ, ভোট দিতে বাধা দেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নির্বাচনগুলিকে প্রহসনে পরিণত করেছে শাসকদল। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনেও এর কুৎসিত নজির দেখা গেছে। এর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন পৌর এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ভোট সন্ত্রাসের মধ্যেও গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোটের হার বেড়েছে। প্রচার মাধ্যমে সৃষ্টি করা মেরুকরণে বিজেপি’র যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল, পৌর নির্বাচনে তা ধাক্কা খেয়েছে। বিজেপি’র ভোটের হার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে বামফ্রন্টের দিকে জনসমর্থনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে।
প্রতিনিধিরা বলেছেন, বাদুড়িয়া, দেগঙ্গা, হাড়োয়া, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসের পরিস্থিতি রয়েছে। অসংখ্য পার্টি কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে, অনেকে এখনো রয়েছেন জেলের অভ্যন্তরে। তার মধ্যেও জেলার সর্বত্র তৃণমূলের অপশাসন, দুর্নীতি, লুটের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের দাবি দাওয়া ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালাচ্ছেন পার্টি কর্মীরা। বিশেষ করে আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া ও অর্থ লুটের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষদের সংগঠিত করে পার্টির নেতৃত্বে ব্লক ও গ্রাম পঞ্চায়েতস্তরে আন্দোলন বিশেষ মাত্রায় পৌঁছায় এবং আন্দোলনের চাপে তৃণমূলের লুটেরা বাহিনী অনেক জায়গাতেই অসহায় গরিব মানুষকে তাঁদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
এছাড়াও প্রায় সমস্ত এরিয়া কমিটির প্রতিনিধির বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে কোভিড সংক্রমণের ভয়াবহতার মধ্যেও জেলার সর্বত্র পার্টি ও ছাত্র-যুবদের উদ্যোগে আক্রান্ত ও বিপন্ন মানুষদের স্বার্থে কীভাবে ত্রাণ সাহায্যের কাজ সংগঠিত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা ‘রেড ভলান্টিয়ার’রা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসা, অসহায় মানুষ বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেইসঙ্গে এলাকায় এলাকায় দূষণমুক্ত করার অভিযান, সুরক্ষা ও খাদ্য সামগ্রী বিলি করেছেন। এছাড়া আমফান-বিধ্বস্ত নদী বেষ্টিত ভাঙন কবলিত এলাকার গৃহহীন মানুষদেরও নানাভাবে সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন।
প্রতিনিধিরা বলেছেন, সাংগঠনিক নানা ত্রুটি-দুর্বলতার জন্য পার্টির যে জনবিচ্ছিন্নতা বেড়েছে, তা কাটিয়ে উঠে গরিব শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে আন্দোলন চলছে। এই সময়কালে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম, সার-বীজ সহ ফসলের উপকরণের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এবং কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে জেলার বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে। প্রতিনিধিরা বলেছেন, কৃষি এখন লাভজনক না হওয়ায় ও অনেক জায়গাতেই কৃষি জমিতে ভেড়ি, ইটভাটা, পুকুর ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। কৃষিতে কাজ না থাকায় গ্রামাঞ্চলে অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে কৃষক সহ গ্রামীণ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জীবন-জীবিকার স্বার্থে লড়াইকে আরও তীব্র করার উপর জোর দেন প্রতিনিধিরা।
এছাড়াও প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, তৃণমূল জমানায় জেলার শিল্পাঞ্চলে তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। একের পর এক চটকল বন্ধ হয়ে গেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পেও ধস নেমেছে। এরমধ্যে যে কয়েকটি টিকে আছে, সেসব জায়গায় শাসক দলের দৌরাত্ম্য চরমে। শাসকদলের মরজি অনু্যায়ী কাজ মিলছে, নির্বিচারে কাজ থেকে বসিয়েও দেওয়া হচ্ছে। তোলাবাজি, কাটমানি, হুমকি ইত্যাদি চলছে ব্যাপক মাত্রায়। এই অবস্থার মধ্যেও সাধ্য অনুযায়ী বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো এবং শ্রমিকদের স্বার্থে এবং শিল্প স্থাপনের দাবিতে লড়াই চলছে।
প্রতিনিধিরা বলেছেন, একশো দিনের কাজে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে। জব কার্ড থাকলেও কাজ মিলছে না। এ নিয়ে গরিব মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমা হচ্ছে। এছাড়া দ্বীপাঞ্চল ও সীমান্ত এলাকার মানুষের সমস্যা, কিছু এলাকায় বিএসএফ’র তাণ্ডব, পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে অসন্তোষের কথাও উঠে এসেছে প্রতিনিধিদের আলোচনায়।
তাঁরা বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলার উপযোগী পার্টি গড়ে তুলতে হবে। এই লক্ষ্যে আদর্শগত ভিতকে মজবুত করেই পার্টিকে সুদৃঢ় করা জরুরি। বর্তমানে শুধু প্রতীকী আন্দোলনের কর্মসূচি করলেই হবে না, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগঠিত করে জনমানসে পার্টির ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের দাবি নিয়ে নতুন উদ্ভাবনী স্লোগানে নতুন আঙ্গিকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পার্টির জনভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার অঙ্গীকার করেছেন প্রতিনিধিরা।
শতাধিক প্রতিনিধির আলোচনা শেষে বিদায়ী সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তীর জবাবি ভাষণের পর খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনটি গৃহীত হয়েছে।
রাজ্য নেতৃত্বের পর্যবেক্ষণ
পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, শ্রেণি ও সামাজিক বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে আমাদের লড়াই। তার জন্য মতাদর্শের প্রয়োগই হলো আসল কথা,তার জন্যই রাজনীতি, সংগঠন ও সংগ্রাম। এর একটাকে আরেকটা থেকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু পরিস্থিতির যখন দ্রুত বদল ঘটে তখন সেই বদলকে নজরে রেখে মতাদর্শ প্রয়োগের রাজনীতি করতে হয়।
তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে দেশের রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে গেছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে বসায়। আরএসএস এদের চালিকাশক্তি। এরাজ্যের তৃণমূল কখনো আরএসএস’র বিরোধিতা করেনি। তৃণমূল তৈরি হওয়া, নির্বাচনী প্রতীক লাভ এবং দলীয় রেজিস্ট্রেশনে মদত রয়েছে আরএসএস’র। তাই দেশে বিজেপি’কে পরাজিত করতে পারলে এরাজ্যে তৃণমূল পায়ের তলায় মাটি পাবে না।
তিনি বলেছেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানোর জন্য বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের সামনে। তার জন্য আমাদের বুথস্তর থেকে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব সব অংশের মানুষকে সংগ্রামে শামিল করতে হবে। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের মতো এরাজ্যেও বুথস্তর থেকে গণসংগ্রাম গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের।