৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮
সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা ২৫তম সম্মেলনের আহ্বান
নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে বুথকেন্দ্রিক গণভিত্তিকে প্রসারিত করো
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্মেলন উদ্বোধন করছেন কল্লোল মজুমদার।
দীর্ঘস্থায়ী নাছোড়বান্দা আন্দোলন গড়ে তুলতে গণ লাইন সম্পন্ন মতাদর্শে দৃঢ় মজবুত সক্রিয় পার্টি গড়ে তুলতে হবে। তাই সুবিধাবাদী ঝোঁক মুক্ত হয়ে বুথকেন্দ্রিক গণভিত্তিকে প্রসারিত করতে হবে। শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মধ্যদিয়েই রুখতে হবে দক্ষিণপন্থার বিপদকে - এই আহ্বান জানিয়ে শেষ হলো সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ২৫তম সম্মেলন। গত ৬ মার্চ তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলন শুরু হয় জয়নগরে।
এই সম্মেলন থেকে ৬০ জনের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়েছে। আপাতত ৫৯ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। পরে একজন মহিলা সদস্যকে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। নতুন জেলা কমিটিতে ১১ জন নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। সম্মেলন মঞ্চে নবনির্বাচিত জেলা কমিটির প্রথম বৈঠক শেষে জেলা সম্পাদক হিসেবে শমীক লাহিড়ী পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্মেলন থেকে রাজ্য সম্মেলনের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯ জন নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন রাজ্য নির্ধারিত প্রতিনিধি। নতুন জেলা কমিটিতে আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে থাকছেন কান্তি গাঙ্গুলি, কমল গাঙ্গুলি, মোহিত ভট্টাচার্য, তাপস অধিকারী এবং সমর নাইয়া।
জয়নগর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে জেলা সম্মেলন উপলক্ষে দাবিদাওয়া লেখা সুদৃশ্য তোরণ এবং স্তম্ভে সজ্জিত করা হয়েছে। ৬ মার্চ শহরের তিনটি প্রান্ত থেকে লাল পতাকা, ফ্লেক্স, প্ল্যাকার্ড সজ্জিত তিনটি বর্ণাঢ্য মিছিল সম্মেলন স্থল শিবনাথ শাস্ত্রী ভবনে মিলিত হয়। সম্মেলন উপলক্ষে শিবনাথ শাস্ত্রী ভবনের নামকরণ করা হয় কমরেড শিবদাস ভট্টাচার্য নগর এবং সম্মেলন মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছে কমরেড অলক সরদার এবং অলক রায়ের নামে।
উদ্বোধনী পর্বে পার্টির রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা হেমেন মজুমদার। শহিদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সংক্ষিপ্ত ভাষণে পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু বলেন, শহিদদের জীবনদান কখনো বৃথা যাবে না। আমাদের শপথ গ্রহণ করতে হবে শোষণের যে নাগপাশ নানা কায়দায় মানুষের উপরে নেমে এসেছে, শোষিত নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামকে জোরদার করার। লাল পতাকার মর্যাদা রক্ষা করতে, শ্রমিক-কৃষকের লড়াইকে জোরদার করতে মইদুল মিদ্দা, সুদীপ্ত গুপ্ত সহ সমস্ত শহিদের রক্ত যাতে বৃথা না যায় সে জন্য আমাদের আত্মত্যাগ করতে হবে, সংকল্প গ্রহণ করতে হবে।
মাল্যদানের পর শুরু হয় অধিবেশন পর্ব। সম্মেলনের সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয় কমল গাঙ্গুলী, মুক্তি ভট্টাচার্য, আমজাদ শেখ, রাম দাস এবং রামশংকর হালদারকে নিয়ে। এছাড়াও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিরঞ্জন সিহি এবং পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম।
সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কল্লোল মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে বামপন্থী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এখন বড়ো বড়ো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। শ্রমজীবী মানুষ সহ সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক মানুষের ওপর তীব্র আক্রমণ এই সময়ে সংঘটিত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি স্থানীয় দাবি-দাওয়া আদায়ের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, গণআন্দোলনকে বিকশিত করার মধ্য দিয়ে পার্টির বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। বিগত সময়কালে আমাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। একমেরু বিশ্ব তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইয়োরোপের পতনের পর। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এই সময় গোটা দুনিয়াজুড়ে এক নতুন ব্যবস্থা নয়া উদারনীতি নামে চালু করল। এই সময়ে একদিকে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে তীব্র আকারে। যারা তখন বলেছিল এই নয়া অর্থনীতি বাঘের মতো ছুটবে, তা মুনাফার পাহাড় গড়ার কাজটা দ্রুত ত্বরান্বিত করল। কিন্তু এই ব্যবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষের আয়, কর্মসংস্থান, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্র সংকুচিত হতে লাগলো। উল্টোদিকে কিছু কর্পোরেট, মালিক সহ ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ বেড়েছে। এই বৈষম্য যে এই ব্যবস্থার ফসল তা এখন আর অস্বীকার করতে পারছে না ওরা। দেশের ভেতরের মালিক শ্রেণি অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সাম্রাজ্যবাদের দোসর হয়ে উঠেছে এই সময়। এই সময় আমরা প্রত্যক্ষ করলাম এলো লুটেরা সাম্রাজ্যবাদ। যারা দেশের মানুষের ভরসাস্থল ব্যাংক, বিমা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত। এর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে ব্যবহার করে লড়াই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, গোটা রাজ্যের মতো এই জেলাতেও কমরেডরা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন। আমাদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সামাজিক কাজে মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে ওইখান থেকেই লড়াইয়ের রসদ তৈরি হবে। মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারার তাগিদ আমাদের দেখাতে হবে বাস্তব পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে। ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটা এমনি এমনি হবে না। সব সময় লাল ঝান্ডা নিয়ে নয়, বৃহত্তর গণসংগঠনগুলিকে নিয়েও মানুষের কাছে পৌঁছোতে হবে। যেমন কোভিড পরিস্থিতিতে রেড ভলান্টিয়ার, বা শ্রমজীবী ক্যান্টিনের মাধ্যমে যা সম্ভব হয়েছিল। কাটিয়ে উঠতে হবে দুর্বলতা। প্লেনাম নির্দেশিত গণভিত্তি গড়ে তোলার কাজ করতে হবে। সেই গণভিত্তিকে রাজনৈতিক স্তরে উন্নীত করার কাজ করতে হবে। একদিকে সামাজিক ভিত্তি অন্যদিকে আরও শৃংখলাবদ্ধ ঠাসবুনোট পার্টি সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
পার্টির দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী এরপর খসড়া প্রতিবেদন পেশ করে বলেন, লুটের স্বার্থে দক্ষিণপন্থাকে সামনের সারিতে নিয়ে এসেছে ধান্দার পুঁজিবাদ। এরাই আমেরিকায় ট্রাম্পকে আনে, এখানে মোদিকে। এখন মুনাফার হার একই রাখতে বেড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ। একদিকে ধনীদের ট্যাক্স কমছে, অন্যদিকে সামাজিক খাতে ব্যয় বিপুল ছাঁটাই করা হচ্ছে। এই করের বোঝা চাপানো হচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর। কমছে মজুরি। আমাদের এখানে ফাটকা পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করে তৃণমূল। তাই কত বড়ো শত্রুর বিরুদ্ধে কত দীর্ঘ লড়াই আমরা করতে চাই - সেই বোঝাপড়াটা আমাদের মধ্যে থাকা দরকার। লড়াইটা সাধারণ সংগঠনের মাধ্যমে করা যাবে না, সেই বোঝাপড়াটা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছিল পার্টি প্লেনাম। এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কমিউনিস্ট পার্টির। নিষ্ক্রিয় কোনো কমিউনিস্ট পার্টি দিয়ে সেই ভূমিকা পালন করা যাবে না। মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদের উন্নত চেতনাসম্পন্ন সক্রিয় পার্টি সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা মার্কসবাদী রাজনৈতিক কর্মী। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করাটাই আমাদের কাছে সব নয়, সেই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে তার কতটা পরিবর্তন আমরা করতে পারছি সেটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো কথা। দক্ষিণপন্থীরা অপরাজেয় নয়। কৃষক আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে দেখুন কৃষক আন্দোলনের সামনে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে এই অতি দক্ষিণপন্থী সরকার। গোটা দুনিয়া তাদের স্যালুট করছে।
তিনি বলেন, অতি দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা একা লড়াই করে না, সমাজের বিভিন্ন অংশকে জড়িয়ে নিয়ে সমস্ত সহায়ক শক্তিকে জড়ো করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কমিউনিস্টরা। কৃষকদের আন্দোলনের সাফল্য একদিনে আসেনি। সলতে পাকানোর দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠকদের কাজ হলো সলতে পাকানো। শুধু তুলো আর তেল জোগাড় করলেই হয় না। কত ভালো সলতে আপনি পাকাতে পারছেন তার ওপর নির্ভর করবে প্রদীপ কতক্ষণ আপনি জ্বালিয়ে রাখতে পারবেন। আর এই কাজটা হলো নিবিড় কাজ, যা আমাদের করতে হবে।
রিপোর্টের উপর মোট ৮০ জন প্রতিনিধি আলোচনা করেন। প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে ধান্দার ধনতন্ত্রের দোসরদের বিরুদ্ধে লড়াই আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। প্রতিনিধিরা বলেছেন বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানোর মধ্যদিয়ে দৃশ্যমানতা বাড়ানোর কথা। বলেছেন তার মধ্য দিয়ে মানুষকে সাহস জোগানোর আরও গতিশীল পাঠের কথা। বুথ ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পার্টি সদস্যদের সংগঠক গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার দিকনির্দেশের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে এসেছে। তারা বলেছেন মজুরি বৃদ্ধির কথা। কৃষক সংগঠন সহ বিভিন্ন ধরনের গণসংগঠনের সদস্যদের ধারাবাহিক মতাদর্শ অনুশীলন ও প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথা। পার্টির পত্রপত্রিকা প্রচারের ক্ষেত্রে চেকআপ এবং মনিটরিং জেলাস্তর থেকে আরও নিবিড়ভাবে করার কথা বলা হয়েছে। প্রতিনিধিরা তুলে ধরেছেন সন্ত্রাসদীর্ণ এলাকায় গণ সংগ্রহের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা। প্রতিনিধিরা একথাও বলেছেন, মানুষ চাইলেও সন্ত্রাসের কারণে তারা সবসময় যেতে পারছেন না। এই প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে সেই সীমাবদ্ধতার কথা এবং তা টপকে যাওয়ার প্রতিজ্ঞার উচ্চারণ। প্রতিনিধিরা বলেছেন সর্বস্তরের কর্মীদের সামাজিক ভিত্তি গড়ে তোলা এবং তার প্রয়োজনীয়তার কথা, সাম্প্রতিক বিষয়ের উপর পার্টি ক্লাস করানোর দাবি, নাছোড়বান্দা আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতির জন্য যা জরুরি। পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভার ভোট - সর্বস্তরে ভোট লুটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়টিও দৃঢ়ভাবে উঠে আসে আলোচনায়। ২৮ এবং ২৯ তারিখের সাধারণ ধর্মঘটে সার্বিক অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ উচ্চারিত হয় প্রত্যয়ের সঙ্গে।
সম্মেলন উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এবং জয়নগর শহর এবং শহরের প্রবেশ পথগুলো জুড়ে সুসজ্জিত করা হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানো, জব কার্ডের দাবি, প্রান্তিক অংশের মানুষকে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা মাসিক ভিত্তিতে দেবার দাবি, পেট্রোল ডিজেল-এর মূল্য বৃদ্ধি প্রত্যাহার, সাইফুদ্দিন, মইদুল এবং সুদীপ্ত গুপ্তের শহিদি বরণ, রাজ্যের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি দূর করা সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে স্মরণ ও প্রচারের কথা ছোটো তোরণ থেকে ফ্লেক্স-প্ল্যাকার্ডে। এর পাশাপাশি জেলার কৃতী সন্তান সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, কানাইলাল দত্ত প্রমুখের ছবি সংবলিত বর্ণনা এবং শিবনাথ শাস্ত্রী ভবনের প্রবেশপথের দুপাশে প্যারি কমিউনের ১৫০ বছর এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের অবদান শীর্ষক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
সম্মেলন মঞ্চে ৫০ এবং ৬০-এর দশক থেকে জেলায় পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গৌরবজ্জল লড়াকু ভূমিকা ও অবদান রয়েছে এমন ৩৩ জন প্রবীণ পার্টি সদস্যকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
এদিন সম্মেলনে ‘২৪ পরগনার শ্রমিক কৃষক আন্দোলন ও প্রভাস রায়’ শীর্ষক একটি বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিমান বসু। সম্মেলন উপলক্ষে পার্টি পত্রপত্রিকাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বিভিন্ন এরিয়া কমিটি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু মানুষ এবং সংগঠন।
সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বিমান বসু বলেন, লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রসারিত করতে হবে গণভিত্তি। গ্রামে ও শহরে পার্টির শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে হবে। দক্ষিণপন্থীদের আগ্রাসনকে রুখতে পারে একমাত্র কমিউনিস্টরাই। তাই এদেশে সিপিআই(এম)-এর স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। তবে বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। লড়াই আন্দোলনের প্রশ্নে অতীতের সঙ্গে তুলনা টেনে হা-হুতাশ করায় লাভ নেই। অতীতের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই আর এখনকার আন্দোলনের ধরন এক হবে না।
বিজেপি’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিমান বসু বলেন, বিজেপি কোনো সাধারণ বুর্জোয়া দল নয়, একটি প্রতিক্রিয়াশীল দল। বুর্জোয়া শ্রেণি ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, তবে সেই ধর্মনিরপেক্ষতা ত্রুটিপূর্ণ। এই বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাণভোমরা হলো ফ্যাসিবাদী আরএসএস। ওদের বুলি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। এরা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দখলদারি কায়েম করতে চায়। আর তৃণমূল কংগ্রেস দক্ষিণপন্থার রাজনীতিকে অবলম্বন করে তার ওপর মোড়ক লাগিয়ে রূপায়ণ করে চলেছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারে কমিউনিস্টরাই। আমাদের সংগঠিতভাবে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, স্বাধীনতার পরে ভারতে কমিউনিস্টরা মূল শক্তি না হয়েও পুনর্গঠনের প্রশ্নে দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছে। আমরা সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। এই জেলায় কাকদ্বীপে তেভাগা, সোনারপুরের কৃষি আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনের যে নতুন ভাবনা ও গতি সেক্ষেত্রেও এই জেলার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আমরা তাকে বহমান রেখেছি। আমরা পর্যালোচনা করছি আমাদের লড়াই আন্দোলনের প্রশ্নে খামতিটা কোথায়। এই সময়েই আমরা লাতিন আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দিকে তাকিয়ে বামপন্থার পুনরুত্থান লক্ষ্য করছি - যা আমাদের কাছে উৎসাহের।
তিনি তৃণমূল সরকারের দক্ষিণপন্থী পথে এগোনোর প্রসঙ্গে বলেন, নয়া যে শিক্ষানীতি এরাজ্যে চালু করা হচ্ছে তা নরেন্দ্র মোদির নয়া শিক্ষানীতির রূপায়ণ। যে কাজটা আদানিরা করে ছত্তিশগড়ে, এখানেও রাজ্য সরকার সেটা করছে দেউচা-পাঁচামিতে। ধরা পড়ে যাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। এরাজ্যের তৃণমূল সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছে ছাত্র-যুব শ্রমজীবী মানুষ। ধরা পড়ে যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির কূটকৌশল। আনিস খানকে রাষ্ট্র খুন করেছে তাও ধরা পড়ে যাচ্ছে।
স্বৈরতান্ত্রিক পথে চলা এই সরকারগুলিকে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষক আন্দোলন প্রতাপশালী নরেন্দ্র মোদিকে মাথা নিচু করতে বাধ্য করিয়েছে।
সংগঠনকে মজবুত করার প্রশ্নে তিনি বলেন পার্টির ছেলেকে সামাজিক সংযোগ বাড়িয়ে পাড়ার ছেলে হয়ে উঠতে হবে, বিচ্ছিন্নতায় ভুগলে হবেনা। আমাদের অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, পাড়ামুখো হয়ে উঠতে হবে। দৃঢ় করতে হবে গণভিত্তি। আরও বেশি করে আস্থা অর্জন করতে হবে মানুষের। তবেই আমরা পারব লড়াইয়ে জিততে।
প্রতিনিধিদের আলোচনার শেষে জবাবি ভাষণে শমীক লাহিড়ী বলেন, জনগণের সঙ্গে জীবন্ত যোগাযোগ বজায় রাখাই একজন কমিউনিস্টের লক্ষ্য হওয়া উচিত। মতাদর্শ চর্চা জরুরি। মতাদর্শে দৃঢ় থেকে মানুষের পাশে থাকতে হবে নিবিড়ভাবে। লড়াইটা সোজা নয়, দীর্ঘ। ধান্দার পুঁজির প্রতিনিধি মোদি রূপায়ণ করছে আদানি-আম্বানির কর্পোরেট কর্মসূচি। অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে কোনো ঢিলেমি বা নিষ্ক্রিয়তার জায়গা নেই। শত্রুর শক্তির নিরিখে সংগঠনকে সাজাতে হবে। নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত পার্টি গড়ে না তুললে নাছোড়বান্দা দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
এ প্রসঙ্গে তিনি দিল্লির কৃষক আন্দোলনের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, কৃষক আন্দোলন সঠিক চিনতে পেরেছিল শক্রকে। এই শত্রুর বিরুদ্ধে এক বছর ধরে লড়াই করে নরেন্দ্র মোদিকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছে তারা।
সম্মেলন থেকে গৃহীত প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে আগামী ২৮ ও ২৯ মার্চ-এর সাধারণ ধর্মঘট সফল করার আহ্বান, নয়া শিক্ষানীতির বিরোধিতা, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের স্বপক্ষে, সুন্দরবন রক্ষার দাবি, প্রতিহত করো মানুষ মারা অর্থনীতি রুখে দাও দেশ বিক্রির ষড়যন্ত্র, হাততালি কুড়ানো প্রকল্প নয় অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করো ইত্যাদি ১৮টি প্রস্তাব।
প্রতিনিধিদের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক হেমেন মজুমদার (৮৮) এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি প্রতিম দে (২৩)। প্রতিনিধিদের গড় বয়স ৫২ বছর।
প্রতিনিধিদের মধ্যে সর্বাধিক কারাবাস করেছেন কান্তি গাঙ্গুলি। তিনি আড়াই বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন এবং সাড়ে আট বছর আত্মগোপনে ছিলেন। ছাত্রনেতা প্রতিক উর রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে তৃণমূল সরকারের জমানায় সাজানো সবচেয়ে বেশি মামলা ৪৭টি।