৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮
বন্ধ হোক আগ্রাসন, পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক শান্তি
সীতারাম ইয়েচুরি
আকাশ পথে আক্রমণ রাশিয়ার।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ইয়োরোপ এবং বিশ্বের ঘটনাবলিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে চলেছে। যাই প্ররোচনা থাকুক কিংবা যেরকমই নিরাপত্তার অভাব অনুভূত হোক না কেন এরকম একটি বৃহৎ পরিসরে পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানে রাশিয়ার অস্ত্রসজ্জিত হওয়া এই সমস্যা সমাধানের পথ নয়। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং কূটনৈতিক ও আপস-আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই পরিস্থিতির সূত্রপাত ঘটিয়েছে যেগুলিকে বিবেচনায় আনা জরুরি। প্রথমটি হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সংঘটিত ঘটনাবলি। সিপিআই(এম) সর্বদাই এই মনোভাবই পোষণ করে এসেছে যে, পূর্ব ইয়োরোপের মিত্র সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সাথে যুক্ত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা গঠিত ওয়ারশ চুক্তি-জোটের সামরিক মোকাবিলা এবং ঠান্ডা যুদ্ধকে তীব্র করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নর্থ আটলান্টিক ট্রিট্রি অরগানাইজেশন (এনএটিও - ন্যাটো) প্রতিষ্ঠা করেছিল। ন্যাটো ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত মতাদর্শগত যুদ্ধের সামরিক হাতিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ওয়ারশ চুক্তির অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যায়। তাই আর ন্যাটো’কে জিইয়ে রাখার কোনো যুক্তি ছিল না। ন্যাটোর ইতি করে দেওয়াই উচিত ছিল যখন কীনা এর অস্তিত্ব রাখার কারণটিই লুপ্ত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৯২ সালের ৩-৯ জানুয়ারি, মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)-এর ১৪তম কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছিলঃ “যখন ওয়ারশ চুক্তি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে তখনও ন্যাটো অটুট রয়েছে এবং উপসাগরীয় যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছে. ন্যাটো-ভুক্ত দেশগুলি তাদের রণনীতি সংশোধন করার এবং সদস্য দেশগুলি থেকে সৈন্য নিয়ে দ্রুত হস্তক্ষেপের উপযোগী একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
এই প্রস্তাবে আহ্বান জানানো হয়েছিলঃ “বিশ্ব শান্তিকামী শক্তিগুলিকে পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস ও নিরস্ত্রীকরণের আলোচনার পাশাপাশি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্র দেশগুলির কাছে পৃথিবীব্যাপী সামরিক ঘাঁটিগুলি এবং নতুন অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করার এবং চিরাচরিত বাহিনী বিপুল সংখ্যায় হ্রাস ঘটাবার জন্যও দাবি জানাতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বশান্তি আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।”
বিশ্বব্যাপী আধিপত্যকে মজবুত করার আকাঙ্ক্ষায় ও ঠান্ডা যুদ্ধ-উত্তর পর্বের পরিস্থিতিকে শক্তহাতে মোকাবিলায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ন্যাটোকে শুধু জিইয়েই রাখল না, একে আরও শক্তিশালী করছে এবং বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে, ইয়োরোপ ও মধ্য এশিয়ায় সামরিক আগ্রাসনে এই যুদ্ধজোটকে ব্যবহার করছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার পর গরবাচভ’কে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, ন্যাটো ভেঙে ফেলা হবে। এই প্রতিশ্রুতিকে নাকচ করে দিয়ে, ন্যাটোকে ভেঙে ফেলার পরিবর্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পূর্বদিকে এর সম্প্রসারণকে ত্বরান্বিত করেছে। ১৯৯০-তে ন্যাটো’র সদস্য রাষ্ট্র ছিল ১৬। ১৯৯৯-তে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেক প্রজাতন্ত্র ন্যাটো’তে যোগ দেয়। বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়া যুক্ত হয় ২০০৪ সালে। ২০০৯ সালে যোগ দেয় আলবানিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া। ২০১৭ সালে মন্টেনেগ্রো ও উত্তর ম্যাসিডোনিয়া এবং ২০২১ সালে বসনিয়া ও হারজেগোভিনা ন্যাটো’য় যুক্ত হয়। অর্থাৎ ইউক্রেন ও জর্জিয়া বাদে পূর্ব ইয়োরোপের প্রায় সব দেশ ন্যাটোয় যোগ দিয়েছে। রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটো তাদের ১ লক্ষ ৭৫ হাজার সৈন্যকে মোতায়েন করেছে।
কোনো দেশ অন্য দেশের নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ণ করার বিনিময়ে নিজের দেশের নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করবে না - এই নীতির ভিত্তিতে রাশিয়া ২০০৮ সালে একটা ইয়োরোপিয়ান সিকিউরিটি ট্রিটি’র প্রস্তাব দেয়। যদিও এটা বাতিল হয়ে যায়। ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তিকে রাশিয়া তাই খুব সঠিকভাবেই তার নিজের দেশের প্রতি হুমকিস্বরূপ এক আগ্রাসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছে।
গত ডিসেম্বরে প্রস্তাবিত রাশিয়া এবং ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তাসমূহে রাশিয়ার মত ছিলঃ (ক) ন্যাটো’র আর সম্প্রসারণ নয়, (খ) সামরিক হানায় ব্যবহৃত হয় এমন কোনো অস্ত্রের রাশিয়া সীমান্তে মোতায়েন নয় এবং (গ) ন্যাটো-রাশিয়া প্রতিষ্ঠা আইন ১৯৯৭-এ ফিরে যাওয়া। এটিকে প্রত্যাখ্যান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে একটি রুশ-বিরোধী শক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে এবং ২০১৪ সালে একটি অভ্যুত্থান ঘটায়। পরবর্তীকালে, ইউক্রেন আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোতে যোগদান না করেও ইউক্রেনে ন্যাটো পরিকাঠামো বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
পুতিন এবং রাশিয়া এই বৈরিমূলক ঘটনা পরম্পরাকে রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসাবে দেখেছে, যা এই সামরিক পদক্ষেপ এবং আক্রমণের দিকে তাকে পরিচালিত করেছে। এই কারণেই, এটা একান্তভাবেই রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র/ন্যাটোর মধ্যে একটি যুদ্ধ। ইউক্রেন হলো সেই রঙ্গমঞ্চ যেখানে এই যুদ্ধ চালানো হচ্ছে।
হৃত বৃহৎ রাশিয়া পুনরুদ্ধার
দ্বিতীয় কারণটি হলো, ইউক্রেনকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বিবেচনা করে বৃহৎ রাশিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য পুতিন তার পুনর্গঠনমূলক প্রকল্পকে অনুসরণ করছেন। অনেকাংশে, রাশিয়ার ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি সবই যে ভূমি থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল তা আজ ইউক্রেনের অংশ। বহু শতাব্দী ধরে রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ই একে অপরের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে ছিল। ইউক্রেনের পশ্চিম অংশটি মূলত ক্যাথলিক যেখানে পূর্ব অংশটি রাশিয়ান অর্থোডক্স। পশ্চিম অংশের মানুষ ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলে আর পূর্ব অংশের রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে পুতিন এই হৃত জমি পুনুরুদ্ধারের মতবাদকে সমর্থন করে পৃথক ইউক্রেন তৈরির দায় বলশেভিকদের ওপর চাপিয়ে বর্তমানের ইউক্রেনকে “ভ্লাদিমির লেনিনের ইউক্রেন” বলে আখ্যায়িত করেন।
অক্টোবর বিপ্লব-উত্তর সময়ে অনুসৃত বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক লেনিনীয় নীতি যা জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সহ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ওই জাতিসমুহকে বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত অধিকার দিয়েছিল - সেই নীতিকেই পুতিন দায়ী করেছেন। এই নীতি ১৯২২ সালে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯২৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত হয়। আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে পুতিন এটাকে “আদি পাপ” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা পূর্বতন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির উত্থানের দিকে চালনা করেছিল। স্পষ্টত, এই আক্রমণাত্মক ভাষণে পুতিন লেনিন ও বলশেভিকদের বিরুদ্ধে নিন্দা এবং ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ে অনুশোচনা করেছেন। এই বলশেভিকরাই সাম্রাজ্যবাদী জারের বৃহৎ রাশিয়ার দর্শনকে পরাজিত করেছিল। এটাই বর্তমান বিশ্বে পুতিনের এই স্বপ্নপূরণ কার্যত অসম্ভব।
যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা
বিশ্ব শান্তির জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে এমন ক্রমবিস্তারকর ঘটনা বন্ধ করা একান্তভাবেই জরুরি। সংঘাত বাড়িয়ে তোলার এই শক্তির অবাধ প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তুলতে পারে। তাই যে কোনো মূল্যে এটা প্রতিরোধ করতে হবে। একই সাথে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং রুশ সৈন্যেরও প্রত্যাহার জরুরি।
এই পরিস্থিতিতে যা দরকার তা হলো ন্যাটো তার আরও পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ বন্ধ করুক। রাশিয়ার সীমান্তে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ ন্যাটো’কে প্রাণঘাতী অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা স্থাপন করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ইউক্রেনকে অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে হবে। রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী ন্যাটো’র ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য অস্ত্রব্যবস্থা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া থেকে ইউক্রেনকে বিরত থাকতে হবে। ইউক্রেনে বিদ্যমান ন্যাটো পরিকাঠামোকেও অবশ্যই ভেঙে ফেলতে হবে।
শান্তি নিশ্চিত করতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রথম রাউন্ডের আলোচনায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফল মেলেনি। উভয়পক্ষই সম্মত হয়েছে যে, এই আলোচনা জারি থাকবে। পরবর্তী রাউন্ডের আলোচনা ২/৩ মার্চ সংগঠিত হবে বলে এখনও ঘোষণা করা হয়েছে। ইত্যবসরে যুদ্ধ তার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ঘটিয়ে চলবে।
এই আলোচনা যাতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট অগ্রগতি ঘটাতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বিশেষ করে, আমেরিকা এবং ন্যাটোকে যুক্ত করে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশি করা দরকার।
ইউক্রেন থেকে ফিরছেন ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীরা।
ভারত সরকারকে অবশ্যই দ্রুততার সাথে সব ভারতীয়কে ফিরিয়ে আনতে হবে
এটা খুবই মর্মান্তিক যে, খারকিভ শহরে বোমার আঘাতে ২১ বছর বয়সী ভারতীয় ছাত্র নবীন শেখারাপ্পা মারা গেছেন। সারা দেশ একসাথে এই মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছে। উপসাগরীয় যুদ্ধ, লিবিয়া সংকট এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতিতে হাজার হাজার ভারতীয়কে সেই সব দেশ থেকে ফিরিয়ে আনার গৌরবজনক অতীত রেকর্ড আছে ভারতের।
যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সমস্ত ভারতীয়কে ফিরিয়ে আনার প্রতি ভারত সরকারকে দ্বিধাহীনভাবে মনোযোগ দিতে হবে।
ভাষান্তরঃ শংকর মুখার্জি