৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮
অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
“রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সশস্ত্র সংঘাত গভীর উদ্বেগজনক। ইউক্রেনের বিপক্ষে রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপ দুঃখজনক। সশস্ত্র সংঘাত থেকে বিরত হওয়া এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন এখনই।” বক্তব্যটা কোট আনকোট। কাজেই দ্বিধা দ্বন্দ্বের কোনো অবকাশ নেই। জেনে হোক বা না জেনে, সোশ্যাল মিডিয়ার রগরগে বাজারে ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘সিপিএম’ আর রাশিয়াকে ‘সহি বাম’ ভেবে নেওয়া মানুষজনের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। অতএব ‘মাকুরা ইউক্রেন আক্রমণ করেছে’' গোছের টেক্সট একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে আদৌ তা নয় এবং পুতিন যে ‘সিপিএম’-এর খুড়তুতো ভাই নন তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেবার জন্যই সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর ২৫ ফেব্রুয়ারির বিবৃতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মন পর্যন্ত না পৌঁছাক, খাতায় কলমে তো থেকে যাক হোয়াট ইজ হোয়াট। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এ দেশের বৃহত্তম বামপন্থী দলের অবস্থান ঠিক কী ছিল তা তো অন্তত লিপিবদ্ধ থাকুক।
নয় নয় করে শেষ প্রায় পনেরো দিন ধরে রাশিয়া বনাম ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এখন ঘরে ঘরে, পাড়ার মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে দোকানে যুদ্ধ বিশারদ। রাশিয়ার কী করা উচিত, আমেরিকার কী করা উচিত, এই আক্রমণের পেছনে ‘সিপিএম-এর ভূমিকা’ ইত্যাদি চুলচেরা বিশ্লেষণ। আক্রমণটা যেহেতু রাশিয়া করেছে এবং একতরফাই করেছে, তাই পশ্চিমি দুনিয়া উঠে পড়ে লেগেছে গেল গেল রব তুলে। সরব সব থেকে বেশি আমেরিকা। আর স্বাভাবিকভাবেই তাই বিশ্বজুড়ে একটা বেশ বড়ো অংশে এখন শুধু হুক্কা হুয়া। রাশিয়া একতরফা আক্রমণ করেছে, রাশিয়া একটা শান্ত সুন্দর দেশকে বোমা মেরে ধ্বংস করছে, রাশিয়া ইউক্রেনে নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। মর্নিং ডেস্ক থেকে প্রাইম টাইম - সব খেয়ে নিয়েছে ইউক্রেন আর রাশিয়া। ভ্লাদিমির পুতিন আর ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। তেলের দাম, গ্যাসের দাম, আন্তর্জাতিক বাজার ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক অনেক দূরে সরে গেছে করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশে দেশে ধসে যাওয়া অর্থনীতির কথা, বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলা বেকারি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কথা। তাই আপাত দৃষ্টিতে যা জলের মতো সহজ, ভাবসম্প্রসারণে তা হয়তো দেখা যাবে ভয়ংকর রকমের কঠিন। রাশিয়ান আগ্রাসনে চোখ ভিজে ওঠা পশ্চিমি দুনিয়ার হয়তো এই মুহূর্তে মনে নেই এই ক’দিন আগেই প্রায় কুড়ি বছরের আগ্রাসন শেষে আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে আমেরিকার পালিয়ে আসার কথা। পশ্চিমি দুনিয়ার হয়তো মনে নেই নিকারাগুয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, ইরাক, কুয়েত, কোরিয়া, পানামা, কিউবা, সিরিয়া, সোমালিয়া, পুয়ের্তো রিকো, বসনিয়া প্রভৃতি দেশে মার্কিন আগ্রাসনের কথা। হয়তো মনে নেই ইটালি, আলবেনিয়া, গুয়াতেমালা, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গো, ব্রাজিল, ঘানা, বলিভিয়া, চিলি, এল সালভাদোর প্রভৃতি দেশের নাম। যে ইতিহাস অনেকটাই পুরোনো। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু মানুষের মৃত্যু, বহু ক্ষয়ক্ষতি, বহু ধ্বংসলীলা। কিন্তু ক্ষমতার হুঙ্কারে গত ৭০ বছর ধরে বিশ্বকে তিলে তিলে ধ্বংস করার দায় কার? সে বিষয়ে পশ্চিমি দুনিয়া, পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের মতামত কী? মানব সভ্যতার ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যালীলা হিরোসিমা নাগাসাকির কথা না হয় বাদই দিলাম। তথ্য বলে অন্য দেশের রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ বিষয়, নির্বাচনে নাক গলানোর সব থেকে বেশি অভ্যাস তো আমেরিকারই এবং বিগত ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে তা চলছে।
২০১৬ সালে লস এঞ্জেলস টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৪৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে প্রায় ৮১ বার হস্তক্ষেপ করেছে আমেরিকা। ১৯৪৮-এ ইটালির নির্বাচন দিয়ে যার শুরু। যেখানে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা থেকে হটাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিলো আমেরিকা। নির্বাচনী প্রচারের ব্যয় থেকে শুরু করে, প্রচারের জন্য বিশেষজ্ঞদের পাঠানো এবং সরাসরি সে দেশের মানুষকে হুমকি সহ বিভিন্ন ঘটনাই ঘটেছে ইটালিতে। ১৯৪৮-এর পর থেকে ইটালির পরবর্তী সাতটি নির্বাচনে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা থেকে দূরে সরাতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেছে আমেরিকা। বিশিষ্ট পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট, কার্নেগি মেলোন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডোভ লেভিন তাঁর এক সমীক্ষায় একথা জানিয়েছেন। লেভিনের সমীক্ষা থেকে উঠে আসা পরিসংখ্যান অনুসারে, এর মধ্যে শতকরা ৫৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আমেরিকা যাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল তারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। এই প্রসঙ্গে কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ টমাস কারোথারস জানিয়েছেন, বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের নির্বাচনে সরাসরি আমেরিকার হস্তক্ষেপের মূল কারণ, আমেরিকা চায় না বিশ্বের কোনো দেশেই বাম মনোভাবাপন্ন সরকার বা বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসুক। অর্থাৎ উগ্র বাম বিদ্বেষ এবং পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যেই এই আগ্রাসন।
ঠিক একইভাবে ১৯৯০তে নিকারাগুয়ার বামপন্থী সান্দিনিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে সিআইএ-র চক্রান্তর কথা জানা গেছে অনেক পরে। এই নির্বাচনের আগে এক জার্মান সংবাদপত্রে সান্দিনিস্তা প্রার্থী ড্যানিয়েল ওরতেগার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যে প্রতিবেদন নিয়ে প্রচারে নামে ওরতেগা বিরোধীরা। বলা বাহুল্য আমেরিকার মদতে। নির্বাচনী ফলাফলে ভায়োলেটা চামোরোর কাছে পরাজিত হন ওরতেগা। অনেক পরে জানা গেছে এর সবটাই ছিল বাম সান্দিনিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। একইভাবে ওই বছরেই কমিউনিজমের রাস্তা থেকে সরে আসার পর চেকোস্লোভাকিয়ার নির্বাচনে আমেরিকার হস্তক্ষেপ-এর কথা আজ প্রকাশ্যে। রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার পর ১৯৯৬-এর নির্বাচনের আগে সে দেশে মার্কিন সাহায্য যায় ১০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কমিউনিজম মুক্ত রাশিয়াকে বাজার অর্থনীতির পথে আনা, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি স্থাপন করা, বেসরকারি পথে হাঁটা, মুক্ত বাণিজ্য প্রভৃতির জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের সহায়তায় এই সাহায্য। যে অর্থের বড়ো অংশ বরিস ইয়েলেতসিন খরচ করেন নিজের নির্বাচনী প্রচারে।
বলতে গেলে এই ধরনের বহু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ছোটো পরিসরে ৮১টি ঘটনার বিবরণ দেওয়া কিছুটা অসম্ভব। কিন্তু প্রায় সব দেশেই নির্বাচনী ব্যবস্থায় আমেরিকান হস্তক্ষেপ একই কারণে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার এবং কমিউনিস্টদের বাড়তে না দেওয়া, আটকে দেওয়া। একইভাবে একাধিক দেশে আগ্রাসনের ইতিহাসটাও খুব একটা কম নয়। ১৯৫০ থেকে ২০২২ - দখলদারির সংখ্যা তো কম নয়। মোট দখলদারি ৬৭ বার। লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে বলি সাড়ে ১০ লক্ষ মানুষ। ভিয়েতনামে বলি সাড়ে ৯ লক্ষ। গত পঞ্চাশ বছরে এই আগ্রাসনের বলি প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষ। আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছরের দখলদারি, ভিয়েতনামে সাড়ে ১৯ বছরের দখলদারি, ফিলিপাইন্সে ১৪ বছরের দখলদারি, ইরাকে ৯ বছরের দখলদারি, কোরিয়ায় ৩ বছরের দখলদারি, লিবিয়ায় যুদ্ধ, গালফ ওয়ার, কিউবায় অবরোধ, পানামায় অবরোধ - এইসব যুদ্ধ, ধ্বংস, আগ্রাসনের জবাবদিহি করবে কে? পশ্চিমি দুনিয়া, ইউনাইটেড নেশনসরা কতবার এইসব আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে? সম্ভবত একবারও না। আর মূল রহস্য লুকিয়ে এখানেই।
লেখাটা পড়তে পড়তে এরকম মনে হবার একটা সম্ভাবনা হয়তো তৈরি হতে পারে যে, এভাবে হয়তো রাশিয়ান আগ্রাসনকে জাস্টিফাই করার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে জাস্টিফাই করার কোনো প্রশ্ন নেই। সেই ধন্দ যাতে তৈরি না হয় তাই শুরুতেই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান, আগ্রাসন বিরোধিতা খুব স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বামপন্থীদের বহু পুরোনো দাবি - যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। যে দাবিতে অতীতে বারবার পথে নেমেছেন বামপন্থীরা, বর্তমানে নামে এবং ভবিষ্যতেও নামবে। তবু একথা তো ভাবতেই হবে যে, রাশিয়ার এই আক্রমণ কি আচমকা? নাকি এর পেছনেও কোনো রহস্য আছে? থাকলে কী সেই রহস্য? যার ফলে ইউক্রেনকে সরাসরি আক্রমণ রাশিয়ার?
ইউক্রেন-রাশিয়ার বিবাদের ইতিহাস যদিও বেশ পুরোনো, কিন্তু বেশি পুরোনো দিনে ফিরে যাচ্ছি না। মোটামুটি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেই রাশিয়ার বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চল ঘিরে ছোটো ছোটো দেশ এবং সেই সব দেশের অধিকাংশতেই আমেরিকার হস্তক্ষেপ, ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তি আজকের বিবাদের মূল কারণ। ১৯৯৭ সালের পর থেকেই বারবার চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে রাশিয়ার তরফে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জর্জিয়া, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে এইসব অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়ে। সেইসময় আগেকার সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে থাকা পূর্ব ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ ন্যাটোর অধীনে। ন্যাটোর সদস্যপদ পেয়ে গেছে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, লাটভিয়া সহ প্রায় ১৪টি দেশ। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০টি দেশ ন্যাটোর কবজায়। একথা তো সত্যি যে, বিগত কয়েক বছর ধরে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বারবার ন্যাটোর কার্যকলাপ, আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। তাঁর মূল আপত্তি রাশিয়ান সীমান্তের বিভিন্ন দেশকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার দাবির বিরুদ্ধে। তাঁর স্পষ্ট অভিমত, সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে রাশিয়ার। অতীতে তো রাশিয়ার কাছে আমেরিকা জানিয়েছিল ন্যাটো পূর্বদিকে একটুও এগোবে না।
কথা কেউ রাখেনি। উলটে ইউক্রেনকে ঘিরে নতুন করে শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোর তৎপরতা। সাম্প্রতিক সময়ে সিআইএ-র সঙ্গে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কির বৈঠকই হোক অথবা দেশের ভেতর নাৎসি শক্তিকে মদত দেওয়াই হোক - রাশিয়ার প্রমাদ গোণার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। আর আমেরিকার দাদাগিরির কাছে নতিস্বীকার না করে ইউক্রেন আক্রমণ তাই হয়তো কিছুটা ঘুরিয়ে ন্যাটোকে, পশ্চিমি শক্তিকেই হুমকি। হয়তো বজ্র আঁটুনি ঢিলে হবার ভয়ে পশ্চিমি শক্তির মাথাব্যথা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমি আধিপত্যকে অস্বীকার করে ন্যাটোর কবজা থেকে বিশ্বকে আদৌ মুক্ত করতে অথবা পিছু হটতে বাধ্য করতে পারবে কিনা তার উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে কোনো নতুন শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠবে কিনা তাও এত তাড়াতাড়ি বলা সম্ভব নয়। তবে এই যুদ্ধ ঘিরে যত অস্থিরতাই তৈরি হোক, যুদ্ধের ফলাফল যে সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে এবং এত তাড়াতাড়ি যে মীমাংসা সূত্র মিলবে না তা গত পনেরো দিনেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। আপাতত অপেক্ষা ভবিষ্যতের।