৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮
সাম্প্রতিক যুদ্ধ এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষ ইত্যাদি
পল্লব সেনগুপ্ত
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ওরফে পলিটিক্যাল সায়েন্সের পণ্ডিতরা আমাদেরকে একটা কথা শিখিয়েছেন, ‘‘যুদ্ধের প্রথম নিহতের নাম হলো সত্য।’’ কথাটা খুবই খাঁটি। তবে যে কথাটা আমাদেরকে ক্লাসরুমে বলা হয়নি, তা হলো, ‘‘যুদ্ধের প্রথম সন্তানের নাম ঘৃণা।’’ আর ঘৃণার জাতক হচ্ছে ‘বিদ্বেষ’; এবং বিদ্বেষ থেকে জন্মায় অন্ধ-প্রতিহিংসার উচাটন। ...এই কথাগুলো যে অবশ্যই বর্তমানের রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধ উপলক্ষ্যে বলছি, সেটা তো বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই যুদ্ধের দায়িত্ব কার - রাশিয়া, না-কি ইউক্রেন, এবং কেনই বা যুদ্ধ বাঁধাল রাশিয়া - সে সব নিয়ে অজস্র মতপার্থক্য রয়েছে; তাই সেই বিতর্কে আপাতত ঢুকছি না। পরে না-হয় সেই নিয়ে বলছি। আপাতত বলার বিষয় হচ্ছে এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষায় যেভাবে হঠাৎ পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলি ঘৃণা এবং জাতিবিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করেছে - সেটাই। যা-সব লিখছে তারা, তা থেকে কিছু কিছু বেছে নিয়ে এখানে অনুবাদ করে দিলুম আলোচনার প্রয়োজনে।
১। ‘‘এইটেই খুব বড়ো বেদনার কথা যে, দেখতে পাচ্ছি যাঁরা নিহত হচ্ছেন (এই যুদ্ধে) তাঁরা সকলেই নীল চোখ আর সোনালি চুলের ইয়োরোপীয় মানুষ!’’ - ইউক্রেনের মুখ্য সরকারি আইনজীবী ডেভিড স্যাকভারেলিজের বক্তব্য, বিবিসি-তে প্রচারিত।
২। ‘‘এটা তো ইরাক বা আফগানিস্তান নয় - একটা তুলনামূলকভাবে অনেক সভ্য দেশের শহর।’’ সিবিএস-এর বিদেশ বিষয়ের সংবাদদাতা চার্লি ডি অ্যাগাটার বক্তব্য - ইউক্রেনের ২য় মহানগরী খারকিভ সাম্প্রতিক যুদ্ধে বিধ্বস্ত-প্রায় হলে এই কথাগুলো প্রচারিত হয় বিশ্বজুড়ে।
৩। ‘‘যেটা দেখতে বাধ্য হচ্ছি আমরা, তা’হলো তাঁদের পোশাক-আশাক পরার রীতি। তাঁরা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাঁরা অবশ্য সেই সব বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের দলে পড়েন না, যাঁরা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা উত্তর আফ্রিকা থেকে অন্য কোনও দেশে পালাতে ব্যগ্র। এই গৃহচ্যুতরা তো আপনার আমার পাশের বাড়ির পড়শিদের মতোই দেখতে-শুনতে!’’ পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির তাঁবেদার আরবীয় সংবাদমাধ্যম ‘আল-জাজিরা’-র সংবাদ পাঠক পিটার ডোবির গলায় প্রচারিত এই কথাগুলি একাধিকবার শোনানো হয়েছে ওই টিভি চ্যানেলে।
৪। ‘‘ভাবতে পারছেন আপনারা? এই একুশ শতকের একটা ইয়োরোপীয় শহরে থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে (শত্রু পক্ষের ছোঁড়া) মিসাইলের আগুনের মধ্যে দিয়ে সাবধানে চলতে-ফিরতে হচ্ছে!’’ ফরাসি টিভি চ্যানেল বিএফএম টিভি-র কিয়েভ শহরের সংবাদদাতার ধারা বিবরণী।
৫। ‘‘ওঁদেরকে চেহারায় আমাদেরই মতো দেখতে! এটাই তো সবচেয়ে বেশি করে ধাক্কা দিচ্ছে। ইউক্রেন একটা ইয়োরোপীয় দেশ, যার অধিবাসীরা নেটফ্লিক্স দেখেন, ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টের অধিকারী। ...যুদ্ধ তো তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সুদূর কোনও প্রত্যন্তবাসী জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না, সেটা তো যে-কোনও কারুর জীবনেই ঘটা সম্ভব।’’ ‘ডেলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ড্যানিয়েল হান্নানের প্রবন্ধের অংশ।
৬। ‘‘একটা অভাবনীয় ব্যাপার ঘটেছে... এটা তো কোনও (তথাকথিত) উন্নতিশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশের ব্যাপার নয় - এটা তো ইয়োরোপ’’ ইংল্যান্ডের আইটিভি-তে প্রচারিত।
৭। ‘‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ আমরা তো সিরিয়া থেকে পালানো শরণার্থীদের বিষয়ে বলছি না এখন, বলছি ইয়োরোপীয়দের কথা। ফরাসি বিএফএমটিভি-র আরেকটি ভাষ্য।
৮। ‘‘মোদ্দা কথা এঁরা সিরিয়া থেকে পালিয়ে-আসা শরণার্থী নয়, এরা সবাই ইউক্রেনের মানুষ, এঁরা খ্রিস্টান এবং গায়ের রঙ শাদা। এঁরা তো সম্পূর্ণভাবেই আমাদেরই মতো।’’ ...এই প্রগাঢ় বর্ণবিদ্বেষী বক্তৃতাটি শোনা গেছে এনবিসি-র পোল্যান্ডে অবস্থিত সংবাদ প্রতিনিধি কেলি কোবেইলার কণ্ঠে। যে পোল্যান্ড উত্তর আফ্রিকা কিংবা পশ্চিম এশিয়া থেকে উদ্বাস্তু হয়ে-আসা শরণার্থীদের নিতে অস্বীকার করেছে আগে, সেই পোল্যান্ডই এখন ইউক্রেনীয়দের আশ্রয় দিতে দরজা খুলে দিল কেন - তারই সাফাই হিসেবে এই কুৎসিত কথাগুলো সাড়ম্বরে বলেছেন তিনি!
।। দুই ।।
আলোচনাটা শুরু করেছিলুম ‘ঘৃণা’ এবং ‘বিদ্বেষ’ - এই দুটো প্রবণতা যুদ্ধের উপলক্ষ্যে উসকে ওঠে, মুখে কোভিড প্রতিরোধক মুখোশটা থাকলেও ভদ্র মানুষের মুখোশ খসে গিয়ে কীভাবে প্রকট হয়ে ওঠে, সেটা বলেই। এই অভাজনের কথার সমর্থনেই হোমরা-চোমরা, সব সায়েব-সুবোদের সুভাষিতগুলি তুলে দিলুম। এগুলো বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই অবশ্যই! কী তীব্র ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ উথলে-উথলে উঠেছে উদ্ধৃত কথাগুলোর মধ্যে - তা তো ব্যাখ্যা ছাড়াই সুস্পষ্ট। এটা অন্য সময়ে চাপা থাকে, এখন নিজেদের ঘরে আগুনের আঁচ লেগেছে, অমনি ভদ্রতা, সভ্যতা, ভব্যতা, শালীনতার রঙ-পালিশ খসে গিয়ে খড়-মাটি-বাঁশের ছিল্কে বেরিয়ে পড়েছে একেবারে।
এটা ঠিকই যে, কোনও যুদ্ধই শ্রেয় নয় এবং দুপক্ষেরই যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয় - তাহলে সমস্ত যুদ্ধকেই এড়িয়ে, আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই উন্মার্গগামী জাতীয় অহঙ্কার, ঈর্ষা-প্রবণতা এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৃতীয়-চতুর্থ পক্ষের উসকানি দু-তরফকে - এই সবই হলো যুদ্ধের জড়্। এছাড়াও আছে; নিজেদের দেশের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে অপারগ হলে, প্রতিবেশীকে জুজু বানিয়ে তার ভয় দেখিয়ে যুদ্ধ বাধানো এবং হাঁফ-ছেড়ে-বাঁচাও যুদ্ধের আরেকটা কারণ। আসলে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার এই বেদনাবহ যুদ্ধটা কিন্তু বিশ্বের রাজনৈতিক সমীকরণের বেশ কিছু এলোমেলো করে দিল। ইউক্রেন-যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ যদি হয় রাশিয়া-বেলোরাশিয়াকে সন্ত্রস্ত করতে চাওয়া নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি (ন্যাটো) অর্গানাইজেশনভুক্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে, তাহলে পরোক্ষ কারণটা হলো ওই দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী রুশভাষী, রুশ উৎসজ স্লাভদের নব্য নাৎসিপন্থী, সরকারি প্রশ্রয়ধন্য অ্যাজাভ পার্টির সদস্য, সমর্থকদের হাতে গত বছর তিরিশ ধরে লাঞ্ছিত, অবমানিত, বঞ্চিত, উৎপীড়িত হওয়াও। যে কারণে ওই অঞ্চলের দুটি প্রদেশ ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায়, এমনকী খাস রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তিও তাদের বাঞ্ছিত। স্পষ্টতই, ইউক্রেন এখন দ্বিধাবিভক্ত - একদল চরম দক্ষিণপন্থী, ন্যাটোর অনুগামী, দক্ষিণপন্থী ভূতপূর্ব-কমেডিয়ান, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি জেলেনেস্কির সরকারের সঙ্গে থাকতে চায়। অন্যরা - সংখ্যায় তারাও খুব কম নয়, সাবেক সোভিয়েত আমলের মতো স্বচ্ছন্দে বাঁচতে আকাঙ্ক্ষী। ফলে, এটাও বুঝতে হবে যে, এই যুদ্ধের উৎসে আরও একটা ব্যাপার আছে।
রাশিয়ার পক্ষে দোনেৎস্ক, ক্রিমিয়া এবং লুহানস্কি অঞ্চলের মূলত রুশীয় জাতি ও রুশ সংস্কৃতির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাটাও একটা কারণ। আর আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাটো’ও তো ইউক্রেন সরকারকে উসকিয়ে দিয়ে এখন - ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লিপ সার্ভিস’ দেওয়া - তাই করছে। এবং তারা যে সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে পাঞ্জা কষতে যাবে না ময়দানে নেমে, সেটাও এই একপক্ষকালের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ দেশের দক্ষিণপন্থী, ধনকুবেরদের পরিপোষ্য একটা টিভি প্রথম দিন থেকেই ‘‘এই ৩য় বিশ্বযুদ্ধ লেগেই গেল এবার’’ - এসব বলে টলে যাচ্ছে বটে, তবে বাস্তবে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। ‘ন্যাটো’ রাশিয়াকে একটু পরখ করে নিতে চাইছে এবং রাশিয়াও জবাবে তাদেরকে চমকে দিচ্ছে; ফলে ব্যাপারটা ওই অবধিই থাকছে এবং থাকবেও। মাঝখান থেকে ন্যাটো তথা মার্কিনিরা জেলেনেস্কি সরকারকে সুকুমার রায়ের ‘হ-য-ব-র-ল’ বইয়ের ন্যাড়ার মতো (যে পয়সা পাবার আশায় আসামি সাজতে রাজি হয়েছিল!) গাছে তুলে দিয়ে মইটা ধরে থাকছে না! জেলেনেস্কি ইউক্রেনের আকাশপথ ‘নো ফ্লাইং’ করাতে চাইলেও, অর্থাৎ আকাশে ‘ন্যাটো’-র প্লেনের পাহারা চাইলেও, স্যাম চাচার ভাইপোরা হঠাৎ বধির হয়ে গেছে সেই প্রার্থনার পরে!
।। তিন ।।
যে দেশ আক্রান্ত হয়, এবং তার আত্মরক্ষার ক্ষমতা থাকে না সে ভাবে - তার মতো দুর্ভাগা কোনও রাষ্ট্র নয়। দেশটা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, প্রাক্তন সোভিয়েত আমলের আর্থ-সামাজিক সুফল এখনও সেখানে কিছু কিছু ছিল, কিন্তু এই যুদ্ধের পরে যে ধ্বংসস্তূপ পড়ে থাকবে সারা ইউক্রেনে, সেখানে আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দূরে থাক, বেঁচে থাকবার জন্যে যৎসামান্য রসদও যে কীভাবে জোটাবে মানুষ সে তো কোটি টাকা দামের প্রশ্ন! সে কথার উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।
যে প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরি আবার। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের একটা সূত্র যে লুকিয়েছিল আহেলা-ইউক্রেনীয় হিসেবে দাবি করাদের উৎপীড়নে রুশজ-ইউক্রেনীয়দের জর্জরিত হওয়া এবং সেই উৎপীড়নের কারণটা জাতিবিদ্বেষজাত যতখানি, ততখানি রাজনৈতিক নয়। সে তো ওদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, যদিও তার ফলে বিশ্বের অর্থনীতির ওপর একটা চাপও পড়তে শুরু করেছে।
কিন্তু বিদ্বেষের ভিন্নতর মূর্তিও যে দেখা গেল এই উপলক্ষ্যে! ইউক্রেন থেকে যে ভারতীয় এবং আফ্রিকী ছাত্রছাত্রীরা এই বিপর্যয়ের মধ্যে দেশে ফিরতে চাইছে, ও দেশের সৈন্যরা ক্রমান্বিত বিপর্যয়ে মুহ্যমান হয়ে রাগের জ্বালাটা মেটাচ্ছে তাদেরকে মেরেধরে, ট্রেন থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দিয়ে, কুৎসিত গালমন্দ করে। এমনকী ভারতীয় ছাত্রীরাও দেশে ফেরার চেষ্টা করার সময়ে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে। কেন? যে গৌরবর্ণ নীলচক্ষু স্বর্ণাভকেশীদের অত মাহাত্ম্য গাইছে পশ্চিমি মিডিয়া, সেই ‘ইয়োরোপীয়’ এবং ‘উন্নত’ (?) সভ্যতার দেশপ্রেমিকদের এ কী আচরণ? ভারতীয়দের সম্পর্কে ওদের বিদ্বেষ - কেন ভারত সরকার এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন করছে না? কেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলছে না? ইত্যাদি, ইত্যাদি। প্রথম কথা, কোনও দেশের বৈদেশিক নীতি সে দেশের ছাত্রছাত্রীরা নির্ণয় করে না, করে তাদের সরকার? তো, সরকারের পলিসির জন্যে ছাত্রছাত্রীরা দায়ী হবে কী করে?... এই সহজ, সরল সত্যটা অবশ্য অ্যাজাভপন্থী নব্য-নাৎসিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সরকারের সৈন্যরা বুঝবে না; কারণ তাদের আদি পিতা অ্যাডলফ হিটলারের বক্তব্য ছিল, ‘‘তুমি যদি আমার পক্ষে না দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষ হতে চাও, আমার সিদ্ধান্ত - তুমি আমার শত্রু।’’ তাই এই নয়া-নাৎসিদেরও ভারতীয়দের ওপর এত বিদ্বেষ! এ যেন অবশ্য সেই ঈশপ’স ফেবলসের গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়ঃ ‘‘তুই আমার ক্ষতি না করলেও তোর বাপ করেছে, তাই তোকে খাবো!’’ আর আফ্রিকী ছাত্রছাত্রীদের ওপর ওদের ঘৃণা-বিদ্বেষ তো বহু-বহু কালের পুরোনোঃ কালো মানুষদের তো শাদা মানুষরা - মানুষ বলেই মানতে চায় না! আমেরিকার নিগ্রো লিঞ্চিং তো ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়গুলির একটা! সেই কলঙ্কের কালি তো এখনও নির্মাঞ্ছিত নয়। এবং এই বর্ণবিদ্বেষ শুধু আমেরিকা কেন, ইয়োরোপেরও প্রায় সর্বত্র চোরাগোপ্তাভাবে বহমান। তার সদ্য-সদ্য প্রমাণ তো উদ্ধৃত ‘সুভাষিত’ (!)-গুলির মধ্যেই মিলছে।
আর ভারতের সমর্থন দাবি করছে ইউক্রেন! কোন্ মুখে? ভারতের কোন্ আন্তর্জাতিক সমস্যায় ইউক্রেন ভারতের পক্ষে কথা বলেছে? বরং রাশিয়া তা বলেছে, কমিউনিস্ট রাশিয়া তো বটেই - এমন কি এই গ্লাসনস্ত-পেরোস্ত্রৈকা-উত্তর রাশিয়াও কিন্তু তা করেছে। এমন কি, বিশ্বের বৃহত্তম ইউরেনিয়াম সম্পদের অধিকারী ইউক্রেন, ভারতের পারমাণবিক গবেষণার জন্য সেই বস্তু বারংবার কিনতে চাওয়ার পরেও, প্রচুর দাম দিতে চাওয়া সত্ত্বেও, আমেরিকার প্রত্যক্ষ নিষেধে সেটা বেচেনি। আমেরিকার স্বার্থ তাতে ক্ষুণ্ণ হবে যে! ...এরপরেও ভারতের সমর্থন তারা চায় কেন? কোন্ মুখে? এই সূত্রেই বলিঃ কিছু কিছু পাঁড়-দক্ষিণপন্থী কাগজপত্রে, ফেসবুকে, ইন্সটাগ্রামে কেন ভারত এই যুদ্ধে ইউক্রেনের সমর্থনে দাঁড়াচ্ছে না? বিশেষত বামপন্থীরা যারা না কি (তাদের ভাষায়) কথায়-কথায় মিছিল করে, হইচই করে - তারা চুপচাপ আছে কেন? এইসব বলে হা-হুতাশ এবং চিপটেনে ভরাচ্ছেন কাগজের পাতা। এই ব্যক্তিরা তো মার্কিনিদের সঙ্গে নিজেদেরকে একাত্ম করেই দেখে - তাই ইউক্রেন এখন নাৎসিবাদের দিকে ঝুঁকলেও মার্কিন দেশের সমর্থনপুষ্ট, সুতরাং এরা ইউক্রেনের পক্ষে ভারত ও ভারতীয়দের নামাতে চায়। ...মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
সবশেষে, এই যুদ্ধের সুবাদে ঘৃণার চাষ কত ব্যাপক হয়ে উঠেছে তার একটা অ্যাকাডেমিক সংবাদের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিঃ ইতালির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের সর্বদেশের, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক ফিওডোর ডস্টয়েভস্কির ওপর একটি নির্ধারিত পাঠক্রম বাতিল করে দেওয়া হয়েছে! মনে রাখুন, ইতালি ন্যাটোভুক্ত দেশ এবং মহান লেখক ডস্টয়েভস্কি জন্মসূত্রে রুশীয়! অন্ধ ঘৃণা এবং বিদ্বেষ কতদূর গড়াতে পারে, এটা তার ভয়ঙ্কর এক নমুনা। ডস্টয়েভস্কির দ্বিশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ইতালির বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান জানালো বটে!