E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১১ মার্চ, ২০২২ / ২৬ ফাল্গুন, ১৪২৮

পুস্তক আলোচনা

একটি ছোট্ট বই এবং দাবানলের প্রস্তাবনা

সৌম্যজিৎ রজক


উত্তরাখণ্ডের চম্পাবত জেলার একটি বাচ্চাদের স্কুলে কিছু ছাত্র মিড-ডে মিলের খাবার খেতে অস্বীকার করেছে। কেননা যিনি রেঁধেছেন তিনি একজন দলিত মহিলা এবং তারা সব বাবুর ঘরের ছেলেপিলে। উচ্চবর্ণজাত। এই ঘটনা সামনে এসেছে কয়েকদিন আগেই। যদিও এই প্রথম নয়। এরকম ঘটনার কথা শোনা যায় মাঝেমাঝেই। মুচির রাঁধা ভাত খাব না, ডোমের হাতে জল খাব না জাতীয় অহংকার এদেশের এক বিরাট অংশের মানুষের সামাজিক চেতনার অন্তর্গত। আজও, এই একুশ শতকেও। তবুও কী অপরিসীম গর্ব আমাদের এই দেশের জন্যে। সে গর্ববোধ থাকাই উচিত। কত মহাপুরুষ জন্মেছেন এই দেশে! কত সব প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ! আমরা স্মরণ করি তাঁদের আবির্ভাব কিংবা প্রয়াণ দিবসে, ফুলমালা চড়াই ছবিতে। যদিও অল্প দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এই মহাপুরুষেরা সকলেই কেন পুরুষ, এপ্রশ্ন ভাবিনা সাধারণত। আচ্ছা, এই দেশে যতজন মহাপুরুষ জন্মেছেন আর যতজন নারী ভ্রূণাবস্থাতেও খুন হয়ে গেছেন, কাদের সংখ্যা বেশি হবে? হিসেব কষতে বসি না কখনো, ভাগ্যিস!

জন্মাতে পারলেও মেয়েরা সুযোগ পায় না লেখাপড়ার, খেলাধুলোর, নিজেকে মেলে ধরার। আজও এই একুশ শতকের ভারতেও এটা বাস্তবতা। পাঠককে অনুরোধ করি, একটিবার আজ থেকে দেড়-দুশো বছর আগের কথাটা কল্পনা করতে। জায়গাটা ধরে নিন, এবাংলাও নয়, সুদূর মহারাষ্ট্র।

সে প্রদেশের সাতারা জেলার একটি গ্রাম নাইগাঁও-তে ১৮৩১ সালে সাবিত্রীর জন্ম। তাও আবার কোনো অভিজাত, আলোকপ্রাপ্ত, অঢেল সুযোগ-সুবিধেওয়ালা উচ্চ বংশে নয়। সীমিত বিত্তের এক কৃষক পরিবারে, যারা কীনা আবার জাতিতে মালি। অস্পৃশ্য নাহলেও ‘নিচু জাত’। দলিত সাবিত্রী ছোটো থেকে বেশ ডাকাবুকো, ডানপিটে। লেখাপড়ার দিকে খুব টান ছিল তার। কিন্তু যে পরিবারে, যে পরিবেশে তার জন্ম ও বড়ো হওয়া একটি মেয়েকে ‘‘সেখানে পড়াশোনা শেখানো, না শেখানো কারো ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয় ছিল না। সমাজের বাধা ছিল।’’

বাধা কেবল যে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেই ছিল তা নয়, শূদ্র-অতিশূদ্র ছেলেদেরও লেখাপড়ার অধিকার ছিল না। এমন সমাজে একে দলিত তাও মেয়ে, এমন সাবিত্রীর গতি কী? কী করবে সে? কী করেছিল জীবনে?

ঊনিশ শতকের ভারতে, মহারাষ্ট্রে যেমনটা হওয়া স্বাভাবিক ছিল, তেমনই ঘটে। মাত্র ৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় সাবিত্রীর। পাত্রের বয়স ১৩, সেও মালির ঘরের সন্তান। রীতিমাফিক সেটাই ছিল স্বাভাবিক। গতে বাঁধা, কিন্তু বিয়ের পরের জীবনটা আর গতে বাঁধা, রীতিমাফিক, ‘স্বাভাবিক’ খাতে বইল না ওঁদের। সাবিত্রী আর তার নতুন সাথী জ্যোতিরাও-এর।

‘‘যখন জ্যোতিরাও মাঠে কাজ করতেন আর সাবিত্রী দুপুরে তাঁর খাবার দিতে যেতেন, তখন সবার অলক্ষ্যে জ্যোতিরাও তাঁকে পড়াতেন।... এভাবেই সাবিত্রীর পঠনপাঠন চলতে থাকল।’’ যদিও গোপন কথাটি থাকে না গোপনে, জানাজানি হয়েই যায়। উচ্চবর্ণজাত সমাজপতিরা চাপ দিতে থাকে জ্যোতিরাও-এর বাবাকে; তিনি চাপ দেন ছেলেকে। চাপ পড়ে সাবিত্রীর উপরেও, এবং দু’জনে, কী আস্পর্ধা, সেই সমাজে সেই সময়ে এ দম্পতি পরিবার ত্যাগ করে লড়াইতে অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত নেন। যৌথ পরিবার ত্যাগের পর তুমি-আমি দু’জনের ঘর বাঁধাই লক্ষ্য ছিল না জীবনের, কয়েক বছরের মধ্যে এঁরা একটা আস্ত স্কুল গড়ে তোলেন পুনেতে। মেয়েদের জন্য স্কুল। ভাবা যায়?

অকল্পনীয় দুরন্ত এ জীবনের কাহিনি, সংগ্রামের কাহিনি পড়তে পড়তে চমকে যেতে হয় পদে পদে। আরও চমকাতে চান পাঠক? পুরো গল্প তো এখানে লেখা যাবে না, সেসব জানতে হলে একটি পাতলা বই আপনাকে সংগ্রহ করে পড়ে ফেলতে হবে। মাত্র ৩৯ পাতার। অধ্যাপক দেবী চ্যাটার্জীর লেখা ‘‘সাবিত্রীবাঈ ফুলে... জীবন ও মনন’’। প্রকাশক পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চ কলকাতা জেলা কমিটি। শুরু করলে শেষ অবধি আপনাকে পড়তেই হবে এ বই, না পড়ে রেহাই পাবেন না।

বইটি পড়ার জন্য, সাবিত্রীবাঈকে জানার জন্যে পাঠককে আরেকটু প্ররোচিত করার চাহিদায় কয়েকটা তথ্য সরবরাহ করি! স্কুলটি যখন তৈরি হয় তখন ছাত্রী ছিলেন মাত্র ৯ জন‍, সকলেই শূদ্র-অতিশূদ্র পরিবারের সন্তান। সেটা ১৮৪৮ সাল। সংখ্যা বেড়ে প্রথমে হয় ২৫, তারপর ৭০-এ পৌঁছায়। ৩ জুলাই, ১৮৫১ আরেকটি স্কুল তৈরি করেন ওঁরা। সে বছরই ১৭ নভেম্বর তৃতীয় স্কুল চালু করেন। পরের বছর আরও একটি। ’৪৮-এ ৯ জন ছাত্রী থেকে ’৫২-তে সবমিলে প্রায় দেড়শো ছাত্রী। ক্রমে মহারাষ্ট্রজুড়ে মোট ১৮টি স্কুল তৈরি করেন এঁরা। মেয়েদের স্কুলের প্রথম বার্ষিক পরীক্ষা হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫২ এবং দ্বিতীয়টি ১২ ফেব্রুয়ারি ’৫৩-তে। পরীক্ষা দেন ২৩৭ জন। সহজ সরল ঢঙে লেখা এই ছোট্ট বইটিতে এরকমের চমকপ্রদ বহু তথ্য দিয়েছেন দেবী চ্যাটার্জী। তথ্যের ভারে কখনোই গল্প বলার ঢঙে বিবৃত জীবনকাহিনিটি হোঁচট খায় না যদিও। ১৮৫২’র ২৯ মে তারিখের ‘পুনা অবজারভার’ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে তথ্য তুলে এনে তিনি আরেকটি চমকে যাওয়ার মতো তথ্য হাজির করেছেন পাঠকের সামনে। ‘‘...তাতে লেখা হয় সরকারি স্কুলের ছাত্রের তুলনায় এদের স্কুলছাত্রীর সংখ্যা দশ গুণ বেশি।’’

সাফল্য কিন্তু স্রেফ সংখ্যায় পরিমেয় নয়, কীর্তি কেবলই অঙ্কে মেলে না। এই ছোট্ট বইটিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সাবিত্রীবাঈয়ের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিটিরও পরিচয় মেলে। নিচু জাতের, কার্যত দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের স্কুলমুখী করে তোলার আগে প্রয়োজন পেটের খিদে মেটানোর বন্দোবস্ত। সাবিত্রীবাঈ যে স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা, বস্তুত, সেটিই এদেশের প্রথম স্কুল যেখানে মিড-ডে মিল চালু হয় এবং সেটা, আবারও স্মরণ করাই, ঊনিশ শতকে।

শিক্ষা প্রসারে, নির্দিষ্টভাবে নারী ও দলিতদের মধ্যে শিক্ষাপ্রসারে এই বিরাট ভূমিকা পালনেই তাঁর কাজ ফুরিয়ে যায়নি।

‘‘এখানে কাশীবাঈ-এর কথা না বললেই নয়। ‌‌‌...কাশীবাঈ ছিলেন গরিব, সুন্দরী, যুবতী এক সম্মানীয় ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবা। অন্য আর পাঁচটি মেয়ের মতোই, নিরক্ষর। পড়শি এলাকায় থাকা এক চতুর শাস্ত্রী তার অসহায়তার সুযোগ নেয়, যার ফলে কাশীবাঈ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। তাঁর গর্ভপাতের সব চেষ্টা বিফল হয়। একটি অতি সুন্দর শিশু জন্মগ্রহণ করে। বলা বাহুল্য, সেই শয়তান শাস্ত্রী কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি হয় না। নিরুপায় বোধ করে তখন কাশীবাঈ সমাজের ভয়ে, শিশুটির গলা কেটে তাকে মেরে ফেলেন। তারপর সেই শিশুর মৃতদেহ একটি কুঁয়োয় ফেলে দেন।’’ ঘটনাটা ১৮৬৩ সালের। কাশীবাঈ আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পান। এরকমের ঘটনা সেসময় খুব ব্যতিক্রমী ছিল না কিন্তু! কম বয়সে বিয়ে হওয়া, কম বয়সে বৈধব্য, তারপর নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া এবং পরবর্তী সংকট বহু মহিলাকে আত্মহত্যার পথেও ঠেলে দিত। কাশীবাঈয়ের ঘটনায় সাবিত্রীবাঈ ও জ্যোতিরাও ভীষণই নাড়া খেয়ে যান এবং নিজেদের সীমিত সামর্থ্যেই পুণেতে বিপন্না বিধবাদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেন। নিজেদের বাড়িতেই। এখানে অন্তঃসত্ত্বা বিধবা মহিলারা এসে নিরাপদে থাকতে, সন্তান প্রসব করতে এবং সে সন্তানকে কারোর দত্তক নেওয়ার জন্য রেখে যেতে পারতেন। এটি সম্ভবত ভারতে প্রথম শিশুহত্যা রোধের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। প্রসঙ্গত, এঁরা নিজেরাও এমন এক শিশুকেই দত্তক নেন, বড়ো করেন।

সাবিত্রীবাঈ ফুলে আজ থেকে এতদিন আগে আরও পশ্চাৎপদ একটা সমাজে দাঁড়িয়ে যে সকল দুঃসাহসিক কাজ করেছেন, তা আজও আমাদের কাছে কঠিন কল্পনা মনে হয়। হিম্মত না থাকলে এসব ভাবাও যায় না। উনি করে গেছেন, আর আমরা এমনই অভাগা যে কেবলই বিস্মৃত থেকেছি। ভুলে গেছি ওঁকে। ভুলে না গেলে বলতে পারবেন ভারতে প্রথম নাপিতদের ধর্মঘট কেন হয়েছিল? কার সাংগঠনিক উদ্যোগে? দেবী চ্যাটার্জী জানাচ্ছেন এই বইতে, ‘‘ব্রাহ্মণ বাড়ির বিধবা মেয়েদের মাথা নেড়া করে দেওয়ার চল অনেকদিনই ছিল। তাদের মাথার চুল সপ্তাহে সপ্তাহে একাধিকবার করে মুড়িয়ে দেওয়া হতো সারাজীবন ধরে যাতে এতটুকু বড়ো না হয়।… সাবিত্রী এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাঁরই প্রচেষ্টার ফলে এই প্রথার বিরুদ্ধে এগিয়ে এসে নাপিতরা ধর্মঘট করেন। এ ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা।’’

আমরা বহু বই পড়ি, পড়েই চলেছি ছোটোবেলা থেকে। সেসব বই থেকে ইতিহাস জানি আমরা, ইতিহাস শিখি। অথচ এমন ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি কেন অজানাই থেকে গেছে আমাদের? জানানো হয়নি বলে। জানতে দেওয়া হয়নি বলে। যারা ইতিহাস লেখেন, ইতিহাস আজও যাদের দখলে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য এই ইতিহাস লুকিয়ে রাখা ভীষণই জরুরি। ওরা তাই লুকিয়ে রাখতে চান। আর হায়, ওরা সফলও হন, লুকিয়ে রাখতে পারেনও বটে। সাবিত্রীবাঈ ফুলের জীবন নিয়ে, এমনকী এ বাংলা ভাষাতেও, কোনো বই লিখিত হয়েছে কী আগে? সম্ভবত হয়নি, অন্তত খোঁজ পাইনি। সেদিক থেকে দেখলে অধ্যাপক দেবী চ্যাটার্জি এযাবৎকাল পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা এক গোপনীয়তার পর্দা সরিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সাবিত্রীবাঈ ফুলের মতন একজন মানুষকে। আমাদের জানিয়েছেন তাঁর সংগ্রামের কথা, এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতাতেই।

সংগ্রাম যুগপৎ পিতৃতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। সনাতন জীর্ণ কু-আচারের বিরুদ্ধে। সংগ্রাম আলোকের, প্রগতিশীলতার। পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চ কলকাতা জেলা কমিটি এ বই প্রকাশ করে নিজ দায়িত্ব পালন করেছে। আপনিও পড়ে ফেলুন বইটি ঝটপট। নিজে পড়ার পর আপনার ইচ্ছে হবে, হবেই বইটি বন্ধুদের ডেকে ডেকে পড়ানোর, মিলিয়ে নেবেন।

এমনই সহজ, সরল ঝরঝরে গদ্যভাষা দেবী চ্যাটার্জী’র যে, কিশোর-কিশোরীদেরকেও এ বই পড়ানো যেতে পারে। পড়ানো দরকার। গাছে গাছে সাবিত্রীবাঈয়ের কথা ছড়িয়ে না দিতে পারলে দাবানল জন্মাবে কীভাবে?


সাবিত্রীবাঈ ফুলে - জীবন ও মনন
লেখকঃ দেবী চ্যাটার্জী
প্রকাশকঃ পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চ, কলকাতা জেলা কমিটি
মূল্যঃ ২৫ টাকা