৬০ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১১ নভেম্বর, ২০২২ / ২৪ কার্ত্তিক, ১৪২৯
গ্রাম জাগিয়ে চোর তাড়িয়ে বাংলা বাঁচানোর স্লোগান ক্রমশ জোরালো হচ্ছে গ্রামীণ পদযাত্রায়
খণ্ডঘোষের চাগ্রামে পদযাত্রায় সাধারণ মানুষ। ছবিঃ পার্থপ্রতিম কোনার
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ‘গ্রাম জাগাও, চোর তাড়াও, বাংলা বাঁচাও’ - এই স্লোগানকে সামনে রেখে ১ নভেম্বর থেকে গ্রাম বাংলা জুড়ে শুরু হয়েছে জনমানুষের পদযাত্রা। গ্রামের পরিকাঠামো উন্নয়ন, গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থান, শিল্প স্থাপন, ফসলের ন্যায্য দাম ও মজুরি, প্রাপ্য সরকারি প্রকল্পের সুবিধা আদায় এবং পঞ্চায়েতে শাসকদলের বেপরোয়া লুঠ ও অরাজকতার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে এই দুর্বার পদযাত্রা। সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষক সভা ও সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের ডাকে নভেম্বর মাস জুড়ে গ্রামে গ্রামে এই পদযাত্রা চলবে। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, এসএফআই, ডিওয়াইএফ আই, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ সহ অন্যান্য গণসংগঠনও গ্রামীণ এলাকায় পদযাত্রায় শামিল হয়েছে। এই পদযাত্রার মধ্যে দিয়ে রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
তৃণমূলের জমানায় পঞ্চায়েতগুলি শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের লুঠের আখরায় পরিণত হয়েছে। গ্রামের মানুষদের হাতে কাজ নেই, কিন্তু শাসকদলের স্থানীয় মাতব্বরদের পঞ্চায়েতের টাকা লুট, কাটমানি, তোলাবাজি রমরমিয়ে চলছে। গ্রামের অসংগঠিত শ্রমিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে চলে যাচ্ছে ভিন রাজ্যে। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকায় কাটমানি খাওয়ার ভুরি ভুরি অভিযোগ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গ্রামের উন্নয়নের কাজ সমস্তই বন্ধ। রাস্তা তৈরি ও সারাই, পুকুর খনন - সমস্ত প্রকল্পের অর্থ চুরি হয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে একশো দিনের কাজে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির ফলে ভুগছেন লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ। এই অবস্থায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে কৃষি উপকরণের ভরতুকি প্রত্যাহারের ফলে গভীর সংকটে পড়েছেন কৃষক-খেতমজুররা। গ্রামের অসংখ্য মানুষের রেশন কার্ড না থাকায় মিলছে না কোনো সুযোগসুবিধা। গ্রামীণ জনজীবনে যখন এমনই সংকট জাঁকিয়ে বসেছে, তখন বিজেপি-আরএসএস মত্ত গ্রামীণ মানুষের মধ্যে বিভাজন কায়েম করতে।
এই সমস্ত দুর্নীতি, অবিচার, নৈরাজ্য দূর করে ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায়ে গ্রামের মানুষেরা শামিল হয়েছেন পদযাত্রায়। রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির ব্লকে ব্লকে-গ্রামে গ্রামে মানুষ সমস্ত ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তাঁদের হকের দাবিতে সরব হয়ে লাল ঝান্ডা নিয়ে শামিল হয়েছেন পদযাত্রায়। শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর সহ গ্রামীণ এলাকার সমস্ত অংশের মানুষ দল বেঁধে বেরিয়ে আসছেন এবং লুঠেরাদের হাত থেকে পঞ্চায়েতকে উদ্ধার করে চোর তাড়িয়ে বাংলার বুথে বুথে দুর্গ গড়ার ডাক দিচ্ছেন।
সাগর থেকে পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চল - সমস্ত গ্রামীণ জনপদে এই পদযাত্রাকে ঘিরে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই পদযাত্রার প্রস্তুতিতে চলছে বাড়ি বাড়ি প্রচার, গ্রামসভা। তৃণমূলের সন্ত্রাস কবলিত হুগলির গোঘাট, খানাকুল, কোচবিহারের শীতলকুচির আক্রান্ত গ্রাম, বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, আবার পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার গ্রামেও গরিব শ্রমজীবী মানুষ সমস্ত ভয় ভেঙে মিছিলে অংশ নিয়েছেন। মিছিল হয়েছে ডেবরা, নারায়ণগড়, গড়বেতার বিভিন্ন ব্লকে। এমনকী এক সময়ে মাওবাদী-তৃণমূলের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত ঝাড়গ্রামের বাঁশপাহাড়ি থেকে সাঁকরাইল - জঙ্গলমহলের প্রতিটি ব্লকেই মিছিল চলছে। চন্দ্রীর মতো সন্ত্রাস কবলিত এলাকাতেও লাল ঝান্ডার দৃপ্ত মিছিল সংগঠিত হয়েছে। মিছিল হয়েছে শালবনীতে। এই সমস্ত মিছিলে আদিবাসী মানুষেরাও বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছেন।
পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়া, কাঁকসার জঙ্গলখণ্ডের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে লালঝান্ডার বর্ণময় পদযাত্রা সাড়া ফেলেছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলে বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে অংশ নেওয়া পদযাত্রীরা অন্যান্য ন্যায্য দাবির পাশাপাশি হলদিয়া শিল্পাঞ্চলকে বাঁচানোর দাবি তুলেছেন। এছাড়াও পদযাত্রা হয়েছে জেলার নন্দকুমার ব্লকের ব্যবত্তাহাট অঞ্চলে, এক সময়ে তৃণমূলের হামলা-সন্ত্রাসের শিরোনামে থাকা নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া, ভেকুটিয়া, মহম্মদপুরে। গ্রামীণ মিছিল সংগঠিত হয়েছে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাটের গ্রামীণ অঞ্চলে। শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দৃপ্ত মিছিল হয়েছে মারিশদা ব্লকের বিভিন্ন স্থানে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার উস্থি, মথুরাপুর, ভাঙড়, ডায়মন্ডহারবারের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় পদযাত্রা হয়েছে। দৃপ্ত বর্ণাঢ্য মিছিল হয়েছে মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে। এভাবেই রাজ্যের সমস্ত জেলা জুড়েই গ্রামাঞ্চল আজ জেগে উঠেছে।
লক্ষ করা গেছে, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পদযাত্রা চলাকালীন গ্রামীণ মানুষ পদযাত্রাকে থামিয়ে দিয়ে তাঁদের জীবনযন্ত্রণা, তৃণমূলের লুঠ-সন্ত্রাসের ফলে তাদের দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনার কথা অকপটে তুলে ধরছেন। এই সমস্ত পদযাত্রায় কেবল গ্রামীণ পুরুষেরাই নন, বিপুল সংখ্যায় যোগ দিচ্ছেন মহিলারা। গ্রামীণ যুবক-যুবতীরাও নতুন আশায় বুক বেঁধে শামিল হচ্ছেন পদযাত্রায়। সব মিলিয়ে রাজ্যের গ্রামীণ জনপদ আগামীদিনের দুর্বার লড়াইয়ের আহ্বানে যেন জেগে উঠছে। গ্রামের পথে পথে গ্রাম জাগিয়ে, চোর তাড়িয়ে, বাংলা বাঁচানোর সোচ্চার ধ্বনি ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে।