E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১১ নভেম্বর, ২০২২ / ২৪ কার্ত্তিক, ১৪২৯

টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণ


চাকরিপ্রার্থীদের ধরনাস্থলে বিমান বসু।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ টেট উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীদের ওপর আবারও হিংস্র আক্রমণ চালালো মমতা সরকারের পুলিশ। ৯ নভেম্বর চাকরির দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশের বর্বরোচিত হামলার শিকার হন প্রাথমিকে টেট উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীরা। এদিন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে যাবার পথে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। চাকরি প্রার্থীদের আঁচড়ে, কামড়ে, জামা ছিঁড়ে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, টেনে হিঁচড়ে প্রিজন ভ্যানে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার বাসিন্দা অরুণিমা পালের হাত কামড়ে দেয় পুলিশ, গোবরডাঙার চম্পা ঘোষকে খামচে দেওয়া হয়। পুলিশের নারকীয় অত্যাচারে বরুণ বাউড়ি নামে এক প্রার্থীকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হতে হয়। এছাড়াও পুলিশের আক্রমণে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে পুলিশ প্রিজন ভ্যানে করে প্রথমে লালবাজার ও পরে হেয়ার স্ট্রিট থানায় নিয়ে যায়। তাদের পুলিশ আটকে রাখে।

টেট প্রার্থীদের ওপর পুলিশের এই নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী, এবিটিএ-র সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন সহ অন্যান্য শিক্ষক সংগঠন ও গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

তৃণমূল সরকারের পুলিশ গত ২০ অক্টোবর গভীর রাতেও বিধাননগরে টেট প্রার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর এভাবেই নারকীয় আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল।

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির প্রতিবাদে উত্তাল রাজপথ (১) -

৪ নভেম্বর রাজ্য বামফ্রন্টের সংহতি মিছিল।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের ধরনা-অবস্থান আন্দোলন ৬০০ দিন অতিক্রম করেছে। রাজ্যের বুকে এই ঘটনা নজিরবিহীন। এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত দেশের কোথাও নেই। যোগ্য মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের এই লাগাতার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে শুরু থেকেই পাশে ছিল বামপন্থীদল ও বিভিন্ন গণসংগঠন। বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের ৬০০ দিনের নজির সৃষ্টিকারী আন্দোলনকে অভিনন্দন জানিয়ে ৪ নভেম্বর রাজ্য বামফ্রন্ট ধর্মতলায় মিছিল সংগঠিত করেছে। বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ গান্ধীমূর্তির সামনে অবস্থানরত চাকরিপ্রার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংহতি জ্ঞাপন করেন। পাশাপাশি তাঁদের আন্দোলনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন।

শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপকতম দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বেআইনি নিয়োগের সাথে যুক্ত সব অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে এবং আন্দোলনরত সব যোগ্য চাকরি প্রার্থীর নিয়োগের দাবিতে ৪ নভেম্বর বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি মিছিল গান্ধী মূর্তির কাছে ধরনা মঞ্চ পর্যন্ত যায়। এই মিছিলে অংশ নেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই’র রাজ্য পরিষদের সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, দলের রাজ্য সম্পাদক তপন হোড়, মার্কসবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের আশিস চক্রবর্তী, সঞ্জীব ব্যানার্জি, আরসিপিআই’র মিহির বাইন, সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তী, কান্তি গাঙ্গুলি, কল্লোল মজুমদার, তন্ময় ভট্টাচার্য, বলশেভিক পার্টির প্রবীর ঘোষ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির প্রতিবাদে উত্তাল রাজপথ (২) -

৯ নভেম্বর আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিবাদ।

মিছিল শেষে চাকরি প্রার্থীদের অবস্থান মঞ্চের সামনে বামফ্রন্টের সভায় বিমান বসু বলেন, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি আড়াল করতে রাজ্য সরকারের এমন মনোভাব দেখা যাচ্ছে যে, যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে এবং যাঁরা যোগ্য প্রার্থী, সকলেরই চাকরি হোক। সরকারের এই মনোভাব দুর্নীতিকে প্রশ্রয় ও বৈধতা দেওয়া। তৃণমূল জমানায় যতগুলি নিয়োগ হয়েছে, সবেতেই দুর্নীতি হয়েছে, টাকা নিয়ে নিয়োগ হয়েছে। এই দুর্নীতির জাল সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। এই জাল ছিঁড়তে না পারলে রাজ্যটা আরও রসাতলে যাবে।

সভায় স্বপন ব্যানার্জি তৃণমূল দল সম্পর্কে বলেন, এই দলের এমন কেউ নেই, যার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। সেই দল সরকার চালালে অযোগ্যদের চাকরি হয়, আর যোগ্য শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের রাস্তায় বসে থাকতে হয়। এদিনের সংক্ষিপ্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এম) নেতা তরুণ ব্যানার্জি।

এদিন অবস্থানরত চাকরি প্রার্থীদের কাছে গিয়ে বিমান বসু বলেন, নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতির জাল তৈরি হয়েছে তা ছিঁড়ে ফেলতে হবে।

এদিন সিপিআইএম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম গান্ধী মূর্তি ও মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির সামনে চাকরি প্রার্থীদের অবস্থান মঞ্চে গিয়ে চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেছেন, দিনের পর দিন রাস্তায় বসে আছেন চাকরি প্রার্থীরা। এখন আন্দোলনের তেজ আরও বাড়ছে। ওদের ৬০০ দিনের লড়াইকে আমরা কুর্নিশ জানাই। কিন্তু এটা শুধু চাকরি প্রার্থীদের বিষয় নয়, শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে সরকারের দুর্নীতিতে। তাই রাজ্যজুড়ে এই আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা গোড়া থেকেই আন্দোলনকারীদের পাশে আছি। আগামীদিনেও এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে প্রথম এসএসসি’র চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনে বসেন। ২৯ দিন অনশন চলে। এরপর বর্তমানে হাজতবাসে থাকা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে অনশন মঞ্চে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি সেখানে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলে চাকরি প্রার্থীরা অনশন প্রত্যাহার করে নেন। এরপরেও দু’বার চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই পালন করেননি মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিশ্রুতি পালন তো দূরের কথা রাজ্য সরকার বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের প্রতি চরম অবহেলা ও অমানবিক আচরণ করে চলেছে।

বিধাননগরে চাকরি প্রার্থীদের এমনই একটি শান্তিপূর্ণ অনশন আন্দোলনের ওপর গত ২০ অক্টোবর রাতে পুলিশ নৃশংস আক্রমণ চালায়। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পরদিন ২১ অক্টোবর পুলিশি হামলার শিকার হন এসএফআই, ডিওয়াইএফআই’র নেতা-কর্মী সহ পথচারীরা। রাজ্য সরকারের নির্দেশে এই পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে ২২ অক্টোবর কলকাতার বুকে প্রতিবাদী নাগরিক মিছিলে পা মেলান হাজারো মানুষ।

গত ১ নভেম্বর শিক্ষাক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, যোগ্য প্রার্থীদের দ্রুত স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগের দাবিতে কলকাতার ধর্মতলায় লেনিন মূ‍‌র্তির সামনে থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত মিছিল করে সিআইটিইউ সহ সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, ব্যাঙ্ক, বিমা, বিএসএনএল, ১২ই জুলাই কমিটি প্রভৃতি সংগঠন।

এরাজ্যে তৃণমূল সরকার আসার পর অপশাসন, দুর্নীতি, নৈরাজ্য সীমা ছাড়িয়েছে, রাজ্যে প্রতিটি নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে। বি‍‌শেষকরে শিক্ষাক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতিতে রাজ্যে কলঙ্কের নজির তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে এতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজ্যের তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষা দপ্তরের একাধিক শীর্ষকর্তা এখন হাজতবাস করছেন। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা ও বিপুল সম্পদ।

এভাবে চরম অনৈতিক ও সীমাহীন দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই কার্যত ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে তৃণমূল সরকার। এর বিরুদ্ধেই লাগাতার আন্দোলনে শামিল যোগ্য মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা। এদের এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে পাশে রয়েছে বিভিন্ন বামপন্থী দল ও গণসংগঠন।