৬০ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১১ নভেম্বর, ২০২২ / ২৪ কার্ত্তিক, ১৪২৯
নভেম্বর বিপ্লবে প্রমাণিত হলো মার্কসবাদের ঐতিহাসিক সত্যতা
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
‘সোলজারস্ অব দ্য রেভোলিউশন’। শিল্পীঃ ভ্লাদিমির খোলুয়েভ
(শেষাংশ)
।। ছয় ।।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে কৃষক সমাজের ভূমিকা সম্পর্কেও মার্কস সেই যুগের ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে তীক্ষ্ণদৃষ্টি ও অনুসন্ধান চালিয়ে ছিলেন। কৃষক সংগ্রামের সাফল্য ও দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক মঞ্চ কৃষক সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। বিশেষত, ১৮৪৮ সালের ফ্রান্সের বিপ্লবের পরাজয়ের কারণগুলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখলেন - ‘‘বিপ্লবের গতিপ্রবাহ প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়ার মধ্যবর্তী জাতির অধিকাংশ জনসমষ্টিকে, কৃষক ও পেটি বুর্জোয়াকে, যতদিন পর্যন্ত ওই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে, পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে উত্থিত না করে তুলছে এবং তাদের মুখপাত্রস্বরূপ প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে তাদের সংযুক্ত হতে বাধ্য না করছে, ততদিন ফরাসি শ্রমিকেরা একপাও অগ্রসর হতে পারেনা, বুর্জোয়া ব্যবস্থার কেশ স্পর্শ করতে পারে না।’’ (ফ্রান্সে শ্রেণিসংগ্রাম ১৮৪৮-৫০)।
শ্রমিকশ্রেণিকে শুধু কৃষকদের মিত্র হলে চলবে না। সংগ্রামী কৃষকদের মুখপাত্র হতে হবে, তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে। সমাজের সমস্ত শোষিত অংশকে মূল শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির ‘ভ্যানগার্ডের’ ভূমিকা।
১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক ব্যর্থতা শ্রমিক-কৃষক মোর্চার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিকে, নিদারুণ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল। প্যারি কমিউনের সময় ফ্রান্সের কৃষক সমাজের অর্থনৈতিক দুর্দশা যদিও চরম সীমায় পৌঁছেছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও প্যারি কমিউন কৃষকসমাজকে সঙ্গে আনতে পারেনি। প্রুধোঁ ও ব্লাঙ্কিপন্থী সোশ্যালিস্টরা যারা ছিল প্যারি কমিউনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তারা কৃষক সমাজকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেই মনে করত এবং বিপ্লব থেকে তাদের শতহস্ত দূরে রেখেছিল। এরফল হয়েছিল মারাত্মক। বুর্জোয়া শাসকদের নেতা তিয়ের কমিউনের বিরুদ্ধে, শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে গ্রামাঞ্চলের কৃষক সমাজকে উত্তেজিত করে এর বিরুদ্ধাচরণ করাতে বাধ্য করেছিল। কমিউন স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৭২ দিন। কিছু আশ্বাসবাণী ছাড়া প্যারি কমিউন কৃষকদের স্বার্থে কার্যত কোনো সদর্থক কর্মসূচিও নিতে পারেনি।
কমিউনের এই ব্যর্থতা সমস্ত শ্রমিক আন্দোলনের সামনে অমূল্য শিক্ষা উপস্থিত করল। কৃষকদের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির পার্টির কাজের গুরুত্বের নির্দেশ করে পরবর্তী সময়ে এঙ্গেলস লিখলেন, ‘‘সমাজতন্ত্রী পার্টির দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল আজ আর সুদূর ভবিষ্যতের ব্যাপার নয়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে হলে এই পার্টিকে প্রথমে শহর থেকে গ্রামে প্রবেশ করতে হবে, গ্রামাঞ্চলে একটি শক্তি হয়ে উঠতে হবে।’’ (ফ্রান্স ও জার্মানির কৃষক সমস্যা)।
নভেম্বর বিপ্লব এই শিক্ষার আলোতেই অগ্রসর হয়েছে। সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পূর্বাহ্নে লেনিনের কৃষিসংক্রান্ত কর্মসূচি, ‘গ্রামের গরিবদের প্রতি’ ছিল রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে শ্রেণিসংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেও লেনিন কৃষক সমাজের আন্দোলনের দুর্বলতাগুলিকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন, যে দুর্বলতা ১৯১৭ সালের মার্চ ও নভেম্বর বিপ্লব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। মার্চের বিপ্লবে ‘সমগ্র’ কৃষক সমাজকে এবং নভেম্বর বিপ্লবে গ্রামের গরিব তথা আধা সর্বহারাকে শ্রমিকশ্রেণির বিশ্বস্ত মিত্র হিসাবে এক শক্তিশালী বিপ্লবী মোর্চায় একত্রিত করে শত্রুর সমস্ত কৌশলকে পর্যুদস্ত করে চূড়ান্ত জয়কে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল।
।। সাত ।।
১৮৭১ সালের প্যারি কমিউন ব্যর্থ হলেও উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতনই চিরকাল বিরাজ করবে। ৮ মার্চ থেকে ২৮ মে’র দিনগুলির রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রামে বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির কাছে রেখে গেছে অমূল্য রত্নভাণ্ডার। ফরাসি দেশের শ্রমিকশ্রেণি পরাজয়ের মধ্য দিয়েও সমৃদ্ধ করে গেছেন বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণিকে।
প্যারি কমিউনই প্রথম ক্ষমতা দখলের বাস্তবরূপ। এবং সেই ক্ষমতা দখল ছিল রক্তাক্ত পথ বেয়ে। হিংসা এবং অহিংসার তত্ত্বগত প্রশ্নকেও প্যারি কমিউন জীবন্ত, সমৃদ্ধ করে গেল। আতঙ্কিত বুর্জোয়াশ্রেণি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না। প্রতিবিপ্লবী হিংসা তারাই শুরু করে। অনিবার্যভাবেই সর্বহারাশ্রেণিকে সেই প্রতিবিপ্লবী হিংসাকে পর্যুদস্ত করতে হবে। এই হচ্ছে ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম। সঠিকভাবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে সংগঠিত করার প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ, একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘শিল্পকর্মের’ শামিল।
বুর্জোয়া শ্রেণিকে পরাস্ত করেই সর্বহারা শ্রেণিকে শাসকশ্রেণির পদে উন্নীত হতে হবে। সেইটি হলো সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্বের রূপ। মার্কসবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য বিষয়। মার্কসের ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ গ্রন্থের ভূমিকায় এঙ্গেলস লিখলেন - ‘‘সম্প্রতি সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক অর্বাচীনেরা ‘শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব’ কথাটিতে আর একবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। বেশ ভালো কথা ভদ্রমহোদয়গণ, এই একনায়কত্ব কেমন তা কি আপনারা জানতে চান? প্যারি কমিউনের দিকে দেখুন - ওটাই ছিল শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।’’
কিন্তু সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হবে কী করে? শুধু হাত বদল হলেই হবে? পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখে না তাকে ধ্বংস করে? প্যারি কমিউনের পরাজয়ের লক্ষণগুলি দেখতে দেখতেই মার্কস লিখেছিলেন তাঁর বন্ধু কুগেলমানকে, ‘‘আমার অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে তুমি দেখতে পাবে যে, ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী প্রচেষ্টা কী হবে তা আমি সেখানে বলেছি - পূর্বের ন্যায় আমলাতান্ত্রিক সামরিক যন্ত্রকে হস্তান্তরিত করার চেষ্টা আর হবে না, চেষ্টা হবে সে যন্ত্রকে ধ্বংস করার।’’
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চরিত্র, ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন ও অভ্যুত্থান, পুরনো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা, শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব ও শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বিষয়ক মার্কসীয় সিদ্ধান্তগুলিকে লেনিন রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের ধারায় বিপুলভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ করে তুললেন। ১৯১৭ সালের এপ্রিলের শান্তিপূর্ণ সম্ভাবনা কেটে গিয়ে যখন জুলাই মাসে প্রতিক্রিয়ার আক্রমণ তুঙ্গে উঠেছে লেনিন সেই পরিস্থিতিতেই রচনা করেন তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’। এই গ্রন্থ ষষ্ঠ কংগ্রেসের আগে রাশিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে শ্রমিকশ্রেণির তত্ত্বগত ও কৌশলগত প্রশ্নগুলির সমাধান করল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শ্রেণি শোষণের যন্ত্র হিসাবেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে এটি হলো বুর্জোয়া শ্রেণিরই শোষণের যন্ত্র, রাষ্ট্র শ্রেণির ঊর্ধ্বে কোনো শক্তি নয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি - সশস্ত্রবাহিনী, জেলখানা ইত্যাদি সহ বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন ও শোষণকে রক্ষা করছে। এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করা ছাড়া শ্রমিকশ্রেণি তার ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বকে সুনিশ্চিত করতে পারে না। প্যারি কমিউন পুরনো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সম্পূর্ণ নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ৪৬ বছর পর মহান নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্যারি কমিউনের আদর্শই পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সক্ষম হলো নিখুঁতভাবে চরম নৈপুণ্যের সাথে সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে সংগঠিত করতে, পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে ইতিহাসে প্রথম শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সর্বহারার একনায়কত্বকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে। নভেম্বর বিপ্লবে চূড়ান্ত অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল দুনিয়া-কাঁপানো মাত্র দশ দিনের মধ্যে, কিন্তু সর্বহারার একনায়কত্বকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে ও পুরনো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি গঠিত হয়েছিল বলেই সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপ ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রতিবিপ্লবীদের সমস্ত ষড়যন্ত্র নির্মমভাবে গুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ২৪ বছর পরেও যখন হিটলারের নাৎসিবাহিনী প্রায় সমস্ত ইয়োরোপকে পদানত করে প্রতিটি দেশে পঞ্চমবাহিনী তৈরি করেছে এবং তাদের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলেছে, কেবল সোভিয়েতেই কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে শ্রমিকরাষ্ট্র সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলায় নিজেকে রক্ষা করেছে, অসীম বীরত্বের সঙ্গে নাৎসিবাহিনীকে ধ্বংস করে মানব সভ্যতাকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করেছে।
।। আট ।।
সর্বহারা শ্রেণি কর্তৃক যে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, তা মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের অবসান ঘটাবে, প্রতিষ্ঠিত করবে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। উন্নত পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের চরিত্র সামাজিক, কিন্তু উৎপাদনের উপকরণগুলি রয়েছে ব্যক্তিমালিকানায়। সেখানে উৎপাদনের চরিত্র শোষণভিত্তিক আর এর লক্ষ্য হলো মুনাফা, অধিক মুনাফা। শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রের কর্তব্য সম্বন্ধে এঙ্গেলস লিখলেন ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’-এ - ‘‘সেখানে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সমাজের নামে উৎপাদনের উপকরণগুলির অধিকার নিজের হাতে তুলে নিতে হবে - এটাই হবে রাষ্ট্রের সর্বশেষ স্বাধীন কাজ।’’ তিনি এর পরবর্তী পর্যায়ে এক উন্নত কমিউনিস্ট সমাজে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা ঘোষণা করেছেন। সেটি অন্য বিষয়।
মূল কথা হলো শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রকে পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে যেতে হলে উৎপাদনের উপকরণগুলির ওপর ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মার্কস-এঙ্গেলসকে তাঁদের জীবনব্যাপী সমাজতন্ত্রের সমস্ত মেকি ও কাল্পনিক ধারণাগুলির বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এই মৌলিক অর্থনৈতিক সূত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধারাবাহিক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অপরদিকে বুর্জোয়াশ্রেণি আতঙ্কিত হয়েছে সম্পত্তির ‘পবিত্র অধিকারে’র বিরুদ্ধে এই বৈপ্লবিক মতবাদের ঘোষণায়।
নভেম্বর বিপ্লবই প্রথম ভেঙে দিয়েছে বুর্জোয়াশ্রেণির সম্পত্তির পবিত্র অধিকারের ভিতকে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রথম সফল রূপায়ণ ঘটেছে সেইখানেই। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে, পরের দিন ৮ নভেম্বর জারি করা হয়েছে ভূমি সংক্রান্ত ডিক্রি। জমিদারতন্ত্রের ৪০ কোটি একর জমি বিনা ক্ষতিপূরণে অধিকার করা হয়েছে, আর বিনামূল্যে সেই জমি দেওয়া হয়েছে কৃষককে। ৭০ কোটি স্বর্ণ রুবল খাজনা হিসাবে যা প্রাপ্য ছিল, তা মাপ হয়েছে। বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, রেলপথ, বাণিজ্যিক নৌব্যবস্থা, তেল ও অন্যান্য খনি, মূল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয়করণ করা হয়েছে। সমস্ত বিদেশি পুঁজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বন্ধ হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যও জাতীয়করণ হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এলাকায় সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মালিকানার সমস্ত অবশেষ ধীরে ধীরে মুছে দেওয়া হয়েছে। মহান নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে সোভিয়েত রাশিয়ার জয়যাত্রা অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে এগিয়ে গেছে। বর্তমান দুনিয়ায় রাশিয়া সহ সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অর্থনৈতিক সাফল্য পুঁজিবাদী দুনিয়ার ঘনায়মান সংকটের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান শক্তি ও নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রমাণ করছে।
।। নয় ।।
‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র সর্বশেষ মহান আহ্বান হচ্ছে - ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। বিশ্বপুঁজিবাদের ধ্বংসের জন্য, মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের অবসানের জন্য, শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির জন্য, সমাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের জন্য - সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার মহান রণধ্বনি।
সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার এই আদর্শকে বহু অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। প্যারি কমিউনের সংগ্রামী দিনগুলিতে একদিকে যেমন ‘ইন্টারন্যাশনাল’ সঙ্গীতের আবির্ভাব ঘটেছে, তেমনি বিশ্বের অন্যান্য দেশের শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে সেদিন সম্ভব হয়নি যথাযথভাবে প্যারি কমিউনের সমর্থনে এগিয়ে আসা। প্যারি কমিউনের পরাজয়ের এ ছিল অন্যতম কারণ।
মার্কস-এঙ্গেলসের উদ্যোগে যে প্রথম আন্তর্জাতিক গড়ে উঠেছিল ১৮৬৪ সালে, তার অবলুপ্তি ঘটে ১৮৭৬ সালে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৮৯ সালে। এই আন্তর্জাতিকে বার্নস্টাইন-কাউৎস্কির দল মার্কসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল সংশোধনবাদকে। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাও সেখানে আক্রান্ত হয়েছে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করলেও (১৯১২), প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘ যখন সমস্ত ইয়োরোপকে গ্রাস করেছে, তখন সেই দুর্যোগের দিনে বুর্জোয়াদের জাতীয়তাবাদের মেকি স্লোগানের কাছে, লুটের কাছে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কাছে সর্বহারার দলগুলি অনেকেই আত্মসমর্পণ করেছিল।
লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বলশেভিকরা দাঁড়িয়েছিলেন এই স্রোতের বিরুদ্ধে। কার্ল লিবনেখট, রোজা লুকসেমবার্গ, ক্লারা জেটকিনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রমিকনেতারাও কয়েকজন ছিলেন লেনিনের সঙ্গে। সুবিধাবাদের পাঁকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতন ঘটলেও, সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার পতাকাকে তাঁরা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি শ্রমিকশ্রেণিকে বুর্জোয়াদের কামানের খোরাক হতে দেননি। ‘পিতৃভূমি রক্ষার’ মেকি স্লোগানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিপ্লবী গৃহযুদ্ধে পরিণত করেছিলেন। ১৯১৪-১৮ প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকাতেই রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণি, বিপ্লবী কৃষকসমাজ এবং সৈনিকরা রুটি জমি এবং শান্তির স্লোগানকে বিপ্লবের স্লোগানে রূপান্তরিত করে সাম্রাজ্যবাদী শাসকচক্রকেই উচ্ছেদ করে মহান নভেম্বর বিপ্লবকে জয়যুক্ত করেছেন। বুর্জোয়াদের হিংস্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতকদের’ বিরুদ্ধে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার মহান আদর্শের মর্যাদাকেই রক্ষা করেছেন। সেদিন তাই এই নবগঠিত শ্রমিক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের নোংরা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও মূর্ত হয়ে উঠেছিল সর্বহারার আন্তর্জাতিকতা। ‘রাশিয়া থেকে হাত উঠাও’ রণধ্বনিতে হুঁশিয়ারি জানিয়েছে বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণি। সাম্রাজ্যবাদীদের সমস্ত অভিযানকে ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছিল তারা, রক্ষা করতে পেরেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে, বিশ্ব বিপ্লবের প্রথম শক্ত ব্রিগেডকে। আর মহান নভেম্বর বিপ্লবের চূড়ান্ত সাফল্যের মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। সেই গৌরবময় পতাকাতলেই এগিয়ে চলেছেন বিশ্বের মেহনতি মানুষ মহান বিশ্ববিপ্লবের লক্ষ্যে।
(সমাপ্ত)