E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১১ নভেম্বর, ২০২২ / ২৪ কার্ত্তিক, ১৪২৯

সমাজতন্ত্র - সোভিয়েতের অভিজ্ঞতার আলোকে

অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়


১৮৪৮ সালে মার্কস-এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম ঘোষিত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের, তথা মার্কসবাদের তত্ত্বগত মূলনীতি ও রণকৌশলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মূল নীতিই ঘোষিত হয়েছিল কমিউনিস্ট ম্যা‍‌নিফোস্টোতে। শ্রমজীবী শ্রেণি এবং সমাজের অন্যান্য নিপীড়িত অংশের মানুষের কাছে পুঁজিবাদের একমাত্র বিকল্প হিসাবে সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট সমাজের জীবন দর্শন হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। ইতিপূর্বের ইউটোপিয়ান (কাল্পনিক) সমাজবাদের বিপরীতে ম্যানিফেস্টো সমাজের প্রকৃত অবস্থা এবং ঐতিহাসিক অগ্রগতির উপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের পথের অনুসন্ধান দেয়।

ষোড়শ শতাব্দীতে টমাস মোর তাঁর আদর্শ কাল্পনিক সমাজকে ‘ইউটোপিয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের সুন্দর কল্পনা করেছিলেন। এরপর কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের ধারণা নিয়ে একে একে এসেছিলেন ফ্রান্সের সাঁ-সিমো, চার্লস ফুরিয়ে, ব্রিটেনের রবার্ট ওয়েন প্রমুখ। এই কাল্পনিক সমাজবাদীরা পরিচালিত হতেন ইতিহাসের পুরাতন ভাববাদী ধারণার দ্বারা। প্রচলিত পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির সমা‍‌লোচনা তারা করতেন, কিন্তু তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে শ্রেণিসংগ্রামের কোনো ধারণা ছিল না; শ্রেণি বিভক্ত সমাজে অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সমাজে উৎপাদন তথা সর্ববিধ সম্পর্ক সম্বন্ধে তাদের কিছু জ্ঞান ছিল না। সমাজে শোষণ বৈষম্যের ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারতেন না। মার্কস-এঙ্গেলসই প্রথম দেখিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র কোনো বিশেষ মস্তিষ্কের আবিষ্কার নয়, তা’হলো, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া - এই দুই ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত শ্রেণির ভিতরকার সংগ্রামের আবশ্যিক ফল। ইতিহাসের বস্তুবাদী বোধ এবং উদ্বৃত্ত মূল্য দিয়ে পুঁজিবাদী উৎপাদনের রহস্য উদ্‌ঘাটন - এই দুই বিরাট আবিষ্কার মার্কস-এঙ্গেলসের অবদান। এই আবিষ্কারের ফলেই সমাজতন্ত্র হয়ে উঠল বিজ্ঞান। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো উৎপাদন শক্তির উপর, উৎপাদনের উপায়ের উপর এবং উৎপাদিত দ্রব্যের উপর সামাজিক মালিকানা স্থাপন।

১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসি বিদ্রোহের সময়ে ম্যানিফেস্টো রচনা শুরু হয়। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউন গড়ে ওঠে। শ্রমিকশ্রেণির এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যেকার সময়কালে মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের তত্ত্বকে আরও যাচাই করেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বকে সম্পূর্ণ করেন। এই পর্বে মার্কস-এঙ্গেলসকে সংগ্রাম করতে হয়েছে ব্ল্যাঙ্কিবাদ, প্রুঁধোবাদের বিরুদ্ধে, বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। শ্রমজীবী শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন না, অথচ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে উদ্ভব ঘটে এমন নানা ধরনের সমাজবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই মার্কস-এঙ্গেলস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইউ‍‌টোপিয়া এবং পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মার্কস-এঙ্গেলস প্রমাণ করেছিলেন সমাজতন্ত্র হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশের আবশ্যিক পরিবৃত্তি এবং সমাজের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার জায়গায় সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। ধনতান্ত্রিক সমাজ এবং কমিউনিস্ট সমাজের মাঝখানে রয়েছে প্রথমটির দ্বিতীয়টিতে বৈপ্লবিক রূপান্তরের একটি পরিবৃত্তি কাল। এই পরিবৃত্তি কাল হচ্ছে সমাজতন্ত্র গড়ার যুগ‍‌। সাধারণভাবে আমরা যাকে সমাজতন্ত্র বলে থাকি তাকেই মার্কস অভিহিত করেছিলেন কমিউনিজম বা সাম্যবাদের নিম্ন পর্যায় বলে।

মার্কস-এঙ্গেলস শিখিয়ে গেছেন সমাজতন্ত্র হলো কমিউনিজমে উত্তরণের একটা পথ। সমাজতান্ত্রিক সমাজের যুগ হবে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক যুগ। এই সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম এবং শ্রেণিসমূহ পুঁজিবাদী সমাজের মতোই বিরাজ করতে থাকে। এই যুগে পুঁজিবাদও পুনরার্বিভাবের চেষ্টা চালাতে থাকে; তাই শ্রেণিসংগ্রামও থাকে। পুঁজিবাদের ফিরে আসার চেষ্টাকে প্রতিহত এবং পরাস্ত করেই সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। এই কারণেই মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতন্ত্র গড়ার এই যুগে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনের কথা বলে গেছেন।

*  *  *  *

একটি সমাজব্যবস্থা কী রকম থাকবে বা কী রকম হবে তা নির্ধারিত হয় বিকাশের সেই স্তরে জীবনধারণের জন্য উপকরণ সংগ্রহের যে উপায় সেটি-ই। অর্থাৎ, খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, জ্বালানি এবং উৎপাদনের হাতিয়ার সহ নানাবিধ বৈষয়িক দ্রব্যাদি উৎপাদনের যে পদ্ধতি - সেই শক্তিই হলো নির্ধারক। কিন্তু আমরা জানি উৎপাদন পদ্ধতির দু’টি দিক আছে। উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদনের কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে মানুষকে পারস্পরিক কোনো না কোনো উৎপাদন সম্পর্কে আবদ্ধ হতেই হয়। এই কারণে উৎপাদনের চরিত্র সব সময়েই সামাজিক ধরনের হয়ে থাকে। সমাজব্যবস্থার চরিত্র কেমন হবে তা নির্ভর করে উৎপাদন সম্পর্কের উপর। উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে যদি শোষণ নিহিত থাকে - দাস ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা - তা’হবে শোষণের সমাজব্যবস্থা। অপরদিকে, উৎপাদন সম্পর্ক শোষণ রহিত হলে তা’হবে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। যেমন - আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বা আগামীদিনের উন্নততর সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। একটি সমাজের উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক - এই সব‍ মিলিয়ে যে উৎপাদন পদ্ধতি - সেটিই হচ্ছে সেই সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌল পরিবর্তন ছাড়া একটি সমাজব্যবস্থা অন্য সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তিত হতে পারে না। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌল পরিবর্তন ঘটিয়ে, অর্থাৎ সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।

কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের এই শিক্ষাকেই হাতিয়ার করে বিশ্বের সর্বপ্রথম শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে মহামতি লেনিনের পরিচালনায় ১৯১৭ সালে রুশ দেশে সাধিত হয়েছিল সর্বহারা বিপ্লব, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ। কায়েম হয়েছিল উৎপাদন সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম, বাসস্থান, কাজের উপর সকলের অধিকার। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায়, পরবর্তী সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে অবসান হয়েছিল মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ, অভ্যুদয় ঘটেছিল নতুন সভ্যতা। যার আলোক বিচ্ছুরণ আলোকিত করেছিল গোটা বিশ্বের নিপীড়িত জনগণকে।

ক্ষমতা দখলের পরদিনই, ৮ নভেম্বর সোভিয়েতের দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন কয়েকটি ডিক্রি ঘোষণা করেন। শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানানো ছাড়াও সেই ডিক্রির বলে সমস্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বিনা ক্ষতিপূরণে ভূস্বামীদের মালিকানার অবলুপ্তি ঘোষিত হয়। স্থাপিত হয় রাষ্ট্রের মালিকানা। জারের পরিবারের, চার্চ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জমি রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে নেওয়া হয়। সমস্ত জমির অধিকার গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টিত হয়। জমি ছাড়াও সমাজতন্ত্রের প্রথম ধাপেই কয়লা, অন্যান্য খনিজ সম্পদ, খনিজ তেল, বনসম্পদ, জলসম্পদ, সমস্ত কিছুর উপর রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মালিকানা স্থাপিত হয়। সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে গরিব কৃষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে কুলাকদের একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করা হয়‌।

বিপ্লবের পরে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কাজ শুরু সহজ হয়নি। বহু বাধা-বিঘ্ন, ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করেই নতুন বিপ্লবী সরকারকে এগোতে হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং গৃহযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের উপর লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকারকে কাজ শুরু করতে হয়েছিল। যুদ্ধের ফলে দেশের কৃষি, শিল্প বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত বহির্শক্তির আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করায় ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। ঐতিহাসিকেরা ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যেকার সময়কে যুদ্ধ কমিউনিজমের (War Communism) পর্যায় বলেছেন। স্বাভাবিক কারণেই লেনিনকে কিছু নমনীয় কৌশল সাময়িকভাবে গ্রহণ করতে হয়েছিল। তিনি নতুন আর্থিক নীতি (NEP) ঘোষণা করেন। এই নতুন আর্থিক নীতি রূপায়ণ করে বিপ্লবী সরকার সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলে। এই নতুন অর্থনৈতিক নীতি বা নেপে’র প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিলঃ (এক) ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে ব্যক্তিপুঁজি ব্যবহার, (দুই) প্রশাসনের অত্যধিক কেন্দ্রিকতা বর্জন করে অর্থনৈতিক কাজকর্মে স্বাধীনতাদান এবং (তিন) এসব সত্ত্বেও সমস্ত অর্থনৈতিক উদ্যোগের উপর সর্বহারার একনায়কত্বের রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে লেনিন নেপ গ্রহণ করছিলেন তা সর্বতোভাবে সফল হয়েছিল। সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য শ্রমিক শ্রেণি এবং গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে দৃঢ় মৈত্রী গড়ে ওঠায় নেপ’-এর ফল হিসাবে একটি মজবুত অর্থনীতি সুনিশ্চিত হয় এবং যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি দ্রুততার সাথে দূর করা সম্ভব হয়। সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার পথ সুগম হয়। নেপ-এর মাধ্যমে কেবলমাত্র শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষকের মজবুত অর্থনৈতিক মৈত্রী গড়ে তোলা নয়, সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য অর্থ‍‌নৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতার ক্ষতিকর ঐতিহ্য থেকেও এতদিনের নিপীড়িত জনগণকে অগ্রসর করে নিয়ে আসার উপরও জোর দেওয়া হয়। নতুন অর্থনৈতিক নীতি (নেপ)’র গুরুত্ব বোঝাতে লেনিন বলেছিলেন, নেপ-এর অর্থ হলো পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে বাঁচা-মরার প্রশ্ন। কে জিতবে সেটাই ছিল প্রশ্ন, পুঁজিবাদকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সমস্ত ষড়যন্ত্র এবং অপচেষ্টা নেপ-এর সাফল্যের ফলে চূর্ণ হয়েছিল। পুঁজিবাদ ফিরিয়ে আনার চক্রান্তকে ব্যর্থ করার জন্য শহর ও গ্রামের মধ্যে যত বেশি সম্ভব পণ্য বিনিময়ের উন্নতি ঘটিয়ে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রী, শিল্প - কৃষির মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝাপড়া সুনিশ্চিত করা সেই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল। বিভিন্ন ক্ষেত্রের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে সমবায়ভিত্তিক বাণিজ্যের সমন্বয় গড়ে তোলা সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। ১৯২২ সাল পর্যন্ত এইভাবে চলার পর লেনিন ঘোষণা করেন - এরপর নেপে’র রাশিয়া হয়ে উঠল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া। এই সময়েই সমস্ত বহির্দেশীয় সামরিক হস্তক্ষেপকে পরাস্ত করে গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

লেনিনের নির্দেশনাতেই সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের মজবুত ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বের বিস্ময় শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন শিল্পোন্নত দেশের মহিমা অর্জন করেছিল, হয়ে উঠেছিল শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক সমাজ। কমিউনিস্ট সমাজের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক সমাজের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে লেনিন বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে বোঝায় সেই সমাজ যেখানে পুঁজিপতিদের সাহায্য ছাড়াই কার্যনির্বাহ হয়, শ্রম যেখানে সামাজিক শ্রম হয়ে উঠেছে, আর সেই সঙ্গে সংগঠিত অগ্রগামী বাহিনী, অর্থাৎ শ্রমজীবীদের সর্বাপেক্ষা অগ্রণী অংশ যেখানে কড়াকড়িভাবে সমস্ত কিছুর হিসাব রাখে, নিয়ন্ত্রণ করে, তদারক করে। এছাড়াও, সমাজতান্ত্রিক সমাজ মানে এটাও বোঝায় যে, শ্রমের মান এবং শ্রমের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। প্রকৃত কমিউনিস্ট সমাজে এ সবের প্রয়োজন থাকবে না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য থাকবে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা।

লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার কাজ সফল করেছিলেন স্তালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত। ১৯২৮ সালে শুরু হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। অভূতপূর্ব সাফল্য ঘটতে থাকে। নির্দিষ্ট পাঁচ বছরের আগেই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য সাধন হয়। সেই সাফল্য বজায় থাকে পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলিতে। কৃষিপ্রধান দেশ থেকে রাশিয়া শিল্পপ্রধান দেশ হয়ে ওঠে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষেই দেশের মোট উৎপাদনে শিল্প উৎপাদনের ভাগ দাঁড়ায় সত্তর শতাংশ। যৌথ কৃষিব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য ও অভাব দূর করে। লক্ষ লক্ষ গরিব কৃষকের জীবনমান উন্নত ও নিশ্চিত হয়। শিল্পে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেকারত্ব দূর করে। আর্থিক বৈষম্য থাকলেও মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান হয়। এক দশকের মধ্যেই অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন এবং শিল্পোৎপাদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি প্রভৃতি উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির প্রায় সমকক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েত রাশিয়া। বিজ্ঞান, গবেষণা, সামরিক শক্তি প্রভৃতিতেও অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ত নাৎসিবাহিনীকে পর্যুদস্ত এবং পরাস্ত করে সোভিয়েত রাশিয়া তার অর্জিত শক্তির প্রমাণ রাখে।

*  *  *  *

বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের আগে থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র নির্মাণে এবং মতাদর্শ ক্ষেত্রে নানা বিচ্যুতি ঘটতে দেখা গেছে। শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কত্ব, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল নেতৃত্বের একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্ব। পার্টি ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা রক্ষিত হয়নি। পার্টি ও সোভিয়েতকে এক করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২২তম কংগ্রেসে কুড়ি বছরের মধ্যে দেশে কমিউনিস্ট সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছিল। যা ছিল অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক। মতাদর্শগত বিচ্যুতির ফলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একাধিক বিচ্যুতি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। আমাদের পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় সম্পর্কে বিস্তৃত পর্যালোচনা করেছে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশে মার্কসবাদী মতাদর্শ এবং লেনিনের শিক্ষা অনুশীলন এবং প্রয়োগের ঘোষণা করেছে। সিপিআই(এম)’র চতুর্দশ এবং বিংশতিতম কংগ্রেসে গৃহীত মতাদর্শগত দলিলে সোভিয়েতের বিপর্যয়ের কারণ বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। পার্টির কর্মসূচিতেও ২০০০ সালে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর তিন দশক অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়কালে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাদি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি তাদের নিজস্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার কাজে নিমগ্ন আছে এবং নিজ নিজ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের পথ থেকে তারা সরে আসেনি। অপরদিকে এই তিন দশকে পুঁজিবাদ সংকট থেকে সংকটতর হয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক আগ্রাসনের নানাবিধ কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করেও পুঁজিবাদ সংকট থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। পুঁজিবাদ তার অন্তর্নিহিত মৌলিক দ্বন্দ্ব নিরসনে অক্ষম বারে বারে তা এই সময়েও প্রমাণিত হয়েছে। সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই গভীর সংকটগ্রস্ত। শোষণের মাত্রা নানা উপায়ে তীব্র করে, একচেটিয়া পুঁজি ও লগ্নি পুঁজির অবাধ শোষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েও তারা সংকটমুক্ত হতে পারছে না। পর্যায়ক্রমিক সংকট বারবার সমগ্র বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে। পূর্বের সংকটকে ছাড়িয়ে প্রতিবারই তা দীর্ঘতর হচ্ছে। সঙ্কটের সমস্ত বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপিয়েও তারা নিস্তার পাচ্ছে না। মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছে, সমাজতন্ত্রই হবে সেই পথ তাতে সন্দেহ নেই। সমাজতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প - পুঁজিবাদী সংকট এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের পথ ও ধরন যে বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের মতো হবে না সেটাও সত্য। সমাজতন্ত্রের ধারণাকে সমকালীন সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণও করে তুলতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে পরিস্থিতিতে, যে সময়ে সমাজতন্ত্র নির্মাণ হয়েছিল সেই পরিস্থিতি ও সেই সময় এখন নেই। পরিস্থিতি ও সময় উপযোগী সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে। একবিংশ শতকে সমাজতন্ত্র নির্মাণ হবে সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতিতে, নতুন পরিকল্পনায়। সোভিয়েতের অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করেই আমাদের ভবিষ্যতে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব এবং কাজের পদ্ধতিতে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের পার্টি বলেছে। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা, বহুদলীয় ব্যবস্থা রাখা, রাষ্ট্র ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সঠিক সম্পর্ক রাখা ইত্যাদি বিষয়গুলিকে সুনিশ্চিত করা ভবিষ্যৎ সমাজতন্ত্রের আবশ্যিক বিষয় হতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা এই শিক্ষা দিয়েছে।