৬০ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১১ নভেম্বর, ২০২২ / ২৪ কার্ত্তিক, ১৪২৯
ভারতে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব এবং আমাদের কাজ
মহম্মদ সেলিম
মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহান নভেম্বর বিপ্লবের সংযোজন এমন এক অনিবার্য আলোক সরণির নির্মাণ, যার প্রভাব ও তাৎপর্য বহুধাবিস্তৃত। এর আগে অনেক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হলেও বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষ এই প্রথম দেখলেন বিপ্লবের ঘটনাপঞ্জিতে সর্বহারাদের নির্ণায়ক ভূমিকা। দুনিয়া জুড়ে মানুষ উপলব্ধি করলেন, যে শ্রেণির হারাবার কিছু নেই তাঁরাই হলেন রাষ্ট্রের নায়ক। রাজনৈতিক মতবাদ চর্চার সূচিতে এই বিপ্লব শুধু ইয়োরোপে নয়, তোলপাড় ফেলে দেয় সারা দুনিয়ায়। নভেম্বর বিপ্লবের আগে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের উপনিবেশগুলির জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ইয়োরোপ ও আমেরিকার পুঁজিবাদী দেশগুলির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাবেই প্রভাবিত হতো। বিপ্লবের পর ইয়োরোপ ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সর্বত্র শুরু হলো বি-উপনিবেশীকরণ। সোভিয়েত থেকে শ্রমজীবীরা পেলেন আগামী পৃথিবীর ধারণা, যেখানে শহরের কলকারখানার সর্বহারাদের সঙ্গে গ্রামের দরিদ্র কৃষক, খেতমজুর, জমিহীন সর্বহারারাও হাত মিলিয়ে তৈরি করল শ্রেণিহীন একটা সমাজ। মানুষের এই অভূতপূর্ব উপলব্ধিকে লক্ষ করেই মাও জে দং অভ্যুত্থানের সময় বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্তে অরোরা জাহাজ থেকে নাবিকদের জারের শ্বেতপ্রাসাদে কামানের গোলা দাগার ঘটনার অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন, ‘ওই কামানের গোলার আওয়াজ আমাদের ঘুম ভাঙালো’।
প্রথম রুশ বিপ্লব (১৯০৫)’র সময় থেকেই ভারতে প্রভাব বিস্তার করেছিল বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড। পরের দশকগুলোয় সশস্ত্র বিপ্লবের ধারা ক্ষীণ হয়ে এলেও রেল ধর্মঘট সহ একাধিক ধর্মঘট এই পর্বে ঘটে। রাশিয়ায় জারের পতন এবং বিপ্লবের অগ্রগতি ভারতের উপনিবেশবিরোধী এবং সামন্ততন্ত্রবিরোধী মুক্তি সংগ্রাম তীব্রতর করার প্রেরণা জুগিয়ে ছিল। ওই সময়েই পরাধীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে ব্রিটেনে পাঠানো সচিব পর্যায়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, ‘রাশিয়ায় বিপ্লব ও তার সূচনা ভারতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে... এটি ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে।’
নভেম্বর বিপ্লবের পর বিশ্ব বিপ্লবের যুগ শুরু হওয়ায় দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন কার্যত বিশ্ব প্রলেতারিয় বিপ্লবের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। পরে ভারত, চীন, ভিয়েতনাম সহ পরাধীন বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা অর্জন এই প্রভাবকে ইতিহাসবদ্ধ করে। ইয়োরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সেনাদের দেশে ফেরানোর দায় নেয়নি। অসহায় অবস্থায় পল্টন থেকে নিজেদের দেশে ফিরতে বহু কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। কাজী নজরুল ইসলামের মতো যুদ্ধ ফেরত সেনানীদের অনেকেই এই অব্যবস্থার শিকার হয়েছিলেন। তাঁরা দেশে ফিরেছিলেন বহু অমানবিক অভিজ্ঞতার শরিক হয়ে। ভারতের প্রদেশগুলির প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরা (বিশেষত পাঞ্জাব এবং মূলত উত্তর ভারতঘেঁষা অন্যান্য রাজ্যগুলিতে) যুদ্ধ ফেরত এই সেনাদের থেকে সুদূর রাশিয়ায় বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের ঘটনাবলী জানতে পারেন। শোষণ মুক্ত সোভিয়েত গড়ে ওঠার বিবরণ সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তীব্রতর করে।
১৮৫০ থেকে ১৯১৪ সাল - ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা পর্ব। উপনিবেশ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী একনায়কত্ব সরাসরি ঝুঁকেছিল অত্যধিক মুনাফার দিকে। অমানবিক শোষণ এবং মনুষ্যেতর জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে মজুরি বৃদ্ধি সহ অন্যান্য দাবিতে ওই সময়ের বিভিন্ন ধরনের শিল্পে ধর্মঘট থেকে সাধারণ ধর্মঘট সংগঠিত করার মতো ঘটনাগুলি রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষের ইঙ্গিত। শ্রমিক শ্রেণির এই সংগ্রামগুলিতে বস্তুগতভাবে ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। তাই এই ধর্মঘটগুলি শ্রমিক ছাড়াও ভারতীয় জনগণের অন্যান্য স্তর থেকে সমর্থন পাচ্ছিল। ১৯০৮ সালেই লেনিনের চোখে এই সংগ্রামের অসীম গুরুত্ব ধরা পড়েছিল। এই ধর্মঘটকে বিশ্লেষণ করে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভারতেও শ্রমিকশ্রেণি ইতিমধ্যেই সচেতন রাজনৈতিক সংগ্রামে উন্নীত হয়েছে এবং এর পরিণামে ভারতে রুশ ধরনের ব্রিটিশ শাসনের দিন ঘনিয়ে এসেছে’। কিন্তু ওই পর্বে শ্রমিক শ্রেণির কোনো নিজস্ব রাজনৈতিক পার্টি গড়ে ওঠেনি তাই তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচালনা ছিল না। যদিও শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের জো-হুজুরি মনোভাব এই গণবিক্ষোভকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
নভেম্বর বিপ্লব পর্বে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের ওপর শ্রমিক আন্দোলনের চাপের খবর ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রে ছাপা হতেই বিচলিত শাসককুলের পক্ষ থেকে তারবার্তা আসে। তৎকালীন ভাইসরয়কে লন্ডনের থেকে বিচলিত সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া বলেন, ভারতে যে উত্তাল শ্রমিক অশান্তি চলছে তার প্রকৃত পরিস্থিতি কী সে সম্পর্কে একটি বিস্তৃত রিপোর্ট পাঠাতে। ভাইসরয় তার উত্তরে জানান ‘...এক ধরনের ধর্মঘটের মহামারী দেখা যাচ্ছে যেখানে অংশত বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক আলোড়ন এবং অংশত ইংল্যান্ড ও ইয়োরোপের ঘন ঘন শ্রমিক অশান্তির রিপোর্ট এই ধর্মঘটের প্রেরণা জুগিয়েছে। এখানকার রাজনৈতিক প্রচারকরা অবশ্য ধর্মঘটের জন্য কিছুটা দায়ী ...’।
উপরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে ইঙ্গিত পরিষ্কার যে সরকারের রিপোর্টে সেসময়ের শ্রমিক আন্দোলনের তাৎপর্য ছোটো করে দেখানোর চেষ্টা হলেও প্রকৃত সত্যকে রিপোর্ট চেপে রাখতে পারেনি। শ্রমিক আন্দোলনের প্রেরণা সৃষ্টিকারী বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক আলোড়নের ব্যাখাকে অস্পষ্ট রাখলেও বুঝতে ভুল হয় না যে, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং সেই বিপ্লব-উত্তর বিশ্বব্যাপী শ্রমিক জাগরণের বাস্তবতাকেই এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হচ্ছে, যার ভারতের মাটিতে তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ ধূর্ত ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি এড়ায়নি। যদিও পরিস্থিতির আগাম প্রতিষেধক হিসেবে ১৯১৭ সালেই নিপীড়নের উদ্দেশ্যে তৈরি রাওলাট আইনে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রকে যুক্ত করা হয়। এই সময়ের রুটিন গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি তৈরি হয় বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন গোয়েন্দা বিভাগ যারা দেশের মধ্যে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট এবং তার সঙ্গে যুক্তদেরও চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার-নিপীড়নের কাজ শুরু করে।
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯১৫ থেকে ১৯৪৭ সাল সময় পর্ব সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ও সংগ্রামের যুগ হিসেবে চিহ্নিত। স্বাভাবিকভাবেই এই পর্বে ফ্যাক্টরি আইনে নথিবদ্ধ কারখানা এবং শিল্প শ্রমিকদের সংখ্যায়ও বৃদ্ধি ঘটে, বাড়তে থাকে ধর্মঘটের সংখ্যাও। এই সময় গঠিত হলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (১৯২০)।
নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য এবং তার বিবরণ এদেশে গোপনে আসা পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি বিপ্লবের পক্ষে দেশীয় সংবাদপত্রেও কমবেশি লেখা-প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে। ব্রিটিশ ও তার সহায়ক সাময়িকীগুলিতে বিপ্লবের চূড়ান্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও মূলত দেশের উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত অংশকে ছাপিয়ে মেহনতি-শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ওইসব লেখালেখির প্রভাবেও শ্রমিকশ্রেণির পার্টি গঠনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়।
রুশ বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কাকাবাবু মুজফ্ফর আহ্মদ। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন একটি সাহিত্য সমিতির সব সময়ের কর্মী। দেশে ১৯১৭’র বিপ্লব-পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের নিরিখে ১৯২০ সাল নাগাদ তিনি স্থির করেছিলেন রাজনীতি তার জীবনের পেশা হবে। এ সময়ই কংগ্রেস নেতা এ কে ফজলুল হক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে নবযুগ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব যুগ্মভাবে দেন কাকাবাবু এবং যুদ্ধ ফেরত নজরুল ইসলামকে। তার আগে থেকেই চিঠিপত্রের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কাকাবাবুর সখ্য। সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় শ্রমিক কৃষকের খবর বেশি ছাপা হতো। কাকাবাবুর কথায়, ‘তাতে বাধা দিতেন না ফজলুল হক সাহেব, বরঞ্চ খুশি হতেন’। অর্থাৎ নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল ফজলুল হকের মতো ব্যক্তিত্বের ওপর। বাংলার সাধারণ মানুষের ওপর রুশ বিপ্লবের প্রভাব প্রসঙ্গে ওই সময়েই কাকাবাবু লিখেছেন, ‘কাগজখানা বার করার মুখে আমার একজন বন্ধু (তিনি রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না) আমায় বলেছিলেন যে, “বাঙলা কাগজগুলি বড় বেশি ভাবপ্রবণ হয়। আপনারা সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে বিশেষ করে মজুর ও কৃষকদের সম্বন্ধে কিছু কিছু লিখবেন।” এটা তাঁর ওপরে বিপ্লবের প্রভাব ছাড়া আর কি হতে পারে? বন্ধুর পরামর্শে আমার মন সায় দিয়েছিল’।
আবার শ্রমিকশ্রণির পার্টি গঠন সম্পর্কে কাকাবাবু মুজফ্ফর আহ্মদ গণবাণী পত্রিকার ১৯২৬ সালের সংখ্যায় ‘নূতন দল’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘কংগ্রেসের সাবজেক্ট কমিটিতে প্রস্তাব উঠেছিল জমিদার ও ধনিকের সহিত যখন কৃষক শ্রমিকের ঝগড়া বাঁধবে তখন কংগ্রেসকে দাঁড়াতে হবে কৃষক ও শ্রমিকের পক্ষাবলম্বন করে। বর্তমানে কংগ্রেসের মাথায় মাথার মণি পণ্ডিত মতিলাল নেহরু তার উত্তরে বলেছেন - ‘কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট বা কমিউনিস্ট দল নয়’। এ কথা বলার মতলব এই হচ্ছে যে যারা পরিশ্রম করে সবকিছু উৎপাদন করে থাকে তাদের হয়ে দাঁড়াতে কংগ্রেস কিছুতেই প্রস্তুত নয়।... মোটের উপর সত্যিকারের শ্রমিক আন্দোলনের সৃষ্টি এদেশে এখনো হয়নি। একটা আমূল পরিবর্তনের ধারণা নেই বলে বর্তমানের শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের বিশেষ কিছু উপকার হচ্ছে না। তাদের হয়ে যাঁরা কাজ করতে যান তাঁরা তাঁদের একজন হতে পারেন না, এবং আজকালকার বৈপ্লবিক শ্রমিক-সঙ্ঘবাদের (Revolutionary Trade Unionism) সহিত তাদের ভালো পরিচয় নেই বলে আজও পর্যন্ত তারা শ্রমিকদের ভেতর থেকে শ্রমিক নেতা গড়ে তুলতে পারেননি। যতদিন না তা হচ্ছে ততদিন আমাদের শ্রমিক আন্দোলন কিছুতেই মুর্ত হয়ে উঠবে না।...’
উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় নয়া উপাদান - সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলন, যা শ্রমিক এবং গরিব কৃষকদের সংগ্রামী ঐক্য দেশের জমিদারদের ব্রিটিশ ভজনার রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে দিতে শুরু করল। অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক চর্চার বাতাবরণে চিন্তা চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করল নবগঠিত সোভিয়েত। সেখানে জাত-ভাষা-ধর্মের পরিচিতিসত্তাকে পাশে সরিয়ে দেশ গড়ার উদ্যোগ, কুসংস্কার বিরোধিতা এবং সার্বিক কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণ বিস্মিত করল তাঁদের। তাই ১৯২২ সালে যখন জমিদারদের পক্ষ নেওয়া পুলিশ চৌরিচৌরায় সাধারণ মানুষের ওপর তীব্র অত্যাচার নামিয়ে আনে তখন সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার আগ্রাসী চেতনা, প্রবণতা থেকেই ঘটে যায় থানায় অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। আর জমিদার বিরোধিতার জেরে ঘটা এই ঘটনায় আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন তুলে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে তা মেনে নিতে পারল না নভেম্বর বিপ্লবের নির্যাস সম্পৃক্ত নতুন ভারত।
পুনরুক্তি হলেও আজকে একথা বলা প্রয়োজন, নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব দেশের শ্রমজীবী এবং গরিব সহ বিভিন্ন অংশের মানুষের মনোজগতে পরিবর্তনের সূচনা করে। তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি থেকে জীবন যন্ত্রণার কথা, ধর্মঘট সহ রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রশ্ন আরও তীক্ষ্ণ হয়। কিন্তু সমসাময়িক সংবাদপত্র থেকে ছোটো বড়ো নানা মাপের পত্রপত্রিকায় সেসব উঠে আসেনি। এই শতাব্দীতেও সেই ট্র্যাডিশন রূঢ় বাস্তব। আজকের ভারতে পুঁজিপরিচালিত সংবাদমাধ্যম সেই পরম্পরা বজায় রেখে বেকারের কাজের দাবি, কৃষকের দাবি, শ্রমিকের দাবি থেকে ঋণগ্রস্ততা, গ্রামীণ যুবকের কথা তুলে আনে না। তার বদলে টিভি সিরিয়াল, ওটিটি, সিনেমা - বিভিন্ন ধরনের প্রযোজনায় নিয়মিত উঠে আসছে আজগুবি বিষয় থেকে অবৈধ সম্পর্কের মতো সামাজিক অবক্ষয়ের নানা দিককে আলোকিত করে প্রচার। চলছে মানুষকে স্বাভাবিক যুক্তিবোধ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা। সোভিয়েত বিপ্লব সামগ্রিকভাবে মানুষের মননে এবং চেতনায় যে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল তার ৭০ বছর পরে একটা প্রতি বিপ্লব তার উলটো মুখে নিয়ে যাবার যাবতীয় আয়োজন হাজির করল। দীর্ঘ তিন দশক ধরে ওই শক্তি গোটা পরিমণ্ডল জুড়ে ক্ষুদ্রতা, নীচতা, কলহ প্রবণতা থেকে দুর্নীতি ও দুষ্কৃতীর সহাবস্থান গা সওয়া করে তুলতে চাইছে। রাজনীতি বিমুখ, আন্দোলন নিষ্পৃহ প্রজন্ম গড়ে তুলতে সর্বত্র - প্রতিটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান তা গবেষণাগারই হোক বা ইতিহাস সংসদ, স্কুলের পাঠক্রম থেকে পাড়ার লাইব্রেরি, ক্লাব - চেষ্টা চলছেই।
তাই নভেম্বর বিপ্লবকে মনে রেখে আজকে শপথ নিতে হবে। আমাদের সামনে আজ চ্যালেঞ্জ হলো সেই সামাজিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলা, যেখানে সামাজিক এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি হকের দাবি আদায়ের মানসিক দৃঢ়তা তৈরি হবে। রাজনীতিতে অংশগ্রহণের স্পৃহা জাগানোর সচেতনতা স্বাভাবিক ভাবেই গড়ে উঠবে। কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস যা আমাদের পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে তার মূলোচ্ছেদ করতে হবে। যা কিছু ভালো, মঙ্গলকর, সুন্দর, যা কিছু আমাদের সমুখপানে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তার চিন্তা-চর্চার মধ্যে সম্পৃক্ত হতে হবে। শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ গঠনের প্রাক্ শর্ত হিসেবে শ্রেণিচেতনায় অনড় থেকে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশ সর্বহারা এবং শোষিত প্রান্তিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তাঁরাই হবেন আন্দোলনের মুখ। ঘৃণা, দ্বেষ, বিভাজনের যে বহমান রাজনীতি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কোভিড মহামারী-পরবর্তী সময়ে গোটা পৃথিবী দেখেছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির ভূমিকা। যেখানে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা প্রমাণ করে দিয়েছে স্বাস্থ্যপরিষেবা শোষণ-মুনাফার মৃগয়া ক্ষেত্র নয়। সমাজতন্ত্রের তুলনায় রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদ ক্লীব একটা আত্মঘাতী ব্যবস্থা। তাই সুন্দর সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত সুখী সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে ইনসাফ এবং হকের জন্য আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। কারণ ইতিহাস সাক্ষী, সমাজতন্ত্রের জন্য যে লড়াই তা দেশ-কাল অতিক্রম করা বৃহত্তর লড়াই। যতই বাধা আসুক, মুখ খুলতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ-এর কথায় -
বোল কে লব আজাদ হ্যায় তেরে
বোল কে জুঁবা অব তক তেরি হ্যায়।
বোল কে ইয়ে থোড়া ওয়ক্ত বহত হ্যায়
জিস্ম-জুঁবা কে মওত সে পহেলে।
বোল কে সচ জিন্দা হ্যায় অবতক
বোল জো কুছ কহনা হ্যায় কহদে।
অর্থাৎ কাছাকাছি বাংলা তরজমায় যা দাঁড়ায় - প্রতিবাদের কথা বলতে থাকো, কারণ তোমার ঠোঁট এখনও মুক্ত। তোমার জিভ এখনও তোমারই রয়েছে। যে অল্প সময়টুকু রয়েছে তা অনেকখানি, শরীর এবং জিভের মৃত্যুর আগে। সত্য বেঁচে আছে এখনও, যা কিছু বলার আছে বলে দাও।