E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯

মতাদর্শ চর্চা

মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (আট)

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য


আন্তরসত্তা (Essence) ও বাচ্য আভাস (Appearance)

● কোনো বস্তু বা ঘটনার মুখ্য, আভ্যন্তরীণ এবং আপেক্ষিকভাবে স্থিতিশীল বিষয়টিই সেই বস্তু বা ঘটনার আন্তর সত্তা। বস্তু বা ঘটনার প্রকৃতি, অন্যান্য দিকগুলি এবং তা থেকে উদ্ভূত বৈশিষ্ট্যগুলি এর দ্বারাই নির্ধারিত হয়। আন্তর সত্তার বহিঃপ্রকাশই হলো বাচ্য আভাস। উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি ও তাকে আত্মসাৎ করাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আন্তর সত্তা। মেহনতি মানুষের উপর শোষণ হলো বাচ্য আভাস। বিপাক ক্রিয়া (Metabolism) জীবের অস্তিত্বের আন্তর সত্তা। জীবজগতে এর বহিঃপ্রকাশ বহুবিধ, যেমন উত্তেজনা বৃদ্ধি, জীবদেহের বৃদ্ধি, প্রভৃতি হলো বাচ্য আভাস।

আন্তর সত্তা এবং বাচ্য আভাস পরস্পর সম্পর্কিত এবং অবিচ্ছিন্ন। উভয়েই মিলিতভাবে একটি একক হলেও এরা পরস্পরের বিপরীতও বটে। আন্তর সত্তা ও বাচ্য আভাস কখনই পরস্পরের ঠিক অনুরূপ হয় না। আন্তর সত্তা অপ্রকাশ্যে থাকে। প্রত্যক্ষভাবে একে দেখা যায় না। বস্তু বা ঘটনার ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমেই আন্তর সত্তাকে প্রকাশ করা যায়। বালবের আলো যা এই মুহূর্তে জ্বলছে, যে বৈদ্যুতিক মোটর চলছে, যে যন্ত্রটা চলছে - এগুলি হলো বাচ্য আভাস। যে রূপটা আমরা প্রত্যক্ষ করি তাই হলো বাচ্য আভাস। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ (Electricity) হলো আন্তর সত্তা।

● আন্তর সত্তা এবং বাচ্য আভাসের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক সম্বন্ধে জ্ঞান আমাদের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠতে সাহায্য করে যে, কোনো একটি বস্তু বা ঘটনা বা প্রক্রিয়া, তা যত জটিলই হোক না কেন, তাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা অর্থাৎ তাকে বোঝা এবং তার লুক্কায়িত আন্তর সত্তাকে আবিষ্কার করা সম্ভব। তবে একথাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন, কোনো এক‍‌টি বস্তু বা ঘটনার বাচ্য আভাস অনেক সময়েই তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করে। যেমন, আমরা সূর্যকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে দেখি, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো পৃথিবী সূর্যকে পরিক্রমণ করে। আমরা প্রত্যহ দেখি দিনের পর রাত হয়। দিনের জন্যই যেন রাত হয়। বাস্তব ঘটনা হলো, পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণন, তার ফলেই দিন ও রাত হয়। সেইরূপ কোনো বস্তু বা ঘটনাকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে, তাদের আন্তর সত্তা সম্পর্কে জ্ঞান বিশেষভাবে প্রয়োজন।

কার্য (Effect) কারণ (Cause) সম্পর্ক

● যে কোনো ঘটনার বা প্রক্রিয়ার কারণ বলতে বোঝায় যেটি একে ঘটাচ্ছে তাকে। যে ঘটনা বা প্রক্রিয়া ঘটছে তাকে বলে কার্য। কারণ ও কার্যের মধ্যে কালগত একটা নির্দিষ্ট পারম্পর্য রয়েছে। প্রথমে কারণ আসে তারপর আসে কার্য। কারণের সাথে কার্যের সম্পর্ক অবশ্যম্ভাবী। কারণ থাকলে কার্য অবশ্যই তার অনুগামী হবে, যদি না অন্য কিছু তাকে ব্যাহত করে। যে কোনো কার্যের পিছনে কারণকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা আবশ্যক।

● উপলক্ষ (occasion) আর কারণ এক নয়। উপলক্ষ নিজে কোনো একটি ঘটনা ঘটাতে পারে না, তবে একটি উপাদান হিসাবে আসল কারণকে ত্বরান্বিত করা তথা কার্যকরী করে তোলে। কারণের ফলে কাজ - এক্ষেত্রে সব সময়ে কিছু উপাদানের প্রয়োজন হয়। কার্য-কারণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। কার্য কারণে রূপান্তরিত হয় এবং কারণ কার্যে রূপান্তরিত হয়। যে কোনো ঘটনা প্রক্রিয়ার প্রধান এবং নির্ধারক কারণটি চিহ্নিত করতে পারলেই কার্য বা ঘটনাটিকে সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব। কারণটা চিহ্নিত করতে পারলে ঘটনা প্রক্রিয়াকে উপলব্ধির মধ্যে আনা সম্ভব। কার্য-কারণ সম্পর্ককে সঠিকভাবে জানার মাধ্যমে আমাদের সমগ্র কার্যকলাপকে নির্ভুলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হতে পারে।

● পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা প্রত্যক্ষ করি একদিকে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এবং চরম নৈরাজ্য। এগু‍‌লি হলো কার্য। কারণটা হলো উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা।

আবার, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট, যেমন বেকারি, দারিদ্র্য, অসাম্য, স্বাস্থ্যহীনতা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি। এর কারণ হলো উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এবং নৈরাজ্য।

আবশ্যিকতা (Necessity) এবং আপতিকতা (chance)

● যেহেতু সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা ও প্রক্রিয়াই কার্য-কারণ সম্পর্কের অধীন, তাই বিশ্বজগৎ আবশ্যিকতার দ্বারা পরিচালিত। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যে বিকাশ ঘটবেই (না ঘটে পারে না) তাকে আবশ্যিক বিকাশ বলে। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে (বর্ষাকাল, আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন) বৃষ্টি হলো আবশ্যিকতা। আবার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শিলাবৃষ্টি রূপে নেমে আসা তাও তো আবশ্যিকতা।

● আবার, আপতিকতা হলো যা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ঘটতে পারে, নাও ঘটতে পারে। অন্য কোনোভাবেও ঘটতে পারে। শিলাবৃষ্টির ফলে ফসলের ক্ষতি হলো আপতিকতা (chance)-র উদাহরণ।

● আবশ্যিকতা ও আপতিকতার মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে। সমাজের প্রগতিশীল অগ্রগতি হলো নিয়ম নিয়ন্ত্রিত, অর্থাৎ আবশ্যিক প্রক্রিয়া। তবে এই আবশ্যিকতা বেশ কিছু আপতিকতার ফলে মূর্ত হয়। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ এটা আবশ্যিকতা। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, এটাও আবশ্যিকতা। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় হলো আপতিকতা।

● নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আপতিকতা আবশ্যিকতায় রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন, দাস সমাজে মজুরি শ্রম (Wage Labour) ছিল আপতিকতা। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মজুরি শ্রম আবশ্যিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে।

সম্ভাব্য (Possibility) এবং বাস্তবতা (Reality)

বিকাশের নিয়মে যার উদ্ভব হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু এখনও যার আবির্ভাব ঘটেনি তাকে সম্ভাব্য বলে। বিশ্বশান্তি সুনিশ্চিতিকরণের লক্ষ্যে তাপ পারমাণবিক যুদ্ধ (Thermo nuclear war)-র বিপদ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা সম্ভাব্য। উন্নয়নশীল দেশগুলির আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির ওপর নির্ভরশীলতার অবসান ঘটানো সম্ভাব্য। বিকাশের ধারায় বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভাব্য।

● বাস্তবতা হলো সেটাই, যা ঘটছে। বর্তমানটাই হলো বাস্তবতা। বাস্তবতার মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই-ই রয়েছে, অর্থাৎ প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দুই-ই সম্ভাবনা বিরাজ করে। প্রগতিশীল ও ইতিবাচক সম্ভাবনাকে বিকশিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্ভাব্য ও বাস্তবতা পরস্পর রূপান্তরযোগ্য।

অংশ ও সমগ্র (Part and Whole)

● যে কোনো বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার যেমন সামগ্রিকতা রয়েছে, আবার সেই সমগ্রটা বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠে। অংশ অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ কারণ অংশকে বাদ দিয়ে সমগ্র গড়ে উঠতে পারে না, আবার শুধুমাত্র অংশ দিয়ে সমগ্রকে সঠিকভাবে বিচার করা যায় না। সামগ্রিকতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই অংশকে বিচার করাই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব করে। পৃথিবী একটি গ্রহ, একটি সমগ্র। প্রশান্ত মহাসাগর তার একটি অংশ। শুধুমাত্র প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে পৃথিবী গ্রহকে বিচার করা যায় না। আবার পৃথিবীকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে তার একটি অংশ যে প্রশান্ত মহাসাগর এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

● সমগ্র মানব সমাজের একটি অংশ হলো পুঁজিবাদী সমাজ। শুধুমাত্র পুঁজিবাদী সমাজ ও তার বৈশিষ্ট্য দিয়ে সমগ্র মানব সমাজকে বোঝা সম্ভব নয়। আবার সমগ্রর অংশ হিসাবে পুঁজিবাদী সমাজ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি সমগ্র মানব সমাজ সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়া গড়ে তোলায় সহায়তা করে।

বিকাশের মূল নিয়ম

● দ্বান্দ্বিকতার তিনটি নিয়ম বিকাশের সমগ্র ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছে। দ্বন্দ্বতত্ত্ব সমগ্র কিছুকে বিকাশের মধ্যে দেখে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু থেকে অতি অতি বৃহৎ বস্তু সমগ্র কিছুই বিকাশের ধারায় বিরাজ করছে। বিকাশের ধারার নিয়মগুলি এই বিকাশ ধারাকে ব্যাখ্যা করেছে।

● সমস্ত বস্তু, ঘটনা তথা প্রক্রিয়া গতির মধ্যে বিরাজ করছে। গতির ফলেই পরিবর্তন। পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে বিকাশ। প্রশ্ন হলো, সমগ্র কিছুর মধ্যে গতি কোথা থেকে আসছে? গতির জন্য কি কোনো বাইরের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়? না, গতির কারণ আভ্যন্তরীণ। প্রতিটি বস্তু, ঘটনার মধ্যেই গতির কারণ বিরাজ করছে। গতির মধ্যদিয়ে পরিবর্তন। পরিবর্তন কীভাবে পরিচালিত হয়? পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে ঘটে বিকাশ। বিকাশের অভিমুখ কী? এই প্রত্যেকটি অর্থাৎ তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে বিকাশের নিয়ম। এবারে আমরা বিকাশের তিনটি নিয়ম নিয়ে আলোচনা করব।

(ক্রমশ)