৫৮ বর্ষ ৫ম সংখ্যা / ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ২৫ ভাদ্র ১৪২৭
কেরালায় বিকল্প ভাবনার ১০০টি প্রকল্প রূপায়ণ শুরু
স্বাস্থ্য প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা।
শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সরকারের অগ্রাধিকার।
কুদুম্বশ্রী প্রকল্পের অধীনে আরো বেশি সংখ্যক প্রান্তিক পরিবারকে আনা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত লালারসের নমুনা সংগ্রহের নতুন লক্ষ্যমাত্রা দিনপ্রতি পঞ্চাশ হাজার।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ৩০ আগস্ট, ওনাম উৎসবের প্রাক্কালে রাজ্যের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য আগামী ১০০ দিনের মধ্যে ১০০টি প্রকল্প সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ১০০টি প্রকল্প সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার থাকবে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার মৌলিক ক্ষেত্রগুলি, ঘোষণা করে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূর্ণ রূপায়ণের লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ। শিক্ষা,স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট-পরিকাঠামো থেকে কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলিতে কোভিডজনিত থমকে যাওয়ার পরিস্থিতিকে অতিক্রম করবার জন্যই এই অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা - তা স্পষ্ট হয়েছে মুখমন্ত্রীর প্রতিটি ক্ষেত্র ধরে বিশদে অর্থবরাদ্দ এবং কাজের সময়সীমা সংক্রান্ত ঘোষণায়। কোভিড পরিস্থিতির সঙ্কটের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মতো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে ঢালাও বেসরকারিকরণ নয়, বা পিপিপি মডেল নয়, বিভিন্ন দপ্তরের সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দের সুষ্ঠু সমন্বয়ের কেরালা সরকারের পরিকল্পনা দেশে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের একটি বড়ো অংশের মুল্যায়ন।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোভিড সঙ্কটকালে বহুল প্রশংসিত খাদ্য সামগ্রী বিতরণের সরকারি প্রকল্প আগামী চার মাসের জন্য বহাল থাকবে। রাজ্যের ৮৮ লক্ষ রেশন কার্ড গ্রাহকদের জন্য সরাসরি রেশন দোকান থেকে তা বিতরণ করা হবে।
রাজ্যে ইতিমধ্যেই চালু থাকা সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণমুলক প্রকল্পের পেনশনের বরাদ্দ মাথাপিছু মাসিক ১০০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) সরকারে আসার পর এই পেনশন ৬০০ টাকা থেকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে ১,৩০০ টাকা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত চার বছরে এই প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকের সংখ্যা ৩৫ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৫৮ লক্ষ করা হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমকে এই একশ’ দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ কালে কেরালার আর্থিক বৃদ্ধি থমকে থাকা উচিত নয়। মানুষের স্বার্থে যে পরিবর্তনসমুহ প্রয়োজন সেই জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। অতিমারীর কারণে যে সমস্ত প্রকল্প রুপায়ণে বিলম্ব হয়েছে সেগুলির দ্রুত রুপায়ণ করব আমরা। এই একশ’ প্রকল্প একশ’ দিনে সম্পূর্ণ করার অ্যাকশন প্ল্যান রাজ্যের অর্থনীতি এবং সমাজকে উন্নত করবে। এটা হলো ক্ষমতায় আসার সময় এই সরকার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা পূরণ করার লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপসমূহ। এটা সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি স্বস্তি নিয়ে আসবে।
জনস্বাস্থ্য বিভাগকে কোভিড-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এই ১০০ দিনের অ্যাকশন প্ল্যান এর মধ্য দিয়ে। কোভিড অতিমারী শুরু হবার পরই ৯,৭৬৮ জন স্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মীকে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন এর মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানান, আগামী ১০০ দিনের মধ্যে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোভিড সংক্রান্ত ফার্স্ট লাইন ট্রিটমেন্ট সেন্টারগুলিকে আরও শক্তিশালী এবং দক্ষ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিদিন টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা হবে। রাজ্য সরকারের লক্ষ্য হলো, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা। এখনো পর্যন্ত রাজ্যে ৩৮৬ টি এই ধরনের পরিবার স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ সম্পূর্ণ করার পর তা চালু হয়েছে। আগামী ১০০ দিনে এই ধরনের আরও ১৫৩ টি স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হবে। দশটি নতুন ডায়ালিসিস সেন্টার, ৯টি স্ক্যান সেন্টার, তিনটি ক্যথ ল্যাবরেটরি এবং দু’টি ক্যান্সার চিকিৎসার আধুনিক সুবিধা যুক্ত কেন্দ্রের কাজ সম্পূর্ণ করা হবে ওই সময়সীমার মধ্যে।
বিদ্যালয় শিক্ষাকেন্দ্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারি স্কুলগুলিতে যেখানে ছাত্র সংখ্যা ৫০০ বা তার বেশি সেগুলির পরিকাঠামো কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বোর্ড-এর (কেআইআইএফবি) মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৫০টিরও বেশি এই ধরনের স্কুল বিল্ডিং গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ২৫০ টি নতুন স্কুল বিল্ডিং-এর নির্মাণ কাজ দ্রুত শুরু করা।
একইসঙ্গে সমস্ত নিম্ন প্রাথমিক স্কুলগুলিকে হাই-টেক বা উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন স্কুলে পরিণত করার কাজ চলছে কেআইআইএফবি সংস্থার অর্থানুকুল্যে। সরকারের লক্ষ্য ১১,৪০০টি বিদ্যালয়ে উচ্চপ্রযুক্তি সম্পন্ন কম্পিউটার ল্যাবরেটরি স্থাপন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এই কাজের দ্রুত রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর। এমন পঁয়ত্রিশটি বিল্ডিং এবং ১৪টি স্কুল বিল্ডিং নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে, যা শীঘ্রই উদ্বোধন করা হবে।এক্ষেত্রে মোট ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা।
৫ লক্ষ স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর হাতে ল্যাপটপ তুলে দিতে বিদ্যাশ্রী প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। যা সম্পন্ন হবে আগামী ১০০ দিনের মধ্যে। কেরালা স্টেট ফিনান্সিয়াল এন্টারপ্রাইজ এবং কুদুম্বশ্রী প্রকল্পের যৌথ অর্থানুকুল্যে এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি রাজ্যের দশটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (আইটিআই) সংস্কারের একটি প্রকল্প ১ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হতে চলেছে শীঘ্রই।
রাজ্যের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কেরালায় সরকারপোষিত এবং সরকারি অর্থানুকূল্যে চলা কলেজগুলিতে ১৫০ টি নতুন কোর্স চালু করা হবে। এর পাশাপাশি এপিজে আব্দুল কালাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং মালয়ালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক জমি অধিগ্রহণের কাজ এবং স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি করার জন্য ১০০ টি এলাকায় ভিত্তি স্থাপন করার কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে ১০০ দিনের মধ্যে। এক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই ১২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ মঞ্জুর হয়েছে।
কেরালা সরকারের লক্ষ কৃষি ক্ষেত্রে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এর পাশাপাশি আগামী ১০০ দিনে কলেজ এবং উচ্চশিক্ষা দপ্তরে এক হাজার পদ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নিয়েছে কেরালা সরকার। স্থানীয় সমবায় ব্যাঙ্ক, কুদুম্বশ্রী, কেএফসি, জেলা শিল্প কেন্দ্র এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলিকে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য তালিকা প্রস্তুত করে তা সংশ্লিষ্ট বিভাগের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করার জন্য।
কেরালার পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ডিজাস্টার রিলিফ ফান্ড থেকে ৯৬১ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধার্য করা হয়েছে ৫,০০০ গ্রামীণ রাস্তা পুনর্নির্মাণের জন্য। এর পাশাপাশি শতাধিক রাস্তা সারাই, আংশিক নির্মাণ সহ নতুন রাস্তা তৈরি, রাস্তার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, ব্রিজ নির্মাণ ইত্যাদি খাতে বিভিন্ন দপ্তরের থেকে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ ইতিমধ্যেই মঞ্জুর হয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বেশকিছু প্রকল্পের টেন্ডার আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যেই আহ্বান করার প্রক্রিয়া চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে।
মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন কৃষি, জলবিদ্যুৎ, ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি, কুদুম্বশ্রী, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সহ বেশকিছু ঐতিহ্যশালী ক্ষেত্র (যেমন ছোবড়া এবং কাজু শিল্পের ক্ষেত্রে) সংক্রান্ত একাধিক প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে ১০০ দিনের মধ্যে সমাপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে যে সমস্ত প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে সে সম্পর্কে নিরীক্ষার কাজ জরুরি ভিত্তিতে চলবে বলে জানা গেছে। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, প্রতিটি স্তরেই রিভিউ করার কাজ জারি থাকবে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজ যথাসময়ে সম্পূর্ণ করা হবে।