৫৮ বর্ষ ৫ম সংখ্যা / ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ২৫ ভাদ্র ১৪২৭
আদানিদের হাতে বিমানবন্দর - লুঠেরা পুঁজিবাদের স্বাভাবিকত্ব
শংকর মুখার্জি
দেশের ছ’টি বিমানবন্দরের পরিচালনা, কর্তৃত্ব এবং উন্নয়নের বরাত পেল আদানিরা। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে এই লিজের মেয়াদ ৫০ বছর। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিলামে আদানি এয়ারপোর্ট হোল্ডিংস লিমিটেড লক্ষ্ণৌ, আমেদাবাদ ও ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরের বরাত পেয়েছিল। আর গত ১৯ আগস্ট তারা পেল জয়পুর, গুয়াহাটি ও তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দর। সম্ভবত এই সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই আরও ছ’টি বিমানবন্দর আদানিদের হাতে যেতে চলেছে। এই বিমানবন্দরগুলি হলোঃ অমৃতসর, বারাণসী, ভুবনেশ্বর, ইন্দোর, রায়পুর এবং ত্রিচি। এই ১২টি বিমানবন্দরের ১০০ শতাংশ মালিকানা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এএআই)’র। সম্প্রতি বেসরকারি পরিচালনাধীন মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরও সিংহভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছে আদানিদের কোম্পানিটি। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত এএআই’র পরে দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর পরিচালনা কোম্পানি হতে চলেছে আদানি এয়ারপোর্ট হোল্ডিংস লিমিটেড।
আদানিরা তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরের জন্য যে অর্থ দিয়েছে তার সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে এর পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল কেরালা সরকার। নীতিগত কিংবা আইনগত দিক দিয়ে এর কোনো বিরোধিতা থাকার কথা ছিল না। আগে কেন্দ্রীয় সরকার বারংবার আশ্বাসও দিয়েছিল। কিন্তু এখন কেরালা সরকারের আবেদন নাকচ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। আসলে তাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দেশের সম্পদ জলের দরে বেসরকারি পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া। এবং বিশেষ করে আম্বানি-আদানিদের মতো মোদী ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের হাতে।
কেরালা সরকার তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরের দায়িত্ব হাতে পেলে তা নিশ্চিতভাবেই একটা দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হতো। এটা নিছক একটা বিমানবন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব পাবার বিষয় শুধু ছিল না, তার থেকেও অনেক বড়ো একটা নীতিগত লড়াইয়ের প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সেই নীতিগত লড়াই গত তিন দশক ধরে চালিয়ে আসছে বামপন্থীরা। সেই বামপন্থীদের পরিচালিত একটা রাজ্য সরকার যদি সেই লড়াইয়ে জিতে যায় তাহলে একটা উদাহরণ তৈরি হবে। এই উদাহরণ তৈরি হোক তা চায়নি কেন্দ্রের সরকার। স্বাভাবিকভাবেই এতে তাদের নীতি-দর্শনের পরাজয় সূচিত হতো। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানিয়েছেন, তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছেন। এবং সরকার এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইও চালাবে। কেরালা বিধানসভাতেও এর বিরুদ্ধে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাশ হয়েছে। সরকারপক্ষের আনা এই প্রস্তাবে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ সমর্থন জানায়। এমনকি বিজেপি’র একমাত্র বিধায়কও এই প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিয়েছে।
কংগ্রেস দল নীতিগতভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের, বিলগ্নিকরণের কট্টর সমর্থক। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মূলত তাদের হাত ধরেই এই প্রক্রিয়া দেশে শুরু হয়। কিন্তু আদানিদের হাতে তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দর তুলে দেওয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে রাজ্যের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, যখন কিনা এই বিমানবন্দর রাজ্য সরকার পরিচালনায় ইচ্ছুক ছিল। সিআইটিইউ সহ বামপন্থী গণসংগঠনগুলি রাজ্যজুড়ে আন্দোলন শুরু করেছে। এই আন্দোলনের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস কোনো ঝুঁকি নেয়নি। আগামী বছর রাজ্যে ভোট। বলা যায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই সরকারের প্রস্তাবে সমর্থন দেয় ইউডিএফ। কিন্তু ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। তিরুবনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে দু’হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছেন। মুখে বললেও মনের ইচ্ছাকে চাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এটা তো সর্বজনবিদিত যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেস সাময়িকভাবে থাকতে পারে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য সঙ্গী কখনই তারা নয়।
এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া সারা দেশে ১০০’রও বেশি বিমানবন্দর চালায়। এর মধ্যে একটিও লোকসানে চলে না। কয়েকটি বিমানবন্দর আবার খুবই লাভজনক। তিরুবনন্তপুরম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সেই হিসেবে অতিলাভজনক। এটাই স্বাধীন ভারতে একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেটা প্রতি বছর ১২৫ কোটি টাকা করে লাভ করে আসছে। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, জয়পুর, গুয়াহাটি ও তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরের জন্য আদানিদের কাছ থেকে সরকার এককালীন মাত্র ১০৭০ কোটি টাকা পাবে। প্রসঙ্গত, আদানিদের কোম্পানির বিমানবন্দর চালানোর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। অন্যদিকে কেরালা সরকার কান্নুর ও কোচি বিমানবন্দর দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছে। এমনকি অর্থমন্ত্রকও বলেছিল, একটি সংস্থাকে দু’টির বেশি বিমানবন্দরের দায়িত্ব যেন না দেওয়া হয়। এতে যাত্রীস্বার্থ বিঘ্নিত হবে। তাদের খরচও বৃদ্ধি পাবে। নীতি আয়োগও বলেছিল কোম্পানিগুলির যোগ্যতামান উন্নতির কথা। কিন্তু সেসব কথায় কান দেওয়া হয়নি। উল্টে এমনভাবে সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ও দরপত্র রাখা হয়েছে যাতে আদানিরা বিশেষ সুবিধা পায়।
এই তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের জন্য ২০০৫ সালে কেরালা সরকার এএআই’কে ২৩.৫৭ একর জমি দিয়েছে। এছাড়া আরও ১৮ একর জমির ব্যবস্থা করতে রাজ্য সরকার কাজ শুরু করেছে। তবে এতে শর্ত রয়েছে যে, স্পেশাল পারপারস ভেহিকেলস গড়ে উঠলে ওই জমির মূল্য সরকারের অংশীদারিত্বে পরিবর্তিত হবে। এই বিমানবন্দর যে ৬৩৫ একর জমির উপর তৈরি হয়েছে তার সিংহভাগই দিয়েছিল রাজ্য সরকার।
মোদী সরকার ঘোষণাই করেছে তারা কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রাখবে না। সব বেসরকারি পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া হবে। দেশের ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমানবন্দরকে আদানিদের ৫০ বছরের লিজে দেওয়া সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ। দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়াতে শ্রমআইন সংশোধন করা হচ্ছে, যাতে শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর শোষণ বৃদ্ধি করা যায়; করছাড়, ব্যাঙ্কের ঋণমকুব করা হচ্ছে; রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা-খনি সব জলের দরে বেচে দেওয়া হচ্ছে। মুখে ‘আত্মনির্ভর স্লোগান’ আউড়ে এসবই করছে আমাদের ‘দেশপ্রেমী’ মোদী সরকার। আত্মনির্ভর করছে আদানিদের। লুঠেরা পুঁজিবাদ এক কথায় দেশজুড়ে লুঠ চালাচ্ছে মোদী সরকারের বদান্যতায়। শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বেই পুঁজিবাদের সমর্থক সরকারগুলির এটাই রাজনীতি। এর বিরুদ্ধে বামপন্থীদের রাজনীতি শ্রমিক-কৃষকের রুজি-রোজগার বাঁচানোর, দেশ বাঁচানোর। রাজনীতির এই দ্বন্দ্ব বৈরী দ্বন্দ্ব। তাই তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরের দায়িত্ব কেরালার বাম সরকার পায় না। রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই এই দ্বন্দ্বের সমাধান করতে হবে।