E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৫ম সংখ্যা / ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ২৫ ভাদ্র ১৪২৭

মুক্ত কাফিল খান এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

গৌতম রায়


আরএসএস’র তাত্ত্বিক অবস্থান মুসলমান বিদ্বেষ ও বিরোধিতা। তারা নিজেদের তথাকথিত আদর্শগত অবস্থানেই মুসলমানদের ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। সঙ্ঘের তাত্ত্বিক ভিত্তির অন্যতম নির্মাতা, এম এস গোলওয়ালকর, তার ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’নামক এক আত্মঘাতী তাত্ত্বিক মতবাদ সঙ্ঘের জন্যে তৈরি করতে গিয়ে খুব স্পষ্টভাবেই মুসলমান সমাজকে ভারতের নাগরিকত্ব না দেওয়ার পক্ষেই সওয়াল করেছেন। এই তাত্ত্বিক অবস্থানই আরএসএস কিংবা তাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র আদর্শগত অবস্থানের মূল ভিত্তি। সেই ভিত্তির নিরিখেই অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী ক্ষমতায় থাকার সময়ে, ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী এনেছিল। তারই ভিত্তিতে মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই এনআরসি’র ভিতর দিয়ে, সহনাগরিক মুসলমান সমাজের নাগরিকত্ব কাড়বার উপক্রম করেছেন।

কাফিল খান

বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে সহনাগরিক মুসলমান সমাজের নাগরিকত্ব কাড়ার বিষয়টি নিয়ে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ায় মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে প্রবল প্রতিরোধের দেওয়াল তোলা হয়েছে।বহু ক্ষেত্রেই প্রচলিত রাজনৈতিক ধারাপ্রবাহকে কার্যত পরোয়া না করে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই সংবিধান বিরোধী প্রবণতার বিরুদ্ধে জানকবুল লড়াইয়ের সংকল্পে দৃঢ় হয়েছেন মুসলমান সমাজ। গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন, ধর্মনিরপেক্ষবোধ বিশিষ্ট মানুষেরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ভিতর দিয়ে, মুসলমানসমাজের নাগরিকত্বহরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে শামিল হয়েছেন। বামপন্থী রাজনীতির সর্বস্তরেই মানুষ, এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটির ভিতর দিয়ে সঙ্ঘ-বিজেপি’র তথাকথিত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ স্থাপনের অভিপ্সার নগ্ন বহিঃপ্রকাশকেই অনুভব করেছিলেন।

এই অবস্থায় গোটা দেশে একটা অভিনব পর্যায়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে শুরু করে। আর সেই প্রতিবাদের ভিতরেই প্রতিরোধের সংকল্প জারি হতে থাকে।প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক গতিপ্রবাহের বাইরে এনআরসি র বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে দৃঢ়চিত্তের প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছিল, সেই উচ্চারণের ধরনের সঙ্গে বিগত বিশ শতকের সাতের দশকের জরুরি অবস্থা-বিরোধী আন্দোলনের একটা আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য ফুটে উঠতে শুরু করে। ‘শাহিনবাগ’ ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে একটা নয়া-ইতিহাস রচনা করতে শুরু করে।দিল্লির শাহিনবাগ, গোটা ভারতকেই ধীরে ধীরে শাহিনবাগে পরিণত করতে থাকে। বস্তুত, মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর, দীর্ঘ ছয় বছরে এমন আসমুদ্রহিমাচলে বিজেপি-বিরোধী জনবিক্ষোভ এবং গণপ্রতিরোধের সংকল্প আগে সেভাবে উচ্চারিত হয় নি।

এই উচ্চারণ আতঙ্কিত করে তোলে গোটা মোদীশাহিকে।সন্মিলিত জনপ্রতিরোধকে ভয় পেতে শুরু করে আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি সহ গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির। ফলে এই প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সংকল্পকে বানচাল করতে গুজরাট গণহত্যার আদলেই নামিয়ে আনা হয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত দিল্লি গণহত্যা। অত্যাচারের স্টিমরোলার চলে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডাঃ কাফিল খান থেকে গবেষিকা সাফুরা জারগার - শুধু মানবতার কথা বলছেন বলেই নয়, আইন করে মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরণের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে, জন্মসূত্রে একজন মুসলমান নাগরিক হিসেবে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষুর শিকার হতে শুরু করেন। রাষ্ট্রশক্তির বিরাগভাজন হয়েই মেধাবী গবেষিকা সাফুরা জারগার, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও দিনের পর দিন কাটান কারাভ্যন্তরে। তাঁর অন্তঃসত্ত্বা হওয়া ঘিরেও আদালতে যে বাদানুবাদ চলে, তার তুলনা করা যেতে পারে কৌরব রাজসভাতে দ্রৌপদীর অপমানের সঙ্গে। নারীত্বের এই চরম অপমান দেখেও, সবথেকে দুর্ভাগ্যের কথা, প্রতিবাদ সর্বস্তর থেকে ধ্বনিত হয় না। অতিবিপ্লবী নাগরিক সমাজ, যাঁরা কবি ভারভারা রাওকে মুক্ত করবার আহ্বান জানান, তাঁরা একবারও উচ্চারণ করেননি সাফুরার নাম। অতি সম্প্রতি কবিকে মুক্ত করার যে অভিপ্রায় তাঁরা নিয়েছিলেন, সেখানে যে বাইশ জনের নাম তাঁরা রেখেছিলেন বন্দিমুক্তির দাবির তালিকাতে, সেখানে ছিল না ডাঃ কাফিল খানের নাম। বামপন্থী ছাত্র-যুবরা এই কোবিদাক্রান্ত সময়েও সামাজিক গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে দাবি জানিয়েছেন কাফিল খানের মুক্তির।কিন্তু ভীমা কোরেগাঁও ঘিরে সোচ্চার ব্যক্তিত্বদের কাছে একবারের জন্যেও গুরুত্ব পায় নি ‘মুসলমান’ ডাঃ কাফিল খানের নামটি।

রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস দিল্লি গণহত্যার মূল লক্ষ্য ছিল, প্রচলিত দলীয় আনুগত্যের সীমারেখার বাইরে গোটা দেশব্যাপী, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে যে প্রবল গণবিক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া।ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মূল পরিকাঠামোকে অগ্রাহ্য করবার পরেও সংখ্যালঘু সমাজ, ঘটনার আকস্মিকতায়, প্রথমদিকে কার্যত নীরব থেকেছেন।তাঁদের সেই নীরবতাকে, তাঁদের ভীরুতা হিসেবে উপস্থাপিত করেছিল অসভ্য, বর্বর হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি।এইভাবে মুসলমান সমাজের উপর সবদিক থেকে চাপ তৈরি করেছিল আরএসএস, বিজেপি, সর্বোপরি রাষ্ট্রশক্তি। সেই মুসলমান সমাজ যখন নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের নামে তাঁদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার রাষ্ট্রিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, সর্বস্তরেরে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবাসী, এই পর্যায়ে যখন হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কেবল প্রতিবাদ নয়, প্রবল প্রতিরোধের সংকল্পে রুখে দাঁড়ান, তখনই প্রমাদ গুণতে শুরু করে আরএসএস, বিজেপি এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রশক্তি। তাই অত্যাচারের রাষ্ট্রীয় থাবা নেমে আসে দিল্লি গণহত্যার মাধ্যমে। তাই রাষ্ট্রিক আক্রমণের শিকার হন কাফিল খান থেকে সাফুরা জারগার। তাঁদের উপর কেবলমাত্র মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে এই আক্রমণ নেমে আসে না।,তাঁরা কার্যত বিনাবিচারে দিনের পর দিন কারাভ্যন্তরে কাটান জন্মসূত্রে ‘মুসলমান’ হওয়ার ‘অপরাধে’!

সাফুরা জারগার

এনআরসি-বিরোধী গণআন্দোলনকে নিছক মুসলমানদের কাজ বলে বিভ্রান্তি ছড়াবার কম চেষ্টা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির করে নি। কার্যত, বামপন্থীরা ব্যতীত শাহিনবাগের গোটা কর্মকাণ্ড থেকে অ-বিজেপি বুর্জোয়া রাজনীতিকেরাও একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। অজয় সিং বিশোওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথ যখন তাঁর গোটা প্রশাসনিক পরিকাঠামো দিয়ে শিশু চিকিৎসক কাফিল খানের বিরুদ্ধে চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করতে শুরু করেছিলেন, তখনও কেবলমাত্র বামপন্থীরাই প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। এইক্ষেত্রে সবথেকে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিল বামপন্থী ছাত্র-যুবরা। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর ভিতর দিয়ে বিজেপি যে গোলওয়ালকরের ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণাকেও এককভাবে দিল্লির ক্ষমতা দখলের পর, তাকে ‘রাষ্ট্রবাদে’ পরিণত করতে চায়, সেই ধারণাকে ফলপ্রসূ করে, আরএসএস’র অনুমোদিত হিন্দুত্বের বাইরে চিন্তা করা যেকোনো মানুষকেই ‘অহিন্দু’ বলে ঘোষণার প্রাথমিক ধাপ নির্মিত হতে শুরু হয়েছে। এই ধাপেরই সবথেকে বড়ো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, যাঁরা ভারতের বহুত্ববাদী চেতনাতে বিশ্বাস করবেন, তাঁদেরকেই আর ‘হিন্দু’ বলে স্বীকৃতি দেবে না সঙ্ঘ-বিজেপি। ফলে কেবলমাত্র জন্মসূত্রে মুসলমান, এমন নাগরিকেরাই নন, জন্মসূত্রে হিন্দু, অথচ আরএসএস’র বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, অপর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না, পরমতের প্রতি সহিষ্ণু, তেমন মানুষদেরও আর ভারতের নাগরিক বলে স্বীকৃতি না দেওয়ার তোড়জোরই হলো এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এই আইনে প্রথমে মুসলমান সহ, আরএসএস-বিজেপি’র হিন্দুত্বে অবিশ্বাসী, বহুত্ববাদী চেতনায় বিশ্বাসী, বহুস্বরে বিশ্বাসী মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হবে, গোলওয়ালকরের পথনির্দেশিকা অনুযায়ী। পরবর্তীতে তাঁদের নাগরিকত্ব হরণ করা হবে। এইসবেরই প্রাথমিক ধাপ সমস্তরকমের বিপক্ষ কণ্ঠরোধ। কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, গবেষিকা থেকে শুরু করে, অতি সাধারণ মানুষ, যাঁরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন না, তাঁদের কণ্ঠরোধ। তাঁদের জেলে পাঠানো। যাঁরা কোনো ক্ষেত্রেই মৌলবাদী চিন্তার সঙ্গে গলা মেলান না, তাঁদের কণ্ঠরোধ করা। রাষ্ট্রযন্ত্রের পেষণপ্রক্রিয়াতে তাঁদের পিষে ফেলা।

প্রথমদফার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র করে তুলতে খাদ্যাখাদ্য বিচার, সেই বিচারের জেরে দাদরির মতো ঘটনা, শেখ আখলাকের হত্যাকাণ্ডের মতো নারকীয়তা নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ঘটিয়েছিল। এই সামাজিক ব্যাভিচারের ভিতর দিয়ে সাধারণ মানুষের ভিতরে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাও ছিল বিজেপি’র টার্গেট। সেই পথেই তারা লাভ জেহাদ করেছিল। ঘটিয়েছিল ‘ঘর ওয়াপসি’। এইসবই ছিল সঙ্ঘ-বিজেপি’র ক্ষেত্র প্রস্তুতের এক একটি পর্যায় বিশেষ।

এভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই, মোদী তাঁর দল বিজেপি’র একক গরিষ্ঠতার জেরে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পরেই, সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ এ ধারার অবলুপ্তি ঘটিয়ে, গোটা কাশ্মীর উপত্যকা এবং সেখানকার মানুষদের সঙ্গে সর্বস্তরের ভাযতবাসীর বিচ্ছিন্নতার পাঁচিল তুলে দিলেন। কাশ্মীর ঘিরে নিজেদের সাম্প্রদায়িক, বিভাজনমূলক অভিপ্সাকে ফলপ্রসূ করবার লক্ষ্যে মোদী প্রশাসনের ভারতের সংবিধানের ধ্বংসলীলার যে আয়োজন, সেটির সঙ্গে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের কুশীলবদের যে মানসিক সংযোগ, তাকেও দেশবিরোধিতার নাম করে, নিজেদের দেশের সংবিধানকে অমান্য করবার যাবতীয় অভিপ্রায়কে সর্বজনীন মর্যাদা দিতে চেয়েছে আরএসএস-বিজেপি। এই ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক শঠতার বিরোধিতা করেছে এনআরসি-এনপিআর বিরোধী গোটা দেশের মানুষ। এই অভিপ্রায়ের বিরোধিতা করেছেন ডাঃ কাফিল খান, সাফুরা জারগার সহ গোটা জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া থেকে শুরু করে, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী,অভিভাবকেরা। তাই এঁদের প্রত্যেকের গায়ে রাষ্ট্রযন্ত্র লটকে দিয়েছে তাঁদের আরোপিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অসত্য অভিযোগ। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই বার বার আবেদন করেও জামিন পান নি সাফুরা জারগার থেকে কাফিল খানের মতো মানুষেরা। যেখানে খুনীরাও পেয়েছে অবাধ জামিন।

কোভিড ১৯-জনিত অতিমারীর কালে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, এনআরসি-এনপিআর ইত্যাদি আত্মঘাতী কালাকানুনের ভিতর দিয়ে সহনাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার নোংরা খেলা থেকে সরে এসেছে - এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণই নেই। বস্তুত, কোভিড ১৯-জনিত সঙ্কটের সূচনাপর্বেই দিল্লির নিজামউদ্দিনে তবলিগ জামাতকে ঘিরে ভয়ঙ্কর প্ররোচনামূলক, মিথ্যে খবর গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়বার ক্ষেত্রে সমগ্র হিন্দুত্ববাদী শিবিরের ভূমিকা ছিল সবথেকে ন্যক্কারজনক। এই বিভাজনের রাজনীতিকে, অতিমারীর এতোবড়ো সঙ্কটের সময়ে ব্যবহারের ভিতর দিয়েই গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির এটাই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এনআরসি, এনপিআর-এর ভিতর দিয়ে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, ভাষাতে ভাষাতে, লিঙ্গে লিঙ্গে, বর্ণে বর্ণে সংঘাতকে তীব্র করে নিজের ধর্মান্ধ নীতিমালাকে ফলপ্রসূ করে, মানুষকে ভাতের লড়াই ভুলিয়ে, কাজের লড়াই ভুলিয়ে, এই দেশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবাধ মৃগয়াভূমি হিসেবে একটা খুল্লামখুল্লা রূপ দিতে তারা এখন বদ্ধপরিকর।

অপরপক্ষে, ক’মাস আগে সাফুরার মুক্তি, কয়েকদিন আগে কাফিল খানের মুক্তি, এইসব মুক্তিকে ঘিরে এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের পক্ষের মানুষদের আবারও বুক ভরা প্রত্যয় নিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্পটিকে নিয়ে এক লড়াইয়ের ময়দানে সমবেত হওয়া। সংখ্যালঘুর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে বিভ্রান্ত করতে, অতীতের মতোই, এই লড়াইয়ের সঙ্গে অনেককিছুকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ভারভারা রাওদের মুক্তির দাবির সঙ্গে একত্রে কাফিল খানের নাম পর্যন্ত একাংশের মানুষ উচ্চারণ করেন নি। আমরা কিন্তু প্রকরণগত আন্দোলনের ফারাক ভারভারা রাওদের সঙ্গে সাফুরা জারগার বা কাফিল খানের লড়াইয়ের থাকলেও, বিনাবিচারে আটকের বিরুদ্ধতার প্রশ্নে পৈতে, টিকি, টুপি, টোপর বিচার, বিশ্লেষণের পক্ষপাতী নই, একটিবারের জন্যেও। সংখ্যালঘুর স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লড়াই আর একজন কবির মুক্তকণ্ঠনাদকে পৃথক করে দেখার কৌশলী রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। যে কিষাণজি একদা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করে, যাঁর নেতৃত্বে সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিষাণজির সেই স্বপ্নিল ব্যক্তিত্বের ক্ষমতালাভের পর, তাঁরই পুলিশের এনকাউন্টারে সেই কিষাণজি নিহত হন। তখন এই ভারভারা রাওই কিষাণজির সমর্থনে কলকাতার বুকে প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছিলেন। সাফুরা, কাফিলের মতো বিনাবিচারে আজ আটক সেই ভারভারা রাও এবং তাঁর সতীর্থদের আমরা মুক্তি চাইছি এই কারণেই যে, নিপীড়নমূলক আইনের জেরে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করাটা চরম অগণতান্ত্রিক।ভারভারার পথ, আমাদের পথ নয়। তবুও যেকোনো বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ করাটা রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার একটা নগ্ন প্রকাশ।