৫৮ বর্ষ ৫ম সংখ্যা / ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ২৫ ভাদ্র ১৪২৭
সিক্তবাজার এবং জুনোসিসের তত্ত্ব
তপন মিশ্র
অনেক মার্কেটের নাম শুনেছেন - ওপেন মার্কেট, ক্লোজড মার্কেট, সুপার মার্কেট, শেয়ার মার্কেট ইত্যাদি। কিন্তু ওয়েট মার্কেটের নাম আগে শুনেছিলেন? করোনার দৌলতে এমন একটি মার্কেটের কথা নতুন করে জানলাম। ওয়েট মার্কেট কথাটির মধ্যে অভিনবত্ব আছে। এ যেন এমন এক বাজার যা কেবল চীনেই পাওয়া যায় এবং দিনরাত্রি রোগ ছড়ায়। ওয়েট মার্কেট মানে আপনার আমার হৃৎকম্প সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জায়গা। অন্য দিকে ওপেন মার্কেট লক্ষ কোটি মানুষের পেটের ভাত কেড়ে নেয় কিন্ত করোনা ছড়ায় না তাই কি সুন্দর?
আমাদের গ্রাম বা শহরের প্রতিটি পাড়ায়, সাপ্তাহিক হাটে যে সবজি-মাছ-মাংসের বাজার বসে সেগুলিই ওয়েট মার্কেট। সকাল থেকে দু’বেলা ভাতের জন্য ব্যবসায়ীরা আপনার-আমার জন্য দিনের পর দিন মাছের ডালা সাজিয়ে রাখে, বার বার ধুয়ে খাসির বা গোরুর মাংস ঝুলিয়ে রাখে, মুরগির মাংস কাটে এবং ধুয়ে আপনাকে দেয়; এমনকি সবজি তাজা দেখানোর জন্য বার বার ধোয়। এগুলিই হলো সিক্ত বা ভেজা বাজারের ছবি। আপনি যদি সুপার মার্কেট বা মলে ঢোকেন তাহলে যে মাছ-মাংস কিনবেন সেগুলি প্যাকেটে মোড়া তাই ভেজা নয়, শুকনো। ভেজা বাজার আপনার পরিচিত পাড়ার ছেলের বা মেয়ের আর সুপার মার্কেট রিলায়েন্স, বিগবাজার ইত্যাদির।
বাজার দখলের লড়াইতে খুচরো ব্যবসায় থাবা বসানোর লক্ষ্য নিয়ে বিদেশি বহুজাতিক সহ দেশের রাঘববোয়াল বেনিয়ারা মুখিয়ে আছে। আমাদের স্টেশন বাজার, পাড়ার বাজার হয় রেলের জায়গায়, না হয় কোনো সরকারি জায়গায়। সকাল-সকাল বসে এবং দুপুর গড়ালে সব খালি। কত পরিবারের পেট চলে সেই অসংগঠিত বাজারগুলিতে তার লেখাজোখা নেই। আমাদের দেশে এই বাজারগুলি একটা বড়ো মাপের অর্থনীতি। আপনি ওখানে ১০০ গ্রাম মাছ, ২৫০ গ্রাম মাংস বা সবজি বা ২ টাকার লঙ্কা কিনতে পারবেন। এই লেনদেনই দেশের এক বড়ো অংশের মানুষের আর্থিক মেরুদণ্ড। পশ্চিমের দেশে শুকনো বাজারের দাপট বেশি। চীন, ভিয়েতনামে এখনও মলের বা সুপার মার্কেটের সঙ্গে পাড়ার খুচরো বাজারের অস্তিত্ব আপনার চোখে পড়বে। করোনাকালে এই অসংগঠিত ওয়েট বাজারগুলির বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর সুযোগ কর্পোরেট মিডিয়া ছাড়তে চায় না।
উহানের বাজার যেন সপ্তম আশ্চর্যের একটি
বাজারের নাম হুয়ানান সি-ফুড হোলসেল মার্কেট (Huanan Seafood Wholesale Market)। চীনের উহান শহরের এই বাজার থেকে গত বছর ডিসেম্বর মাসে সংক্রমণ ঘটে এক নতুন ভাইরাসের। মূলত ফুসফুসে বড়ো ধরনের সংক্রমণ ঘটানোর এবং ছড়ানোর অভিযোগ আসে। জ্বর, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ। পরে রোগটির নামকরণ হয় সার্স-২। নতুন ভাইরাসটির জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এটি ২০০৩ সালে পাওয়া সার্স ভাইরাসের থেকে একটু ভিন্ন।
ভারতে তো বটেই এশিয়ার অন্যান্য দেশে মাছ-মাংসের বাজারের ছড়াছড়ি। সিঙ্গাপুরের চায়না টাউন কমপ্লেক্স, টেক্কা মার্কেট কাঁচা মাছ-মাংসের বাজার। নিউইয়র্কের সিবিএসএন বলছে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ৭০টি আইনি ওয়েট মার্কেট আছে। এই ঘটনার পর সেগুলি বন্ধ করার দাবি ওঠে। এগুলিতে সামুদ্রিক প্রাণী সহ অন্যান্য প্রাণিজখাদ্যের বাজার বসে। আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে এমন শতশত জীবন্ত প্রাণীর বাজার আছে যেখান থেকে মাংস সরবরাহ হয়। পৃথিবীতে ওয়েট মার্কেটে বাণিজ্যের পরিমাণ কম করে ৭৪ বিলিয়ন ডলার। এই বাজারে কাজ করেন প্রায় ১৪০ লক্ষ মানুষ (Health Affairs, May 28, 2020)।
সিএনএন গত ৬ই এপ্রিল বেশ কয়েকজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। তাদের মত হলো ওয়েট মার্কেটের তত্ত্ব নিছক একটি অনুমান। যেহেতু ২০০৩ সালে সার্স-১-এর সময়ে চীনের গুয়াংদং রাজ্য থেকে এই ভাইরাস ছড়ায়, তাই এবারেও একই ধরনের সংক্রমণের অনুমান করছে কিছু গণমাধ্যম। কোন্ উৎস থেকে করোনা ভাইরাস ওয়েট মার্কেটে এসেছে তা এখনও নিশ্চিত নয়। চীনে সাপ এবং বাদুড় খাদ্য হিসাবে, প্যাঙ্গোলিনের শুকনো আঁশ পরস্পরাগত ঔষধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ল্যানসেট পত্রিকার (২৪ জানুয়ারি, ২০২০ সংখ্যা) এক গবেষণা বলছে, প্রথম যে ৪১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় তাদের মধ্যে ১৩ জনের হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না বা এই বাজারের আক্রান্তদের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ ছিল না। সায়েন্স পত্রিকা ল্যানসেটের গবেষণা সমর্থন করে বলছে যে, প্রথম রোগীর হদিশ এখনও পাওয়া যায়নি। South China Morning Post (13/3/2020) প্রথম রোগীর সন্ধানে ২০১৯-র ১৭ মার্চ হুবাই রাজ্যের এক রোগীর নাম উল্লেখ করা হয় যদিও তা সরকার নিশ্চিত করেনি।
জুনোসিসের তত্ত্ব
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে করবেট জাতীয় উদ্যানে বিয়ার গ্রিলস (আসল নাম Edward Michael Grylls)-এর ছবি অনেকেই দেখেছেন (১৩ আগস্ট, ২০১৯)। গ্রিলস তার কিছুদিন আগে একটি কর্পোরেট মিডিয়ায় 'The Island with Bear Grylls' নামে একটি ভিডিও তৈরি করেন। এই ভিডিওতে একটি ছোট জলজ্যান্ত কুমিরকে পেছন থেকে আক্রমণ করে সঙ্গে সঙ্গে কেটে ফেলে কাঁচা মাংস খাওয়ার দৃশ্য আছে। কর্পোরেটদের ভাষায় এটাই অ্যাডভেঞ্চার। ঘটনাটি ভারতের নয় যদিও আমরা অনেকে এবং প্রধানমন্ত্রীর সেই দৃশ্য উপভোগ করেছি। এই অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে জুনোসিসের নীতি কি লঙ্ঘিত হয়নি, না কেবল আদিবাসীদের পরম্পরাগগত শিকারে জুনোসিসের নীতি লঙ্ঘিত হয়? এই প্রশ্নের অর্থ এই নয় যে, ভারতে সংরক্ষণের মূলনীতি লঙ্ঘন করা যাবে।
সেই সমস্ত রোগ যা কোনো এক প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের দেহে ছড়ায় তাকে জুনোসিস (Zoonosis) বলে। বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল (habitat) নষ্ট হলে তারা বেশি বেশি করে বিভিন্নভাবে মানুষের সংস্পর্শে আসতে বাধ্য হয়। বন্যপ্রাণ ও মানুষের সংঘাতের এটাও একটা বড়ো কারণ। কেউ কি এমন কোনো গবেষণার বা তথ্যের কথা শুনেছেন যে উহানের ওয়েট মার্কেট বাদ দিয়ে বাদুড়, সাপ বা প্যাঙ্গোলিন থেকে মানুষে কোভিড সংক্রমণ হয়েছে অর্থাৎ এক্ষেত্রে কী জুনোসিসের ইতিহাস আছে? ইদানিংকালে যে সমস্ত সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে তা হচ্ছে একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষে। তা’বলে আগামীদিনে কোনো বন্যপ্রাণী থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। শত শত বছর ধরে এই ধরনের প্রাণী থেকে সংক্রমিত রোগের খবর বিজ্ঞানের নজরে আছে। অ্যানথ্রাক্স, প্লেগ, র্যা বিজ (জলাতঙ্ক), বার্ড ফ্লু, ইবোলা, এইচআইভি ইত্যাদি আরও অনেক এই তালিকায় রয়েছে। এখন এই তালিকায় যুক্ত হলো করোনার নাম। চীনে কিছু বন্যপ্রাণী খাদ্য তালিকায় থাকার কারণে বন্যপ্রাণী প্রজাতি নিয়ে কিছু কুৎসা ছড়ানো হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে বেশ কয়েকটি আদিবাসী সম্প্রদায় বিশেষ ধরনের ইঁদুর (যেগুলি মূলত ধানখেতের আশেপাশে পাওয়া যায়) এবং বৈশাখ মাসে শিকার উৎসবের সময় কিছু বন্যপ্রাণ শিকার করে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। জার্মানির থুরিঙ্গেন রাজ্যের সালফেলড শহরের অদূরে বন্য ছাগল (Capra aegagrus) শিকার করে মাংস খাওয়া অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা এবং চাক্ষুষ করেছিও বটে। জার্মানিতে এই ধরনের শিকারের অনুমতি বিশেষ ক্ষেত্রে দেওয়া হয়।
সংবাদ সংস্থা সিএনএন গত ১০ আগস্ট একটি খবরে বলেছে, আমেরিকার বিভিন্ন শহরে কচ্ছপ, বিভিন্ন ধরনের সাপ, ব্যাঙ, কাঠবেড়ালি, উট এবং অ্যালিগেটর জাতীয় কুমির ইত্যাদি অদ্ভুত প্রাণী খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এগুলি আসে বিভিন্ন দেশ থেকে যার মধ্যে আমাজন বনাঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই খবরের আর এক জায়গায় বলা হয় যে, এক সমীক্ষা জানা গেছে, চীনের ৯৭ শতাংশ মানুষ বন্যপ্রাণী খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না।
২০১০ সালে The Royal Society-র Biological Sciences-র একটি গবেষণা প্রবন্ধে (Ecological interventions to prevent and manage zoonotic pathogen spillover) সোকোলো এবং তাঁর সহ গবেষকরা বলছেন যে, কোনো একধরনের বন্যপ্রাণীর আধিক্যের কারণে হত্যা করা ইত্যাদি পদ্ধতি অজানা রোগের সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে পারে। একারণে তাঁরা এই সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু বাস্তুতান্ত্রিক সমাধানের কথা বলেন।
মাইকেল ক্লেভেরি (Aix-Marseille University, France)-র মতে পুরনো পারমাফ্রস্ট (দীর্ঘদিন ধরে বরফের স্তর)-এর মধ্যে বেশ কিছু ধরনের ভাইরাস থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এগুলি আগামীদিনে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীকে আক্রমণ করতে পারে। এগুলি প্রাগৈতিহাসিক যুগে মহামারীর কারণ ছিল। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রুশ দেশে অজানা ভাইরাসঘটিত রোগে যে হাজার হাজার রেন ডিয়ার মারা গেছে তাদের শব বরফের মধ্যেই চাপা আছে যা বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বরফ গললে বেরিয়ে পড়তে পারে।
জাতিসঙ্ঘের ইউএনইপি (United Nations Environment Programme) গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বন্যপ্রাণীবাহিত রোগ এবং গৃহপালিত প্রাণীবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পৃথিবীর সমস্ত দেশের জন্য একটি উপদেশমূলক দলিল তৈরি করে। এখানে ১০টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছেঃ এই সম্পর্কিত রোগগুলি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, মানুষের খাদ্যশৃঙ্খলে কোথায় কোথায় প্রাণীদের চাহিদা থাকে এবং সেইসব ক্ষেত্রে রোগজীবাণু মুক্ত করার উপায় নির্ধারণ, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ল্যান্ডস্কেপ স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ (Landscape approach) ইত্যাদি। ইউএনইপি’র একজন কর্মকর্তা ইংগার অ্যান্ডারসনের কথা হলো - “To prevent future outbreaks, we must become much more deliberate about protecting our natural environment.”। সার্বিকভাবে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের রক্ষাই ভবিষ্যতে আমাদের এই ধরনের রোগ থেকে বাঁচাতে পারে। ইকোসিস্টেম অ্যাপ্রোচ এক গালভরা নাম হলেও আসল কথা হলো একটি সংরক্ষিত অঞ্চল তৈরি করলেই সংরক্ষণের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায় না। যেমন ধরা যাক পুরুলিয়া শহরের সাহেববাঁধ সংরক্ষণ করতে হলে কেবল সাহেববাঁধ নয় তার আশেপাশের ঘরবাড়ি, যে পথে জল আসে, যে পথে জল নিষ্কাষিত হয় এবং যারা এই বাঁধের উপর নির্ভর করেন প্রত্যেককে যুক্ত করে সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এটাই ইকোসিস্টেম আপ্রোচ। কেবল গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে সংরক্ষণের উদ্যোগ সেখানকার বাস্তুতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান করবে না। গোরুমারার পাশের লাটাগুড়ি শহর সহ আন্যন্য গ্রাম, নদী ইত্যাদির সংরক্ষণের পরিকল্পনা একসঙ্গে করা দরকার।
বন্যপ্রাণীদের ভিলেন করে দেখানো বা ওয়েট মার্কেটের বিরোধিতার নামে পাড়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্সদের রাস্তা পরিষ্কার করার সুযোগ রাষ্ট্রের হাতে দেওয়া যাবে না। ওয়েট মার্কেটের সমগ্র ব্যবস্থাপনার উপর নজরদারি এবং সংক্রমণের সাম্ভাব্য সমস্ত উপায়কে রোধ করা সরকারের দায়িত্ব। এগুলি এড়িয়ে কেবল ওয়েট মার্কেট বা জুনোসিসের উপর দায় চাপানো যাবে না।