৫৮ বর্ষ ৫ম সংখ্যা / ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ২৫ ভাদ্র ১৪২৭
রাজ্য সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা ও শাসকদলের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর ক্রমশ তীব্র হচ্ছে
সন্দীপ দে
সিপিআই(এম) নেতাদের উপর তৃণমূলীদের হামলার প্রতিবাদে গড়বেতায় লালঝান্ডার মিছিল।
তৃণমূলী শাসনের পশ্চিমবঙ্গ আছে পশ্চিমবঙ্গেই। সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি, অপদার্থতা-উদাসীনতা ইত্যাদি একটা রাজ্যকে কোন্ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে, তার যেন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে এ রাজ্য। সরকারের চরম অপশাসন- অকর্মণ্যতার সাথে যুক্ত হয়েছে নানা দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি, তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে শাসকদলের দৌরাত্ম্য ও অবাধ লুটের কারবার। এ সবকিছুর পরিণতিতে সবক্ষেত্রে এ রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্গীন হয়ে উঠছে, বিপর্যন্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি, আদর্শ, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ছাড়াই শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের খামখেয়ালিপনায় সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সার্বিক ব্যর্থতার ভার বইতে হচ্ছে এ রাজ্যকে। চূড়ান্ত দুর্ভোগের কবলে পড়ছেন রাজ্যবাসী। তবুও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মুখ্যমন্ত্রীর, রাজ্য সরকারের। উলটে সংবাদমাধ্যমে বাগাড়ম্বর চলছে দ্রুতলয়ে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চিরাচরিত অসংলগ্ন যুক্তিহীন মিথ্যা কথার জালে বিরোধীদের সব অভিযোগকেই নস্যাৎ করতে চাইছেন। আর তাঁর প্রশ্রয়ে, অনুপ্রেরণায় অনুগত নেতা, মন্ত্রী, মাতব্বরদের লাগামছাড়া কর্মকাণ্ডও চলছে বহাল তবিয়তে। কিন্তু রাজ্যের ভুক্তভোগী মানুষ কেন এত সহ্য করবেন! তাই তাঁদের এতদিনের জমানো ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে। তাঁরা করোনা দুর্বিপাকের মধ্যেও জীবন-জীবিকার তাগিদে, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দাবিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন। প্রশাসনিক দমনপীড়ন ও শাসকদলের হুমকি-তাণ্ডব কোনো কিছুই তাঁরা আজ তোয়াক্কা করছেন না।
রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বেসামাল অবস্থার মধ্যে এই সময়কালে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার চূড়ান্ত ব্যর্থতা প্রতিমুহূর্তে প্রকট হয়ে উঠছে। অথচ এই বিভাগের দায়িত্ব স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। নানা সরকারি পরিসংখ্যান, বিজ্ঞাপন, সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ ইত্যাদি লক্ষ করলে মনে হবে যেন এই করোনাকালে কতো না উন্নত ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে এ রাজ্যে! কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক তার বিপরীত। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে, স্বাস্থ্য পরিষেবার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অভাবে বেঘোরে প্রাণ যাচ্ছে অনেকেরই। একইসঙ্গে সরকারি উদাসীনতার বলি হতে হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশকর্মী সকলকেই। রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এই বেহাল দশার সুযোগে বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলি লাগামছাড়া বিল নিয়ে কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটছে। সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝে সংবাদমাধ্যমের সামনে অনেক রঙবাহারি বুলি আওড়ালেও সাধারণ মানুষের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতাল থেকে অসুস্থ রোগীকে ফিরিয়ে দেবার ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটছে। এদিকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, করোনা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক বিপজ্জনক অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আগামী ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি সম্প্রতি (২৫ আগস্ট) নবান্নে পাঁচ জেলার পর্যালোচনা বৈঠক করে জানান, ‘সেপ্টেম্বর মাসের ২০-২৫ তারিখের মধ্যেই কোভিড অনেকটাই সেটেলড হয়ে যাবে।’ বাস্তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও যেখানে করোনা সংক্রমণের প্রকোপ কবে কমবে, তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত কিছু জানাতে পারছে না, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর এমন অবাস্তব মন্তব্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আসলে করোনা মোকাবিলায় সরকারের যে বেসামাল অবস্থা তা নিয়ে এখন আর ভাবতে রাজি নয় মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকার। কারণ একটাই - দোড়গোড়ায় কড়া নাড়ছে আসন্ন বিধানসভার ভোট। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে দ্রুত হাসপাতাল থেকে সংক্রমিতদের ছুটি দিয়ে ‘বেড অকুপেন্সি’ কমিয়ে ‘ডিসচার্য রেট’ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জেলাশাসক ও মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের।
এই লক্ষ্য নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা ৪-৫দিন ধরে হাসপাতালে আছেন, কোনও কিছু নেই, তাঁদের রেখে দিয়ে কী লাভ? জোর করে যদি কেউ থাকতে চায়, তাদের বাড়িতে পাঠান।’ মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবকে দিয়েও বলিয়ে নেওয়া হয়েছে। এভাবে ডিসচার্য রেট বাড়িয়ে, টেস্ট কম হবার ফলে সংক্রমিতের সংখ্যা কমিয়ে সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখনোর বন্দোবস্ত করে নেয়। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই পর্যালোচনা বৈঠকেই স্পষ্ট হয়েছে, গত চারমাসে এ রাজ্যে কোনো কাজই করে উঠতে পারেনি প্রশাসন। কোভিড মোকাবিলা থেকে প্রশাসনিক অন্যান্য কাজকর্ম কিছুই হয়নি। এসবের নমুনা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তুলে ধরেন বৈঠকে। জেলাশাসক, সভাধিপতিদের উদ্দেশ্য করে তাঁকে বলতে শোনা যায় - ‘প্যান্ডেমিক দেখিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। কোনো কাজ করবো না। শুধু ঘুমিয়ে থাকি।’ আসলে সেদিনের বৈঠক থেকেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনের আধিকারিক থেকে দলের নেতা-মন্ত্রীদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাস থেকেই তিনি আবার জেলা সফরে বেরিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে অংশ নেবেন। লক্ষ্য একটাই - আগামী বিধানসভা নির্বাচন।
মুখ্যমন্ত্রীর এমন উদ্ভট চিন্তাভাবনা ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, সরকার করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ অবস্থাকেও অবলীলায় অবজ্ঞা করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্যত। এদিকে রাজ্যে করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবের প্রাথমিক পর্যায়ে রাজ্য সরকার যেমন এই মারাত্মক সংক্রমণে মৃত্যুর ঘটনাকে চাপা দিতে কোমর্বিডিটির তত্ত্ব হাজির করেছিল, তার মাস পাঁচেক পরেও সেই তত্ত্ব নিয়েই বিতর্কে ব্যস্ত। রাজ্যে করোনা পরীক্ষার হার বাড়ছে না। অ্যাম্বুলেন্স মিলছে না, ওয়েবসাইটে বেড খালি দেখালেও, (গত জুলাই মাস থেকে স্বাস্থ্য ভবনের তথ্যে বলা ছিল, সরকারি হাসপাতাল এবং সরকার অধিগৃহীত কোভিড হাসপাতালের মোট বেডের প্রায় ৬৭ শতাংশই নাকি খালি। এই সেপ্টেম্বরেও স্বাস্থ্যভবন জানাচ্ছে, খালি শয্যা সংখ্যা নাকি ৬৫ শতাংশ। দু’মাস পরেও একই চিত্র!) একের পর এক সরকারি হাসপাতাল ও সরকার অধিগৃহীত কোভিড হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরানোর ঘটনা ঘটে চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য আধিকারিকদের বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের নির্দেশিকা জারির পরেও বেসরকারি হাসপাতালগুলি আকাশছোঁয়া বিল নিচ্ছে, এছাড়া একের পর এক ঘটে চলেছে নানা মর্মান্তিক ঘটনা - এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রী ফের কোমর্বিডিটির তত্ত্ব এনে আসল ঘটনা চেপে দিতে চাইছেন। অথচ কোন্টা করোনায় মৃত্যু, আর কোন্টা কোমর্বিডিটিতে মৃত্যু - তা নিয়ে এপ্রিল মাসের গোড়ায় তথাকথিত ‘অডিট কমিটি’ গড়লেও সেই কমিটি কোথায় উধাও হয়ে গেলো, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। যেমন সরকারি কোষাগারের লক্ষ্য-অজুত টাকা খরচ করে বহু বিজ্ঞাপিত ‘গ্লোবাল কমিটি’রও এখন কোনো হদিশ নেই।
রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল কি হয়েছে, তা এই সময়কালের কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। যদিও খণ্ডচিত্র এবং সামগ্রিক বিচারে কয়েকটি মাত্র ঘটনা, তবুও রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বেহাল দশা, বিশেষ করে করোনা সংক্রমিতদের চিকিৎসা পাবার ক্ষেত্রে করুণ চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনা। সেখানে কোনো সাধারণ রোগী নন, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন স্বয়ং কোচবিহারের ডেপুটি সিএমওএইচ। এখানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত গাফিলতির অভিযোগ এনে নিজেই বন্ডে সই করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শহরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হন। জেলায় করোনা যোদ্ধা হিসাবে পরিচিত ডাঃ বিশ্বজিৎ রায়, ডেপুটি সিএমওএইচ। গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এই হাসপাতালে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, যেহেতু কোচবিহারে একটি অত্যাধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে, তাই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবা মিলবে। কিন্তু দু’দিন পেরোতে না পেরোতেই তাঁর বিশ্বাসভঙ্গ হয়। তাঁর অভিযোগ, তিনদিন ধরে কোনো চিকিৎসা হয়নি, কোনো ডাক্তারই দেখেননি তাঁকে। তিনদিন ধরে বারে বারে বলা সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষা করেনি। সাধারণ মানুষ কীভাবে পরিষেবা পাবেন এখানে?
এই ঘটনা প্রথম নয়, এর আগেও রোগী ও সাধারণ মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে অনেকবার অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু কোনোটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য পরিষেবার কঙ্কালসার চেহারা বেরিয়ে এসেছে।
এর পরের ঘটনা আলিপুরদুয়ারের। হাসপাতালে খাবার না মেলায় ক্ষুব্ধ কোভিড আক্রান্ত রোগী হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়েন। এর আগেও বারে বারে হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা থেকে খাবারের মান নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। ২৭ আগস্ট আলিপুরদুয়ার জেলার তপসিখাতা কোভিড হাসপাতালের এই ঘটনায় হাসপাতালের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সর্বশেষ এমন ঘটনা ঘটেছে ৮ সেপ্টেম্বর দীঘা-নন্দকুমার জাতীয় সড়কের কাঁথি শহরের রসুলপুর বাইপাস মোড়ে সঞ্জীবনী করোনা হাসপাতালে। এদিন খাবারের মান ও অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে রোগীরা রাস্তায় বেরিয়ে অভিযোগ জানান। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে ফিরিস্তি দিয়েছেন। কোভিড চিকিৎসা পরিষেবায় হাসপাতালগুলির মান নিয়ে বাগাড়ম্বর করেছেন। কোভিড হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা ও খাবারের মান নিয়ে গত কয়েক মাসে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে বিক্ষোভও হয়েছে কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলায়। এর আগে হাওড়ার জয়সওয়াল হাসপাতালে এক রোগীর একটি ভিডিয়ো নিয়েও ব্যাপক হইচই হয়েছে। এই ভিডিয়োটাতে এক রোগী হাসপাতালের বেহাল চিকিৎসা পরিষেবা ও খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন। কৃষ্ণনগর গ্লোবাল হাসপাতালেও নিম্নমানের খাবার ও বরাদ্দ ছেঁটে দেওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভ ও অনশনে শামিল হন রোগীরা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও নিরাপত্তারক্ষীদের সামনে করোনা আক্রান্ত রোগী প্রতিবাদ জানাতে ৬তলা থেকে নিচে নেমে আসেন বলে সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এই অভিযোগগুলির পাশাপাশি রাজ্যজুড়ে ডাক্তার, নার্সদের অপ্রতুলতা, তাঁদের উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই।
এরপরের মর্মান্তিক ঘটনা হলো দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সোনারপুরের চম্পাহাটির। এখানে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী মেঘনাদ নস্করের দেহ ঘরের মধ্যেই পড়ে থাকে দীর্ঘ সময়। বারবার তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় বিডিও এবং থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা সত্ত্বেও কোনো সাহায্য মেলেনি। শেষ পর্যন্ত ১৩ঘণ্টা পর তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়। কলকাতার টালিগঞ্জ কুঁদঘাটের বাসিন্দা পেশায় ইনটেরিয়র ডিজাইনার কৃষ্ণদাস সূত্রধরের প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। শুধু তাই নয়, কোভিড আক্রান্ত এই রোগীর মৃত্যুর তিনদিন পর তাঁর স্ত্রীকে জানান মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। ২৫ জুলাই হৃদযন্ত্রের সমস্যার জন্য তাঁকে এনআরএস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর করোনা পরীক্ষায় তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তারপর তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে রেফা করা হয়। কিন্তু দিনের পর দিন তাঁকে চিকিৎসা না করেই ফেলে রাখা হয়। এভাবে ৩৪দিন চলার পর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জানানো হয়, রোগীর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাঁকে সিসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর রোগীর আর কোনো খবর পাননি পরিবারের সদস্যরা। হেলপ লাইনে ফোন করলে জানানো হয়, এই নামে কোনো রোগী ভর্তি হয়নি। এর কয়েকদিন পর তাঁরা জানতে পারেন, রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এমন মর্মান্তিক ঘটনার পর মৃতের স্ত্রী অভিযোগ করেন, হাসপাতালই তাঁর স্বামীকে মেরে ফেলেছে।
পরের একটি ঘটনা ধূপগুড়িতে। বিএসএফ-এর প্রাক্তন কর্মী সুবোধ রায়ের ২৪ বছরের কন্যা জ্বর-সর্দির উপসর্গ নিয়ে কয়েকদিন ভোগার পর ২ সেপ্টেম্বর তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। ভর্তি করার পরই জানানো হয় রোগী করোনা পজিটিভ। তার কয়েকঘণ্টা পরই মৃত্যু হয় রোগীর। তারপর কোভিড প্রোটোকল মেনেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এর ২৪ঘণ্টা পর মৃতার বাবাকে জানানো হয় রোগীর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুল রিপোর্টের জন্য কন্যার শেষকৃত্য করতে পারলেন না অসহায় বাবা-মা। স্বাভাবিক কারণেই কর্তৃপক্ষের এই উদাসীনতা ও অবহেলার জন্য এলাকার মানুষ বিক্ষোভ দেখান।
কলকাতার নাগেরবাজারে পেশায় রিকশাচালক সুনীল পালের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল গত ১৭ মে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুল পরামর্শে মৃত্যুর চারমাস পরেও ডেথ সার্টিফিকেট পায়নি মৃতের পরিবার। টাইফয়েড আক্রান্ত এই রোগীকে আরজিকর হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর চিকিৎসকরা রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন। সেই রোগীর মৃত্যুর পর করোনা আক্রান্ত রোগীর সাথে নাকি রাখা হয়েছিল। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতের ছেলেকে বলেছিল, ওই মরদেহ নিলে সবাই আক্রান্ত হবে। তাই তারাই মরদেহের সৎকার করে দেবে। পনেরো দিন বাদে তপসিয়া হিন্দু কবরস্থান থেকে মৃত্যুর শংসাপত্র পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরামর্শ মতোই কাগজে সই করে গত চারমাস ধরে ব্যাপক ঘোরাঘুরি সত্ত্বেও মৃত্যুর শংসাপত্র মেলেনি। এভাবেই প্রশাসনিক জটিলতায় ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এনআরএস হাসপাতালে। এখানে ৬ সেপ্টেম্বর কোভিড ওয়ার্ডের শৌচাগারেই আত্মঘাতী হন কাকদ্বীপের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী রাজকুমার বেরা। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় মানসিক অবসাদেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সহ আরও কয়েকটি জায়গায় আত্মহত্যার চেষ্টা ও আত্মঘাতী হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক অবসাদ নেমে আসে। তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া, সামাজিক বয়কট করার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে রাজ্যে। কলকাতা সংলগ্ন কেষ্টপুরে সম্প্রতি করোনা আক্রান্তের বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দেয় প্রতিবেশীরা। এসব ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সরকারের প্রশাসন পরিচালনায় সার্বিক ব্যর্থতার ফলেই এই সমস্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
এছাড়া বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা, মুমূর্ষু রোগীর হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে হাসপাতালের সামনে রাস্তায় পড়ে থাকা, হাসপাতালের সামনে প্রসূতি মায়ের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা, অ্যাম্বুলেন্স ও মৃতদেহবাহী গাড়ির অস্বাভাবিক চড়াহারে ভাড়া চাওয়ার মতো ভয়াবহ অমানবিক দৃশ্য প্রতিমুহূর্তে ঘটছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। এখানে উল্লেখিত কয়েকটি ঘটনা তার সামান্য আভাসমাত্র। কিন্তু বিস্ময়ের যে, এই সমস্ত অমানবিকতা, মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলা সত্ত্বেও কারও কোনো হেলদোল নেই! রাজ্য সরকার, প্রশাসন উদাসীন-নির্বিকার। উলটে মুখ্যমন্ত্রীর জাঁকজমক করে সংবাদমাধ্যমে নিজের কাজের ফিরিস্তি দিতে, সাফল্যের ঢাক পেটাতে কোনো খামতি নেই।
আসল ঘটনা হলো, সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করা, তাঁদের স্বার্থে পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেবার কোনো সদর্থক ভাবনা নেই সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর। কোনোদিনই ছিল না। তাদের দৃষ্টি এখন আগামী বিধানসভায় ভোটের দিকে। তাই করোনার ভয়াবহ প্রকোপকে খাটো করে দেখানোর সর্বতো চেষ্টা চলছে সরকারের তরফে। এ সব কিছু হচ্ছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে।
মানুষ দেখেছেন, বিগত ৪-৫ মাস ধরে সরকার এবং শাসকদল করোনার দুঃসহ আবহে বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, শাসকদলের নেতা, মাতব্বররা নির্বিচারে দুর্গত মানুষদের ত্রাণ সামগ্রী লুট করেছে, আমফানে বিপর্যস্ত মানুষের জন্য ত্রাণ, সাহায্যের নামে প্রাপ্য অর্থ আত্মসাৎ করেছে। আবার এর বিপরীতে বামপন্থী কর্মীরা যখন নিজেদের সীমিত সাধ্যে রাজ্যের নানা প্রান্তে বিপন্ন মানুষদের ত্রাণ, খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ এবং কমিউনিটি কিচেনের ব্যবস্থা করে অসহায় মানুষদের সাহায্যের ব্যবস্থা করছে, তখন শাসকদলের দুর্বৃত্তরা নানা জায়গায় এই কাজে বাধাদান করেছে। বামপন্থী কর্মীদের আক্রমণ করেছে। অতি সম্প্রতি হাওড়ার বাঁকড়ায় সিপিআই (এম) আয়োজিত একটি রক্তদান শিবিরে হামলা চালিয়ে সংগৃহীত রক্ত নষ্ট করে দিয়েছে। ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মী ও আয়োজকদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করে নিষ্ঠুর বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। সম্প্রতি গড়বেতা ও কুলতলিতে সিপিআই(এম)’র নেতাদের উপর হিংস্র আক্রমণ করেছে তৃণমূল। এ সবের প্রতিবাদে সর্বত্র ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে।
এভাবেই এই সরকার এবং শাসকদল রাজ্যবাসীর সাথে অমানবিক আচরণ ও তঞ্চকতা করে চলেছে। মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। সরকারের উদাসীনতায় ফড়েদের দৌরাত্ম্যে শাকসবজি সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এদের শাসনে রাজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজ ব্যর্থতার ছবি প্রকট হয়ে উঠেছে। গোটা তৃণমূল দল দুর্নীতি ও কলঙ্কের কালিমায় ঢাকা পড়েছে। আজ রাজ্যের বাস্তব চিত্র এটাই. প্রতিবাদে মানুষের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে। প্রতিবাদী মানুষ সমবেত হয়ে রাস্তায় নামছেন। তাই অবস্থা বেসামাল বুঝে মানুষকে বিপন্নতার মধ্যে ফেলে সরকার ও শাসকদল এখন নিজেদের ‘ভাবমূর্তি’ উদ্ধারে মত্ত হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে নানা সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে এবং প্রশান্ত কিশোরের কর্পোরেট দালালদের মাধ্যমে তারা পরিত্রাণের পথ খুঁজছে। এদের বিরুদ্ধে মানুষও সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। রাজ্যজুড়ে লালঝান্ডার মিছিল-সমাবেশে, মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভে প্রতিবাদের স্বর ক্রমশ তীব্র হচ্ছে।