৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯
দেশহিতৈষী’র ৬০ বছরে পদার্পণকে সামনে রেখে
অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়
দেশহিতৈষী’র প্রয়াত দুই সম্পাদককে প্রণাম...
মোহিত মৈত্র
বছরের সব দিন ইতিহাসে স্বাক্ষর রেখে যায় না। যে সব দিন বৈশিষ্ট্য বর্জিত তারা ক্যালেন্ডারের পাতায় রেখে যায় শুধু তাদের আসা-যাওয়ার চরণচিহ্ন। আর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিনগুলি ইতিহাসের পাতায় নিজেদের স্থান করে নেয়। আমাদের কাছে ১৬ আগস্ট এমনই এক স্মরণীয় দিন। আজ থেকে ৫৯ বছর আগে, ১৯৬৩ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনে তীব্র মতাদর্শগত ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়কাল এবং জাতীয় ক্ষেত্রে জনজীবনে তীব্র সঙ্কটের পটভূমিকায় দেশ ও জাতির একান্ত প্রয়োজনে সংবাদপত্র জগতে দেশহিতৈষী’র আবির্ভাব ঘটেছিল। এবছরের ১৬ আগস্ট মতাদর্শগত সংগ্রাম এবং জনগণের বাঁচার সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দেশহিতৈষী গৌরবোজ্জ্বল ৬০ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। রাজ্যের জনগণের চলমান সংগ্রামের ইতিবৃত্ত বহন করে চলেছে দেশহিতৈষী। কমরেড লেনিনের নির্দেশ মতো দেশহিতৈষী পার্টির প্রচারক এবং সংগঠকের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে গেছে।
সুধাংশু দাশগুপ্ত
এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনার কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য দেশহিতৈষী’র অগণিত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সর্বস্তরের পার্টি প্রচারক এবং সংগঠকদের - যাঁদের ভালোবাসা, পার্টি এবং আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতা ব্যতীত এই ইতিহাস রচনা সম্ভব হতো না। রোদ-জল-ঝড়কে উপেক্ষা করেই শুধু নয়, শাসকশ্রেণির রক্তচক্ষু শাসকদের ভয়াবহ অত্যাচার, সন্ত্রাসকে পরাস্ত করে এই সংগঠক এবং প্রচারক কমরেডবৃন্দ আদর্শের তাড়নায় এই ইতিহাস রচনা করেছেন।
দেশহিতৈষী’র জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের কমিউনিস্ট বিপ্লবী পূর্বসূরীরা রাষ্ট্র এবং শাসকশ্রেণির নির্যাতন-অত্যাচারকে তুচ্ছ করে আদর্শে অবিচল থেকে পার্টির মতাদর্শগত অবস্থান, বিপ্লবী লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সুদৃঢ় করে গেছেন। শ্রমজীবী জনগণের লড়াই-সংগ্রাম, সংগঠনের সাথী হয়ে পথ চলায় সাহস ও প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন, আমাদের পথ নির্দেশ করেছেন তাঁদের সকলকে এই সন্ধিক্ষণে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য।
দেশহিতৈষী তার জন্ম-লগ্নেই ঘোষণা করেছিলঃ ‘‘দেশহিতৈষী’র পবিত্র সংকল্প দেশহিতৈষণা। আমরা জানি আমাদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এও জানি যে দুর্গম দুস্তর এই পথে বাধা অসংখ্য। বিপত্তিও প্রচুর। তবু নিজেদের আদর্শে অবিচল নিষ্ঠা আর সাধারণ মানুষের উপর সুগভীর বিশ্বাস - এই অসামান্য পাথেয়কে সম্বল করিয়া আমরা কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি।’’
আরও ঘোষণা করা হয়েছিলঃ ‘‘দেশের এই চরম দুর্দিনে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফা লালসাকে প্রতিহত করা, জনগণের জীবনের মানকে উন্নত করা এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে অক্ষুণ্ণ রাখাই দেশহিতৈষী’র ব্রত ও সাধনা।’’
দেশ স্বাধীন হবার ৭৫ বছর পরে বর্তমান সময়ে আমরা দেখছি, দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব চরম বিপদের সম্মুখীন, লগ্নি-পুঁজি ও একচেটিয়া করপোরেট পুঁজির মুনাফা লালসা সীমাহীন হয়ে উঠেছে, জনগণের জীবনমানের চরম অবনতি ঘটেছে; দারিদ্র্য, বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। সংবিধানগত গণতন্ত্র খর্বিত হয়ে ধ্বংসের পথে পরিচালিত হচ্ছে, দানবিক স্বৈরতন্ত্রের কালো ছায়া ক্রমশই দেশ ও জনগণকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
২৩তম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ফ্যাসিপন্থী আরএসএস’র হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িক কর্মসূচিকেই আগ্রাসীভাবে অনুসরণ করে চলেছে। আরও বলা হয়েছে, কেন্দ্রের বর্তমান সরকার জঘন্য ক্ষতিকর নয়া-উদারবাদী সংস্কারসমূহ অনুসরণ করে বহুমুখী আক্রমণ সংঘটিত করে চলেছে - যার সাহায্যে সাম্প্রদায়িক-করপোরেট দুষ্ট-চক্র, জাতীয় সম্পদের লুণ্ঠন, লুটেরা পুঁজিবাদের রমরমা, রাজনৈতিক দুর্নীতির বৈধকরণ এবং সর্বগ্রাসী স্বৈরতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে চলেছে।
তাই, জন্মলগ্নেই দেশহিতৈষী যে ব্রত ও সাধনা ঘোষণা করেছিল তার থেকে সরে আসার, তাতে শিথিলতা দেখানোর এতটুকুও কারণ ও অবকাশ নেই। বরং আরও দৃঢ়চিত্তে, আরও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সেই ব্রত ও সাধনায় আমাদের নিমগ্ন হতে হবে। গণতন্ত্র রক্ষায়, সংবিধান রক্ষায় জনগণের যে সংগ্রাম ক্রমশ জোরদার হয়ে উদ্বেলিত হবে তাকে ভাষা দিতে, সেই সংগ্রামের সাথী হতে দেশহিতৈষী নিজেকে উপযুক্ত করে চলবে।
রাজ্যে বিগত এগারো বছর এক দুঃসহ দুঃশাসনের বোঝা জনগণের কাঁধে চেপে বসে আছে। চরম স্বেচ্ছাচারী, নীতি নৈতিকতা বর্জিত, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এক সরকারের যাঁতাকলে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে, জীবন ওষ্ঠাগত। শিক্ষা-সংস্কৃতি জগৎ অবাধ দুর্নীতির মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠে রাজ্যের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকারের যাবতীয় সাফল্য যা নতুন দিশা দেখিয়ে রাজ্যের সাধারণ শ্রমজীবী জনগণকে স্বস্তি দিয়েছিল, তাদের মর্যাদা ও অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, বিনষ্ট হয়ে যাওয়া শিক্ষা-সংস্কৃতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল, বর্তমান অপশাসনে সেই সব কিছুই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
এর বিরুদ্ধে রাজ্যে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব সহ সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষের যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলন-সংগ্রাম সোচ্চারিত হচ্ছে, দেশহিতৈষী তাকে তুলে ধরার, সেই সংগ্রামের পাশে থাকার সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। এই অপশাসনের অবসান ঘটাতে দেশহিতৈষী’র পাতা মুখর থাকবে।
দেশহিতৈষী’র ব্রত অক্ষুণ্ণ রেখেই মেহনতি মানুষের মুখপত্র হয়ে শ্রেণিসংগ্রামের পতাকা ঊর্ধ্বেতুলে ধরেই বিগত ৫৯ বছর দেশহিতৈষী তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করায় সচেষ্ট থেকেছে। পার্টির মুখপত্র হিসাবে দেশহিতৈষী পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্য অগণিত পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যায়। যে সংস্কৃতি মানুষকে চেতনাসমৃদ্ধ করে সমাজ-সচেতন হতে, দুনিয়াটাকে পাল্টে দেবার লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে, দেশহিতৈষী সেই সংস্কৃতির বাহক হবার চেষ্টা অব্যহত রেখে চলেছে।
সুর্দীর্ঘ পথ চলার ইতিহাসে দেশহিতৈষী’কে বারে বারে বাধা ও আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। হঠকারীদের আক্রমণ ছাড়াও বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস ও জরুরি অবস্থার শাসনের দিনগুলির মোকাবিলা করেই দেশহিতৈষী’কে অগ্রসর হতে হয়েছে। আধা-ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়েছে দেশহিতৈষী’র পাঠক, সংগঠক এবং প্রচারকদের। কিন্তু সেই সন্ত্রাস, আক্রমণকে উপেক্ষা করেই গ্রাম-গ্রামান্তরে, শহরে-বস্তিতে, কারখানার গেটে পৌঁছে যেত দেশহিতৈষী। এ আমাদের গর্বের ইতিহাস। ইতিহাস প্রবাহিত হয় উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়ের পথ ধরে। সেই ধারায় সমাজতন্ত্রের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। শ্রেণিসংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গশীর্ষে সেই জয় আসবেই। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। সেই যাত্রাপথের সঙ্গী থাকবে দেশহিতৈষী। ৬০ বছরে পদার্পণের মুহূর্তে সেই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হোক।
দেশহিতৈষী’কে হয়ে উঠতে হবে কাকাবাবু যেমন চেয়েছিলেন, ‘‘সত্যই মেহনতি মানুষের মুখপত্র’’।