৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯
স্বাধীনতার ৭৫ বছর মনে রেখে
বিমান বসু
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস প্রায় দুশো বছরের। ঐতিহাসিকদের বিচার বিশ্লেষণ অনুযায়ী ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। সিপাহী বিদ্রোহের আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্রিটিশের শোষণ অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে খণ্ডিকৃত বিদ্রোহের মশাল জ্বলে উঠেছিল। যার অন্যতম আদিবাসীদের সাঁওতাল বিদ্রোহ। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়। এই জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামে গতিবেগ বৃদ্ধি করতে দেশের মানুষ নানা কর্মসূচিতে যুক্ত হতেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছিল কমিউনিস্টরা। তাঁরা তাঁদের ভূমিকা পালনের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে নির্দিষ্টভাবে ছাপ ফেলতে শুরু করে। ১৯২০ সালে প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পর থেকে মার্কসীয় দর্শনের ভিত্তিতে লেনিনীয় প্রয়োগ নীতিকে মান্য করে দেশে শ্রমিক-কৃষক সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করে। শ্রমিকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯২০-র শেষেরদিকে বোম্বেতে সর্বভারতীয় শ্রমিক সম্মেলনের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস। রাজ্যে রাজ্যে এই সংগঠনের মাধ্যমে সুতাকল,চটকল, রেলওয়ে, পোর্ট, কয়লা এবং চা বাগিচায় শ্রমিক সংগঠন প্রসারিত হতে শুরু করে। পরবর্তীতে গড়ে ওঠে রাজ্যে রাজ্যে কৃষক সংগঠন। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ১৯৩৬ সালে সারা ভারত কৃষক সভা এবং একইসাথে নিখিল ভারত ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে লক্ষ্মৌয়ে। এইভাবেই সংগঠিতভাবে শ্রমিক-কৃষক, ছাত্রযুবদের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত করে সংগ্রামের মধ্যদিয়ে কমিউনিস্ট হয়ে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি দেশে গড়ে ওঠার সময় থেকেই পার্টিতে সিদ্ধান্ত ছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামের সাধারণ মঞ্চ হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত থেকে এবং প্রয়োজনে জাতীয় কংগ্রেসের কর্মকর্তা হয়েও স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যাপকভিত্তিতে সংগঠিত করতে হবে।
১৯২০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পরের বছরই ১৯২১ সালে আমেদাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬ তম অধিবেশনে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে মৌলানা হজরত মোহানি পূর্ণ স্বরাজের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। এরপর ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সমস্ত কংগ্রেসের অধিবেশনে কমিউনিস্টরা পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। কিন্তু প্রতিবার জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব প্রস্তাব খারিজ করেছেন। এরপর কারুর প্রশ্ন করা উচিত নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে। যদিও কমিউনিস্টদের উত্থাপিত পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব কংগ্রেস গ্রহণ করে ১৯২৯ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত তাদের সর্বভারতীয় অধিবেশনে।
বিভিন্ন সময় কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সামনে নানা কর্মসূচি উত্থাপন করে একদিকে পার্টিগত কর্মসূচি পালন করেছে এবং জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাতলে স্বাধীনতার লড়াই পরিচালনা করেছে। যার অন্যতম ছিল পূর্ণ স্বরাজ। কমিউনিস্টরা বলেছিল, প্রথম লক্ষ্য স্বাধীনতা, কিন্তু আসল লক্ষ্য দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তাই জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি করা হয়েছে, আর কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকেই প্রথম ‘লাঙল যার জমি তার’ - এই দাবি করা হয়েছে। কারণ কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করে, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একই সূত্রে গাথা। শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষের দাবিগুলিকে ঘিরে ১৯২৭-২৮ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে বিশাল বিশাল ধর্মঘটগুলি সংগঠিত হয়েছিল সেগুলিতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল কমিউনিস্টরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বোম্বাইয়ের সুতাকল, বাংলার চটকল এবং রেলশ্রমিকদের ধর্মঘট। এই প্রেক্ষাপটে ১৯২৮ সালে কলকাতায় পার্ক সার্কাসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের দাবি নিয়ে এক বিশাল শ্রমিক মিছিল সংগঠিত হয়েছিল।এই মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ, কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। এআইসিসি’র অধিবেশনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পক্ষ থেকে সুভাষ বসু অধিবেশনের বাইরে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এবং আশ্বস্ত করেন অধিবেশনে বিষয়টি জানাবেন। তিনি শ্রমিকদের এও বলেন যে, তাদের মিছিল স্বাধীনতা সংগ্রামকে পুষ্ট করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে এটাও একটা অধ্যায়।
১৯৩০ থেকে ৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সারা ভারত কৃষক সভার নেতৃত্বে বাংলা বিহার, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানায় সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রাম উত্তাল তরঙ্গ তৈরি করেছিল। বাংলার তেভাগা আন্দোলনে দুর্জয় সংগ্রাম এই সময়কার ফসল। তেভাগার দাবির আন্দোলন বাংলায় জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে কৃষক সংগ্রামে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। অন্যান্য রাজ্যে কৃষক সংগ্রামও বিশেষ করে তেলেঙ্গানায় সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার বিরোধী আন্দোলন কৃষক আন্দোলনে এক নতুন দিক সূচিত করেছিল। এই আন্দোলন সংগ্রামগুলির মধ্যদিয়েই সারা দেশে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এক ব্যাপক আন্দোলনের ভিত গড়ে ওঠে। এই সময়ে কৃষক পরিবার থেকে ইংরেজদের সশস্ত্র বাহিনীতে যারা কাজে যুক্ত ছিলেন তাদের মনোজগৎও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনায় সমৃদ্ধ হয়। একদিকে ১৯৪৬ সালে ২৯ জুলাই সর্বভারতীয় ডাক-তার শ্রমিক-কর্মচারীদের ধর্মঘটের কর্মসূচি এবং তাঁদের ধর্মঘটের সমর্থনে অন্যান্য শ্রমিক-কর্মচারীদের সমর্থনে আন্দোলন-সংগ্রামের যে উত্তাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা ভারতবাসী দেখেছে। এইসব আন্দোলন-সংগ্রামের পিছনে ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। আবার লক্ষ্য করা গেছে, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর বিদ্রোহ। এইসব আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রেও কমিউনিস্ট পার্টি সবসময় পাশে থেকেছে।
বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ অধ্যায় সূচিত করেছিল ১৯০২ সালে গড়ে ওঠা অনুশীলন সমিতি ও ১৯০৫ সালের যুগান্তর গোষ্ঠী। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে বাংলাভাগের পরিকল্পনা, তাকে রুখে দেওয়ার আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকাকে গৌরবান্বিত করেছিল সদ্য গড়ে ওঠা অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর গোষ্ঠী। একেরপর এক বিপ্লববাদী কার্যকলাপ বাংলার তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হতে প্রত্যক্ষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ বিভেদের মধ্যে শাসনের চক্রান্তেরই অংশ ছিল বাংলাকে ভাগ করা। এর বিরুদ্ধে বাংলার লড়াই সংগ্রাম তীব্রতা লাভ করে এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ হতে শুরু করে। এই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা এক উজ্জ্বল অধ্যায়। একইসঙ্গে ১৯০৮ সালে ১১ আগস্ট কিশোর ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির দণ্ডাদেশ এবং হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে তাঁর জীবনদান বাংলাকে উদ্বেলিত করেছিল। উল্লেখ্য, বাংলার বিপ্লববাদী গোষ্ঠীর অনেক সদস্য পরবর্তীতে মত ও পথ পরিত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শকে গ্রহণ করে বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অগ্রসর করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, বিভিন্ন সংগ্রাম আন্দোলনে যুক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশের বিভিন্ন কারাগারে যেমন বন্দি করে রাখা হতো আবার তাঁদের অনেককেই আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি করে রাখা হতো। আমার সংগৃহীত একটি তালিকার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি। আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দিদের সংখ্যা একসময় ছিল ৬০০ জন। এই ৬০০ জনের মধ্যে মহারাষ্ট্রের ৩, পাঞ্জাবের ১০১, দিল্লির ২, যুক্তপ্রদেশের ২৭, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের ৩, বিহারের ১৯, মাদ্রাজের ২৫, অন্ধ্রপ্রদেশের ৫, ত্রিপুরার ৪, আসামের ৫ এবং বাংলার ৪০৬ জন ছিলেন। এই বন্দিদের এক বড়ো অংশ আন্দামান সেলুলার জেলে অবস্থানকালেই কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন। পরে তাঁদের অনেকেই মুক্ত হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। অনেকেই আবার পরবর্তীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র নেতৃত্বে অবস্থান করেছেন। যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীর নেতৃত্বে অবস্থান করেছেন তাঁদের তালিকা অনেক বড়ো। তাঁদের সকলের নাম উল্লেখ করে কে নেতৃত্বের কোন অবস্থানে ছিলেন তা না বললেও কমরেড সুধাংশু দাশগুপ্তের নাম উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি কারণ তিনি একসময়ে ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও এই পত্রিকার আমৃত্যু সম্পাদক।
১৯৪০-এর দশকে সারাদেশে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ইতিবাচক ভূমিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রমাদ গুণেছে তাই আপসের পথে ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে।
অন্য কোনো প্রসঙ্গে না যেয়েও স্বাধীনতার ৭৫ বছরে একথা বলা চলে, যে আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি তাদের পরিচালনায় ভারতীয় জনতা পার্টির হাতে ভারতের জনগণের জীবন-জীবিকা সংকটাপন্ন, তাই দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা জরুরি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের হাজার হাজার শহিদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এই লেখা শেষ করছি।