৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯
স্বাধীনতার ৭৫ বছরঃ রাষ্ট্র, পুঁজি ও শিল্প
ঈশিতা মুখার্জি
আমাদের দেশ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত হয়েছে ৭৫ বছর পার হয়ে গেল। এই কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতির রাজনীতি কীভাবে পরিবর্তিত হলো এবং কোন আর্থিক পরিণতিতে আজ দেশ এসে পৌঁছেছে, তা এই লেখার আলোচ্য বিষয়। যে পথে দেশের অর্থনীতি এগিয়েছে তা হলো প্রথম অধ্যায়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা-নির্ভর স্বনির্ভরতার পথ। এই পথে চলতে চলতেই চলে এলো নয়া উদারীকরণ। অবশ্য নয়া উদারীকরণ হঠাৎ এসে পড়েনি আমাদের দেশে। তারও পরিপ্রেক্ষিত রচনা হচ্ছিল। ত্রিশ বছরের নয়া উদারীকরণ রূপান্তরিত হয়েছে বর্তমানে আগ্রাসী করপোরেট পুঁজিবাদে। এই রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিক্রমা বিভিন্ন সময়ে কৃষি, শিল্পের বিকাশে কতগুলি পর্যায়ক্রম সৃষ্টি করেছে। সেই পর্যায়গুলিই আলোচনা করা হবে এই লেখায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে উপনিবেশগুলি মুক্ত হলো সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে, তার মধ্যে আমাদের দেশ ছিল। তাই আমাদের দেশ কোন পথে চলবে - সে সম্পর্কে তিন রকমের পথ খোলা ছিল। এক, প্রথম বিশ্ব বা বাজার-নির্ভর পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থা; দুই, দ্বিতীয় বিশ্ব অর্থাৎ সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম; তৃতীয়, তৃতীয় বিশ্ব বা নতুন পথ খোঁজা। আমাদের দেশ রাষ্ট্র এবং বাজার মিলিয়ে মিশ্র অর্থনীতির পথে হাঁটা শুরু করলো। মিশ্র অর্থনীতির মধ্যে প্রথম থেকেই বাজার আর রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ছিল। অভিমুখ ছিল স্বনির্ভরতার দিকে। এই দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনের সাথে বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতির সমীকরণ যুক্ত হয়ে দেশের পথ স্থির হয়েছিল। টানাপোড়েনে ছিদ্র সৃষ্টি হয়। তাই নয়া উদারীকরণের পথ খুলতে অসুবিধা হয়নি।
আধা সামন্ততাত্রিক আধা পুঁজিবাদী দেশ যখন যাত্রা শুরু করে তার দিক নির্দেশ করে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অর্থনীতি। আমাদের দেশের রাষ্ট্র তখন এক সমাজবাদের কথা বলত, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ধাঁচা থেকে ধার নেওয়া। আমাদের দেশেও শুরু হলো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা - যখন রাষ্ট্রের উদ্যোগে ভারি শিল্প গঠনের কাজ হয়েছিল। এই পরিকল্পনার চিন্তা সবটাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পনার মডেলের আদলে। এই ধারণা তৈরি করে দিলেন প্রখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্ত মহলানবিশ সোভিয়েত অর্থনীতিবিদ ফেল্ডম্যানের মডেল অনুযায়ী। তাই এই পরিকল্পনা ছিল ফেল্ডম্যান-মহলানবিশ মডেল। এই মডেলে ভারি শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে অর্থাৎ বিশেষ করে লৌহ ইস্পাত শিল্পের উপর গুরুত্ব আরোপ করে শিল্পায়নের পথে হাঁটলো আমাদের দেশ। এই মডেলকে বিশ্বে নব্য মার্কসীয় মডেল বলা হয়। সীমিত বিনিয়োগের ক্ষমতাকে কীভাবে কৃষি, ভারি শিল্প, অন্যান্য শিল্প এবং পরিষেবার মধ্যে যথাযথভাবে বণ্টন করা হয়, তার সমাধান করা হলো গণিতের সাহায্যে। ভারি শিল্পের ভিত্তি না থাকলে স্বনির্ভরতার পথে হাঁটা সম্ভব হবে না - এরকম ধারণা তখন ছিল। এই পরিকল্পনার পরবর্তী অধ্যায়ে স্বাধীনোত্তর ভারতে আর কখনোই পরিকল্পনা করে বিনিয়োগের বণ্টন হয়নি। তাই ভারি শিল্প আমাদের দেশে যা তৈরি হয়েছে তার সিংহভাগই হয়েছে ওই সময়ে। ১৯৫০-১৯৬০ দশকে শিল্পক্ষেত্রে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে ৬.১ শতাংশ। ১৯৬০-৮০ সালের দুই দশকে এই হার কমে দাঁড়ায় ৪.৮ শতাংশ।
এই সময়ের পরই লক্ষ করা গেল যে, কৃষি এবং সেচব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমে গেছে ৩৪.৬ শতাংশ থেকে ১৭.৫ শতাংশে। ১৯৬০-এর দশকে শুরু হলো সবুজ বিপ্লব কৃষি উৎপাদনের কথা মাথায় রেখে। পরিকল্পনার শুরু হয়েছিল আর্থিক স্বনির্ভরতার কথা ভেবে। এই স্বনির্ভরতা তাকিয়ে ছিল দেশের অভ্যন্তরে চাহিদার দিকে। আমদানিকে গুরুত্ব না দিয়ে রপ্তানির দিকে না তাকিয়ে বাজার খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল। আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জমির মালিক, পুঁজিপতিদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। শিল্পে উন্নতি হলেও, কৃষির উপরেই জনসংখ্যার বিপুল অংশ নির্ভরশীল রয়ে গেল। কৃষি থেকে শিল্পে শ্রমজীবী মানুষের চলে আসা আশানুরূপ ভাবে হলো না। আমদানি পণ্যের প্রতিস্থাপন শিল্প তেমনভাবে এখানে প্রতিষ্ঠা করা গেল না রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সাহায্যে। ক্রমেই দেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়লো বৈদেশিক সাহায্যের উপর। কিন্তু কোনোভাবেই কৃষিক্ষেত্রে দেশের অধিকাংশ পরিবারের আর্থিক নির্ভরতা কমল না। ১৯৭১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী প্রায় ৭০শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভর করতেন। অথচ শিল্পোৎদপাদন বৃদ্ধির হার কৃষি উৎপাদনের হারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এই সময়ে। শিল্পে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিনিয়োগ নিয়োজিত হয়েছিল এই সময়ে। বলা যেতে পারে প্রাক্-উদারীকরণ যুগে শিল্প বিকাশের জন্য দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের।
পুঁজির কেন্দ্রীভবন হতে শুরু করে এই সময়ে। ১৯৭৬ সালে ২০টি ব্যবসা গোষ্ঠী বেসরকারি কর্পোরেট ক্ষেত্রের দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদনের মূলধন নিয়ন্ত্রণ করত। এই বৃহৎ পুঁজিপতিদের উপর দেশের সরকার ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দিল এবং এদের একাধিপত্য বেড়ে গেল। দেশের পরিকল্পনা ব্যবস্থা জনকল্যাণের রূপ নিলেও বৃহৎ পুঁজিপতিদের কর ছাড়ের দিকটাও প্রতি বাজেটে দেখা যেতে লাগল। প্রত্যক্ষ করের অংশ ছাপিয়ে উঠল পরোক্ষ কর। ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ঘটলেও উৎপাদনের এই অসম বিকাশ কর্মসংস্থানের বাধা হয়ে দাঁড়াল। পরিকল্পনা, মিশ্র অর্থনীতির ছিদ্রপথ কোন দিকে মোড় নেবে তার সবটুকুই নির্ভর করে বিভিন্ন শ্রেণির চরিত্র এবং তাদের অবস্থানের উপর। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, চিন্তাবিদ ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ ভারতীয় পরিকল্পনার সংকট বইতে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন যে, জাতীয় পুঁজিপতিরা আমাদের দেশে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ছিল। তাই তারা বলিষ্ঠ ছিল এবং এই ভাবেই দেশের পরিকল্পনাকেও ধীরে ধীরে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। কৃষক-শ্রমিকশ্রেণি সেভাবে পরিকল্পনার ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থাকলেও রাজনৈতিক অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ন্ত্রণে বৃহৎ পুঁজিপতিদের প্রভাব অনেক বেশি ছিল। বিশ্বের অর্থনীতিতেও এই সময়ে নানা পরিবর্তন এসেছে। ভূগোল প্রাচ্য পাশ্চাত্য বিভাজন থেকে উত্তর-দক্ষিণ গোলার্ধের বিভাজন শুরু করল। বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ-নির্ভর অর্থনীতি কায়েম করল আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা। পুরনো ধারণা বদলে চলে এলো রপ্তানি নির্ভর উৎপাদন পরিকল্পনা। আমদানির প্রতিস্থাপন নীতি ত্যাগ করল সরকার। বিশ্বের বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় ১৯৭৩ সালে এই বিদেশ নীতি গ্রহণ করে সরকার। ১৯৮১ সালে দেশ আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার থেকে ঋণ নিল এই অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য। এই সব নীতি গ্রহণের ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব শুধু ক্ষুণ্ণ হলো তাই না, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির কাছে দেশকে সঁপে দেওয়ার আগের ধাপ তৈরি হলো।
আক্ষরিক অর্থে ঘোষণা করে ১৯৯১ সালে ভারতে নয়া উদারীকরণ নীতি চালু করলেও উল্লিখিত পরিপ্রেক্ষিত এই নীতি গ্রহণ করা সহজ করে দিয়েছিল। ১৯৮৫ সালে একটি প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ অমিয় বাগচী বলেন যে, ভারতের অর্থনীতিকে হাইজ্যাক করা হচ্ছে। ১৯৯১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির বিপুল পরিমাণ নয়া উদারীকরণের পথ প্রশস্ত করে দিল। নয়া উদারীকরণের মূল মন্ত্র ছিল বেসরকারিকরণ। উদার বাণিজ্যও ছিল আরেক মন্ত্র। পরিকল্পনা চলতে লাগল এই নীতির সাথে তাল মিলিয়ে। ১৯৯২ সালে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হলো। এই সময় থেকেই পরিকল্পনার কাঠামোর চরিত্র, আর্থিক বাজেটের চরিত্র বদল হতে শুরু করে দিল। নয়া উদারীকরণের সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে, শিল্পের বিকাশ হবে, বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে, এরকম আশা রাষ্ট্র এবং দেশের পুঁজিপতিদের থাকলেও পরিসংখ্যান অন্য কথা বলে। ১৯৯১ -১৯৯৩ সালে শিল্পোৎদপাদন বৃদ্ধির হার কমে গেল। ১৯৯৪ সালে তা আবার কিছুটা বাড়তে শুরু করল। এই সময়ে শিল্পে কারখানাজাত পণ্যের উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪ শতাংশ, অথচ ১৯৮০তে তা ছিল ৮.২ শতাংশ। মূলধনি পণ্যের উৎপাদন কমে গেল; ভোগপণ্যের উৎপাদন বেড়ে গেল। ১৯৯১-১৯৯৯ বিদ্যুৎ পণ্যের উৎপাদন ৬.৭ শতাংশ কমে গেল। ১৯৯৭-২০১১ এই সময়ে কৃষিক্ষেত্রের চেয়ে অকৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন বেশি হারে বেড়েছে। কিন্তু অকৃষিক্ষেত্রের উৎপাদনের মধ্যে পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধি কারখানাজাত পণ্যের বৃদ্ধির চেয়ে বেশি। ২০০৮-এ শিল্পে কারখানাজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি কিছুটা হলেও তা পড়তে শুরু করে তার পরেই। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া কোনো পুঁজিবাদী দেশেও শিল্পোৎদপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। ভারতের এই কমজোরি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উদারীকরণের সময়ে তাই শিল্পে বৃদ্ধির হার সম্ভব হয়নি। ১৯৯৫ সালের পর ক্রমাগতই শিল্পে উৎপাদনের হার কমতে শুরু করে। বিদ্যুতে উৎপাদন কমে, কৃষিতে আর্থিক বিপন্নতা শিল্পপণ্যের চাহিদা কমিয়ে দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার সংকুচিত করে। রপ্তানির সুযোগও সেভাবে বাড়ল না। ১৯৯৯-২০০০ সালে শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৬.৭ শতাংশ হলেও ২০০০-২০০১ সালে তা নেমে হল ৫ শতাংশ। একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে গেল।
নয়া উদারীকরণের ত্রিশ বছরে ভারতে বিনিয়োগ বাড়েনি; সেভাবে আসেনি বিদেশি বিনিয়োগ। পুঁজির পুঞ্জীভবন আমাদের মতো দেশে হয়নি। শিল্পের জন্য এই পুঞ্জীভবন প্রয়োজন ছিল, যা ভীষণ ভাবে কমে গেল নয়া-উদারীকরণের বছরগুলিতে। বহু দেশ নয়া-উদারীকরণের অধ্যায়ে অগ্রাধিকার দিয়েছিল কারখানাজাত শিল্পোৎপাদনের উপর। আমাদের দেশ পরিষেবার উপর জোর দিল; যা স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি এনে দিলেও শিল্পে উন্নতি আনতে সক্ষম হলো না। পরিষেবার ভিত্তি ছিল আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি যা বেশির ভাগটাই আমাদের দেশে ফাটকা পুঁজির রূপ নিয়েছিল। আর এর ভিত্তি ছিল ব্যবসায়ী পুঁজি। এই ফাঁক দিয়ে লগ্নি পুঁজি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার মাধ্যমে পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রবেশ করল এবং ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের বিকল্প হয়ে দাঁড়াল। বাণিজ্য-পরিবহণেও পরিষেবা ক্ষেত্র ছিল, কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বৃদ্ধির হারে শ্লথগতি লক্ষ করা গেল। কোনোভাবেই শিল্পোৎদপাদনকে নয়া উদারীকরণের ফলাফল বলে আমাদের দেশে বলা যায় না। নয়া-উদারীকরণের ত্রিশ বছরে ঘটেছে ভোগপণ্যের বিস্ফোরণ। এই পণ্যের জোগান দেশি-বিদেশি মিলিয়ে। কোনোভাবেই নয়া উদারীকরণ বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেনি এবং শিল্পে স্থায়ী বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা দেখাতে পারেনি। বিদেশি বিনিয়োগের যে বৃদ্ধির আশা দেখিয়েছিল নয়া-উদারীকরণ তা দেখা যায়নি।
নয়া-উদারীকরণের পথ ধীরে ধীরে বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে সক্ষম ছিল না। আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একই জায়গায় থাকল না। আগ্রাসী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সেই স্থানে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করল। জাতীয় পুঁজি নয়া-উদারীকরণের সময়েই তার চরিত্র বদলেছিল। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং একত্রীকরণ বা একস্থানে নিবিড় হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। নয়া-উদারীকরণের পথেই অতি দক্ষিণপন্থী আগ্রাসী লুঠেরা পুঁজিবাদের জন্ম। আগ্রাসী পুঁজিবাদ আধিপত্য বিস্তার করে রাজনৈতিক ভিত্তির উপর। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তা হিন্দুত্ব এবং ধর্ম, জাতপাতের বিভিন্নতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার ভিত্তিতে বেড়ে উঠেছে। ২০১৩ সালে হায়দরাবাদে সুন্দরাইয়া বিজ্ঞান কেন্দ্রে কমিউনিস্ট নেতা, তাত্ত্বিক পি সুন্দরাইয়ার জন্ম শতবার্ষিকীতে আলোচনাসভায় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আইজাজ আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই করপোরেট আর্থিক পুঁজি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিল। তাঁদের প্রয়োজনে মৌলবাদী ফ্যাসিস্ট মনোভাবাপন্ন নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করার সবরকম চেষ্টা তারা করছে। তাদের প্রয়োজন এক ফ্যাসিবাদের পরিমণ্ডল, তাদের প্রয়োজন গণতন্ত্রের অবলুপ্তি। তাই ২০১৪ সালের পর উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান শুধু নয়, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ এবং ফ্যাসিবাদের পরিবেশ করপোরেট পুঁজির আগ্রাসনের ফল বলা যেতে পারে। ২০১৪ সালের পর যে অর্থনীতি আমাদের দেশে বিজেপি-আরএসএস সরকার নিয়ে এলো তার অভিমুখ পুরোপুরিভাবে করপোরেট পুঁজির স্বার্থে। রাষ্ট্রের আর্থিক কাঠামোকে একেবারেই ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে এই সরকার। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ইতি ঘোষণা করা হলো। তার বদলে এলো নীতি আয়োগ - যার কার্যকারিতা কী তা স্পষ্টভাবে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়নি। সরকারি সম্পত্তির হয়ে চলেছে বেসরকারিকরণ। বাজেট পেশ করা হয় কিন্তু সরকারি ব্যয় কোনো জনকল্যাণের পথ প্রশস্ত করে না। সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রভাব সম্প্রসারিত করার জন্য, তার বাজার এবং মুনাফা বাড়ানোর জন্য বাজেট পেশ করে।
২০১৪ সালের পর থেকেই তাই দেশে শিল্পে মন্দা ঘনীভূত হলো, বেকারি রেকর্ড সীমায় পৌঁছালো এবং বৃহৎ, অতি বৃহৎ পুঁজি আম্বানি-আদানিরা আরও অনেকের সাথে প্রতিষ্ঠিত হলো। সাধারণ মানুষের আয় কমে গেল এবং এর ফলে ভোগপণ্যের চাহিদা বাড়ল না। অতিমারীর ফলে চাহিদা-জোগান উভয় সাঁড়াশির চাপে শিল্পে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিল। ২০১৪ সালেই দেশে শিল্পোৎদপাদনের সূচক বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হলো অর্থাৎ উৎপাদন কমতে থাকল। কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শ্রমিকদের মজুরি নিম্নমুখী, দেশে আর্থিক বৈষম্যের চেহারা প্রতিদিন বুঝিয়ে দিচ্ছে দেশে দুটি দুনিয়া তৈরি হয়ে গেছে অতি-ধনী, ধনী - এর বিপরীতে আমজনতা। আমজনতার অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো দায় রাষ্ট্র নেবে না। তাই শিল্পক্ষেত্রের চরিত্র বদল হচ্ছে। লুঠ হচ্ছে দেশের পুঁজি, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পুঞ্জীভবন, কর্পোরেটের মুনাফার রাষ্ট্রশক্তিকে আগ্রাসন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭৫ বছর পর আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আগ্রাসী পুঁজি আর জনকল্যাণ। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, রাষ্ট্রের চরিত্র কোনদিকে যাবে তা এই দুই শক্তির দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি নির্ণয় করবে। শিল্পে উন্নয়নের শ্রেণি অভিমুখ আছে। সেই অভিমুখ স্থির করবে এই দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি। ৭৫ বছরে এই দ্বন্দ্ব এত মুখোমুখি কখনো আসেনি। তাই আগামীদিন প্রত্যাশার বার্তাই নিয়ে আসছে সাধারণ দেশবাসীর জন্য, কারণ আগ্রাসী ফ্যাসিবাদী পুঁজির বিকাশ ইতিহাসে কখনও দীর্ঘমেয়াদি হয়নি।