E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯

সর্বাত্মক প্রতিরোধের সংগ্রাম আসন্ন

অমিয় পাত্র


ওরলি বিদ্রোহে গোদাবরী পারুলেকর।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মূল ভিত্তি ছিল তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক জমিদার শ্রেণি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ে জমিদার, মহাজন ও কোম্পানির বোঝাপড়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের বৃহৎ সংস্থা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আসার অন্যতম লক্ষ্য ছিল এ দেশের সম্পদ লুঠ করা। এ দেশের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য ও কাঁচামাল নামমাত্র দামে সংগ্রহ করে নিজ দেশে পাঠানো এবং ব্রিটেনের শিল্পজাত পণ্যের বাজার হিসাবে ভারতীয় বাজারকে ব্যবহার করার ইতিহাস সুবিদিত। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগান দিতে ভারতীয় জনগণের থেকে ভূমি রাজস্ব, বাণিজ্য শুল্ক আরোপের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। দেশীয় কৃষকদের শোষণ, নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়া এবং লুটের বখরার অংশ কীভাবে বণ্টিত হবে, কারা শুল্ক আদায় করবে তার আইনি অধিকার নিশ্চিত করা হয় ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস দ্বারা প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ ব্যবস্থার মাধ্যমে। শুরু হলো এ দেশের কৃষক তথা সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুর্গতি। দুর্ভিক্ষের করালগ্রাস বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। কোনো নিপীড়ন, লুঠ, বঞ্চনা, মানুষকে চিরকাল নতজানু করে রাখতে সক্ষম হয়নি। অত্যাচারী ইংরেজও মানুষকে বেশিদিন পদানত করে রাখতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনে অত্যাচারিত, প্রতারিত মানুষের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ বা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এগিয়েছে মানুষের সংগ্রাম। চোয়াড় (দলিত) বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহ, নৌ বিদ্রোহ - এ ধরনের অসংখ্য লড়াই, ধর্মঘট, অসহযোগ আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট খণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটেছে। কংগ্রেস, মুসলিম লিগের বোঝাপড়া, ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আপস এবং হিন্দু মহাসভার সমর্থনে দেশভাগ হলো, দু’টুকরো হলো বাংলাও। এ বছর মহাসমারোহে চলছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫তম বর্ষ উদযাপন।

দেশের সর্বত্র, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরাধীনতার যন্ত্রণার বিস্তার ঘটাতে প্রধান ভূমিকা ছিল সামন্ততান্ত্রিক জমিদার, মহাজনদের। এ দেশের বামপন্থী বিশেষত কমিউনিস্টরা চেয়েছিলেন ইংরেজ এবং তাদের এ দেশীয় লেজুড় (সামন্তবাদী জমিদার) এই দ্বিবিধ শত্রুর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সেটা হয়নি। গাছটা বিদায় হলেও শেকড় থেকে গেছে। সদ্যোজাত স্বাধীন রাষ্ট্রে এরাই গ্রামে, গঞ্জে কংগ্রেস দলের খুঁটি হিসাবে কাজ করতে থাকে। এই ৭৫ বছরের পরিবর্তন হলো - মূলত সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের এখন পুঁজিবাদী জমিদারে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে। কার্যত সামন্তবাদের অবশেষ থেকে গেছে, পরিপূর্ণ পুঁজিবাদ কায়েম হয়নি। কমিউনিস্টরা চেয়েছিলেন দেশের সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার সম্পন্ন করুক। প্রকৃত কৃষকের হাতেই জমি দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরা ছাড়া অন্য কোনো রাজ্যে ভূমিসংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ভূমিসম্পর্কের যে পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত ছিল সেটা অবহেলিত থেকে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় - প্রাক্ উদারীকরণ পর্ব (১৯৪৭-১৯৯১) এবং উদারীকরণ পর্ব (১৯৯১-এর পর)।

প্রাক্ উদারীকরণ পর্ব (১৯৪৭-১৯৯১)

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ১৯৫০-১৯৫৫ সালের মধ্যে বেশিরভাগ রাজ্যে জমিদারি প্রথার বিলোপের আইন পাশ হলেও জমিদারদের হাতে থাকা সমস্ত জমি অধিগ্রহণ করে কৃষকের মধ্যে বণ্টন করা হয়নি। এমনকী সরকার যে জমির জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সেই জমিও জমিদারের কবজায় থেকে গেছে। জমির ঊর্ধ্বসীমার বাইরের জমিও জমিদাররা স্বনামে, বেনামে রেখে দেয়। দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করতে যে সকল বৃহৎ জোতের মালিকদের স্বার্থবাহী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাতে কিছুটা সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। সেচ এলাকা বৃদ্ধি, উন্নত মানের বীজ ব্যবহার, রাসায়নিক সারের ব্যবহার, কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, পুঁজি বিনিয়োগ, সবুজ বিপ্লব ইত্যাদি কর্মসূচি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবং খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে অগ্রসর হতে সহায়ক হয়। সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে জমিদার ও ধনী কৃষকদের উপর নির্ভর করেছিল। এক কথায় এই সময়ে সরকারি বিনিয়োগ, জমির ক্ষতিপূরণ, কৃষি উপকরণের সুবিধা, ব্যাংক ও বেসরকারি বিনিয়োগের সুফল সবটাই জমিদার এবং ধনী কৃষকের ঝুলিতে জমা পড়েছে। সরকারের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণেই এই পর্যায়ে খেতমজুর, গরিব চাষি, মাঝারি চাষির বঞ্চনা বেড়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাধারণ কৃষক আরও দুর্বল হয়েছে। কৃষক জমি হারিয়ে মজুরে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে বৃহৎ বুর্জোয়ার নেতৃত্বে বুর্জোয়া এবং জমিদারদের শ্রেণি জোট সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রাধান্য উৎখাত না করেই আমাদের দেশের অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী বিকাশের পথে রূপান্তরের চেষ্টা করেছে।

উদারীকরণ পর্ব (১৯৯১-এর পর)

১৯৯১ থেকে বিশ্বজুড়ে এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। উদার অর্থনীতি নির্ণায়কভাবে অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে - সামাজিক সম্পর্ক, সংস্কৃতির অভিমুখ, জীবনের সংজ্ঞা, রাজনীতির পরিভাষা, ভাষার রাজনীতি, পরিচিতির সন্ধান ইত্যাদি। আসলে এই আর্থিক নীতির মূল কথা হলো - ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সুরক্ষা, মুক্ত বাজার, মুক্ত বাণিজ্য। রাষ্ট্রের দায় হলো - পুঁজির অবাধ চলাচল ও জোগান নিশ্চিত করা, আইন দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করা, যেসব ক্ষেত্রে বাজারায়ন হয়নি যেমন - শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা, জমি, জল, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজারি সম্পর্ক স্থাপনে রাষ্ট্রের উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ। ব্যক্তি মালিক, দেশি বিদেশি করপোরেটদের স্বার্থে ক্রমান্বয়ে সব আর্থিক, বাণিজ্যিক ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রকে সরে আসতে হবে। তাদের চাহিদা মতো শ্রম আইন, চাকুরির শর্তাবলী পরিবর্তন করতে হবে। এ যাবৎ সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারতেও উদার অর্থনীতির জাল রাষ্ট্রের সমস্ত শাখা-প্রশাখায় বিস্তার ঘটিয়েছে। উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্র পিছু হটেছে, শ্রমের বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশি-বিদেশি পুঁজির একাধিপত্য। সময়ের সঙ্গে কৌশল বদলেছে, তাই আপাতদৃষ্টিতে আমাদের রাষ্ট্র স্বাধীন মনে হলেও, বাস্তবে বৃহৎ পুঁজির আজ্ঞাবহ, তাঁদের স্বার্থ রক্ষাই সরকারের একমাত্র কাজ।

ভারতেও সমাজের অন্যক্ষেত্রের মতো কৃষি ও কৃষকের জীবনে আর্থিক উদারনীতির আগ্রাসন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে দেশের বাইরে থেকে কৃষিজাত পণ্যের আমদানি করা হচ্ছে, এটা করা হচ্ছে কৃষকের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে করপোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করতে। বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষিপ্রযুক্তি ও অন্যান্য উপকরণ থেকে ক্রমাগত ভরতুকি প্রত্যাহার কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমেছে, কৃষি ক্রমেই অলাভজনক হয়েছে। কৃষক তার ফসলের দাম পাচ্ছে না, ঋণগ্রস্ততা বাড়ছে। কৃষি উপকরণের দাম বাড়লেও তার তুলনায় বাড়েনি রাষ্ট্রের নির্ধারিত ফসলের সহায়ক মূল্য। উদারনীতির জমানায় প্রায় চার লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। দেনার দায়ে আকছার জমি হাতছাড়া হচ্ছে। করপোরেটরা ঠিক এটাই চাইছিল। কৃষক জমি থেকে সরতে বাধ্য হবে এবং করপোরেটগুলি সেই সুযোগে জমিতে থাবা বসাবে। এভাবেই দেশের সরকার দেশি-বিদেশি করপোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। ইতিমধ্যে কৃষিতে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মনসান্টো, পেপসি, বেয়ার, ওয়ালমার্ট, কার্গিল, ম্যারিকো, নেসলে, রালিস ইত্যাদি অসংখ্য করপোরেট সংস্থার ঠিকানা এখন ভারত। শুধু চুক্তি চাষে যুক্ত হয়েছে ২৫টির বেশি বহুজাতিক কোম্পানি। এছাড়া সার, বীজ, কীটনাশকের একচেটিয়া ব্যবসা, যন্ত্র, প্রযুক্তি, কৃষি পণ্যের খুচরো ব্যবসা, আমদানি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ - সর্বত্রই করপোরেটদের রমরমা। চুক্তি চাষ, আগাম বাণিজ্য, জল-জমি-খনি-অরণ্যের দখলদারি - এ সবই কেন্দ্রীয় সরকারের উদারতায় করপোরেটদের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, করপোরেট স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ভূমি অধিগ্রহণ নীতিতে কৃষি, কৃষক ও পরিবেশের স্বার্থে যে নিরাপত্তামূলক বিধান ছিল তা তুলে দিয়ে জমিতে পুঁজির আগ্রাসনকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৫ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমিকে অকৃষি জমিতে পরিবর্তন করা হয়েছে। এই জমির সিংহভাগ এখন করপোরেটদের হাতে। জঙ্গলের জমি, আদিবাসীর জমি, সাধারণ কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে বড়ো বড়ো বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠছে। মোদি সরকারের জমানায় উদারনীতির দাপট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। করপোরেটদের সেই সময়ের চাহিদা ছিল কৃষিপণ্যের বাজার দখল। অতিমারীর পরিস্থিতিতে সৃষ্ট আর্থিক মন্দার জন্য ওদের চাহিদা ছিল কৃষিপণ্যের উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াকরণের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এর জন্য দেশের প্রচলিত আইনি বাধা, ট্যাক্সের বাধা, লাইসেন্স প্রথার বাধা অপসারণ করে করপোরেটদের ঢালাওভাবে সুবিধা করে দেওয়ার প্রয়োজনে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো আলোচনা ছাড়াই দুটি কৃষি আইন এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের সংশোধনী অর্ডিন্যান্সের আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। এই আইনি পরিবর্তনের পরিণতি হলো - কৃষক ফসলের সহায়ক মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে, খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে, গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে না, কৃষক তার ফসল বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হবে, দানাশস্য, ডাল, ভোজ্যতেল ও শাক-সবজির অস্বাভাবিক হারে মূল্যবৃদ্ধি হবে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ফলত অনিবার্যভাবেই কৃষক দেনাগ্রস্ত হয়ে জমি হারাবে বা আত্মহত্যায় বাধ্য হবে। এই প্রেক্ষাপটেই বাঁচার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল ছোটো-বড়ো মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক কৃষক, খেতমজুর ও অন্যান্য বেসরকারি সংগঠন (NGO)। দাবি আদায়ের জন্য মরণপণ লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা নিয়ে দীর্ঘ এক বছর লড়েছেন এবং ৭০০-রও বেশি কৃষক প্রাণ দিয়েছেন।

সরকারি দমন-পীড়ন, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং করোনা ভাইরাস-এর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ প্রদর্শন, অবস্থান, সভা, সমাবেশ অব্যাহত ছিল। বিজেপি দল ও সরকার মিডিয়াকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে এবং বিপুল অর্থের বিনিময়ে দালাল কৃষক নেতা তৈরি করে আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপি এবং তার সহযোগী দু-একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল আন্দোলনরত কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

নাগরিক সংগঠন, শ্রমিক, কর্মচারী সংগঠন, ছাত্র, যুব, মহিলা সহ সবক’টি গণসংগঠন এই দাবিগুলির সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে। স্বাধীন ভারতে এরকম ব্যাপক, দীর্ঘমেয়াদি ও ইতিহাস সৃষ্টিকারি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতিসমূহ যা দেশের সব দরজা উন্মুক্ত করার নীতি বা বেসরকারিকরণ, বিনিয়ন্ত্রণ ও মুক্ত বাজার ব্যবস্থার পথে চলার পদক্ষেপ। এই সরকারি নীতিই দেশবাসীর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। উদারনীতির থাবা শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই বসেছে তা নয়, করপোরেট মুনাফা শিকারের গ্রাসে এখন গোটা দেশ। মানুষের শ্রম থেকে ব্যাঙ্ক, বিমা, সঞ্চয় বা জল, জমি, জঙ্গল, খনি থেকে রেল, বিমান, রাস্তা এসব কিছুই আমরা হারাতে চলেছি। তাই এটা শুধু কৃষি ও কৃষকদের বাঁচার লড়াই নয়, এটা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষার লড়াই, দেশের সম্পদ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে রক্ষার লড়াই, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় ঐক্য রক্ষার লড়াই। সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্বে এই ঐতিহাসিক লড়াই সফল হয়েছে, জনবিরোধী কেন্দ্রের সরকার কৃষকদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। এটাই এই সময়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হলো গ্রামের নব্য ধনীরা। আমাদের রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, ডিলার, মহাজন, প্রমোটার - যাদের কৃষি বহির্ভূত ক্ষেত্রের আয় বেশি এমন ধনী চাষিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি চক্র শাসকদলের সঙ্গে যৌথভাবে গ্রামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করছে। এই চক্র গ্রামীণ গরিব ও কৃষকদের অবদমিত করে রেখেছে। পুলিশ ও প্রশাসন গ্রামে নব্য ধনীদের পক্ষে অতি সক্রিয়। অন্যদিকে গ্রামে সংখ্যা ও সামর্থ্যের বিচারে প্রধান শক্তি হতে পারে খেতমজুর, অকৃষি ক্ষেত্রের শ্রমিক, গরিব কৃষকের ঐক্য। গ্রামে এদের সংখ্যা জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগ। এদের সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করা আমাদের প্রধান কাজ। যাবতীয় বিভ্রান্তি - জাত, ধর্ম, সম্প্রদায়ের বিভেদ, অর্থ, প্রলোভন, ভীতি প্রদর্শন, পুলিশি জুলুমকে রুখে দেওয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে। গ্রামে আধিপত্যকারী নতুন ধনী ও তাঁদের সঙ্গে থাকা প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে গ্রামকে এদের প্রভাব থেকে মুক্ত করার অনিবার্য সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। গ্রামের সব শ্রমজীবী এবং কৃষকের ঐক্যের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই এই লড়াই লড়তে হবে। শ্রমিক-কৃষকের এই ঐক্য গড়ে উঠবে লড়াই আন্দোলনের মাটিতেই। এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কাজ আর কিছুই থাকতে পারেনা।


ছবি সৌজন্যঃ LIFE Magazine