E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯

স্বাধীনতার লড়াইতে বাংলার বামপন্থীরা

সুজন চক্রবর্তী


তেভাগা আন্দোলনে কৃষক স্বেচ্ছাসেবকরা।

দীর্ঘকালীন ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ৭৫ বছর। নানান ধারা উপধারার বহুবিধ লড়াইয়ে পুষ্ট এ দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে তাকে অস্বীকার অথবা খাটো করে দেখবার একটা প্রচেষ্টা বরাবরই চালু আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সত্যকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। এ দেশের স্বাধীনতার লড়াইতে কমিউনিস্টদের ভূমিকা বরং গৌরবোজ্জ্বল। যুক্ত বাংলার প্রসঙ্গে সেটা আরও বেশি করেই স্পষ্ট। জাতীয় আন্দোলন কিংবা বিপ্লববাদী আন্দোলনের ধারার প্রায় প্রতিটি ইতিবাচক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই কমিউনিস্টরা, সীমিত শক্তি নিয়েও, বরাবরই সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। এ বিষয়ের চর্চা আজকের সময়ে আরও বেশি জরুরি।

ব্রিটিশ শাসনে সবচাইতে সংগ্রামী ভূমিকা যেমন বাংলার, তেমনই সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার বাংলা। তৎকালীন সময়ে সবচাইতে এগিয়ে থাকা যেমন বাংলা, কৃষি-শিল্প-শিক্ষা-সংস্কৃতি সব মিলিয়েই, তেমনই সবচাইতে বেশি বঞ্চনার শিকার বাংলা। এতৎসত্ত্বেও বাংলা কখনো ব্রিটিশের কাছে মাথা নিচু করেনি। কৃষক-শ্রমিক সংগঠিত আন্দোলন, ছাত্র সমাজের সংগ্রামী প্রতিবাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মতো নাছোড় লড়াই - এ সবই কার্যত বাংলার লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে সাথে নিয়েই। ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকিরা যেমন, তেমনই অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ, ধাঙড় কিংবা গাড়োয়ানদের ধর্মঘট - এ সবই বাংলার লড়াকু মননের পরম্পরা। সেলুলার জেলের কঠিনতম নির্জন কারান্তরালে যত বিদ্রোহী তার প্রায় আশি শতাংশ বাংলার। আশি শতাংশ কমিউনিস্ট। মুচলেকা অথবা মাথা নিচু করে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইতে মাথা উঁচু করে মুক্তির শপথ জারি রেখেছেন আমাদের পূর্বসূরিরা। গর্বিত করেছেন বাংলার সমাজজীবনকে। গর্বিত করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট কর্মীদের।

বিদ্রোহের বাংলা

১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী সিপাহিদের বিদ্রোহ। স্বাধীনতার প্রথম মহাসংগ্রাম। কার্ল মার্কস বললেন - “ইঙ্গ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহ মিলে গেছে ইংরেজ প্রাধান্যের বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো এশীয় জাতিগুলির এক সাধারণ অসন্তোষের সঙ্গে।” এটি ছিল আসলে হিন্দু ও মুসলমানদের এক মিলিত জাতীয় বিদ্রোহ। ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার দু’মাস আগেই বারাকপুর বিদ্রোহের নেতা মঙ্গল পান্ডের ফাঁসি। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল বহরমপুর, চট্টগ্রাম, জলপাইগুড়িতে। বিদ্রোহে জড়িত থাকার কারণে ফাঁসি হলো বীরভূমের করিম খাঁ এবং মেদিনীপুরের বৃন্দাবন তেওয়ারির।

এরও আগে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু সন্ন্যাসী এবং মুসলমান ফকিরদের বিদ্রোহ। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় চোয়াড় বিদ্রোহ, লায়েক বিদ্রোহ। তিতুমীরের লড়াই। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে ফরাজি আন্দোলন। সিপাহি বিদ্রোহের আগেই সাঁওতালি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংগ্রাম। সিধো-কানহুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করে। আবার সিপাহি বিদ্রোহের দু’বছরের মধ্যেই নীলচাষিদের বিদ্রোহ।

কৃষকদের নানাবিধ সংগ্রামের সাথে পাল্লা দিয়েই যেন শ্রমজীবী জনগণের বিক্ষোভ প্রতিবাদ, ধর্মঘট। ১৮৫৬ সালে সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে শামিল হলেন গঙ্গার মাঝি-মাল্লারা। ১৮৬২ সালে হাওড়ার রেলওয়েতে শ্রমিকদের ধর্মঘট। দাবি ৮ ঘণ্টার কাজ। বজবজে জুটমিল শ্রমিক বিক্ষোভ এবং ধর্মঘট। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ১৯০৫ সালে হাওড়ার বার্ন কোম্পানিতে, কলকাতার ট্রামওয়ে কোম্পানিতে ধর্মঘট। এ সব যেন বাড়তেই থাকল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই একদিকে যেমন অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহের ধারা, ঠিক তেমনই বাংলার সংস্কৃতি ও মনন ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট করতে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের ধারা। ভারতের মধ্যে বাংলার মাটিতেই এই দুই ধারা পারস্পরিক সহায়ক ও পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই বাংলার জাতীয় সংগ্রামের ধারার পাশাপাশি এক বিপ্লবী ধারা ক্রমশই পুষ্ট হতে থাকে।

ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা

বাংলায় শ্রমজীবী জনগণের প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সহানুভূতির প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই। এই পটভূমিকায় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা ধারাও ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। ১৮৫৩ সালে গড়ে উঠল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৭৫ সালে ইন্ডিয়ান লিগ। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে ১৮৭৬ সালে গড়ে উঠল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। এরকমের প্রেক্ষাপটেই ১৮৮৫-তে গড়ে উঠল জাতীয় কংগ্রেস।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আর একটি ধারা বাংলায় বিকশিত হতে থাকল। ১৯০১ সালে ব্যারিস্টার পি মিত্রের উদ্যোগে গঠিত অনুশীলন সমিতি। পরে তৈরি হলো আরও একটি সংগঠন। যুগান্তর। চরমপন্থী লড়াইয়ের মনোভাব। বিপ্লববাদী মনন। সশস্ত্র লড়াইয়ের স্পৃহা। চোরা-গোপ্তা আক্রমণ। ব্রিটিশ বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে মুক্তির কামনা। বেপরোয়া ঝোঁক। ব্রিটিশের ভাষ্যে সন্ত্রাসবাদী। ভারতজুড়েই এই সময় ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিলাভের সংগ্রাম বিকশিত হচ্ছে। বহু ধারায় তা ব্যাপ্ত হচ্ছে। এ বাংলায় সবকটি ধারারই অস্তিত্ব ছিল এবং যে কোনো ধারার তীব্রতা অন্যান্য জায়গা থেকে বাংলাতেই ছিল বেশি।

বাংলায় সংগ্রামের এই বিস্তৃতিতে শঙ্কিত ব্রিটিশ বাহিনী নানা পন্থা অবলম্বন করে দমিয়ে রাখতে চাইল। বাংলা ভাগ করার চক্রান্ত শুরু হলো। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব। পারল না। রদ করতে হলো ব্রিটিশের সিদ্ধান্ত। অতএব রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো দিল্লিতে। বাংলাকে বিপর্যস্ত করতে মরিয়া ব্রিটিশ বাহিনী। কাজ হলো না। বরং বাংলায় বিদ্রোহ বিক্ষোভ বাড়তেই থাকল। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ সাল - এই এগারো বছরে দেশ জুড়ে ৩৮৫টি বৈপ্লবিক কাণ্ড বা আক্রমণ সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে বাংলায়।

নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব

ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে ঘটে গেল দুনিয়া কাঁপানো দশদিন। রুশ দেশে মহান নভেম্বর বিপ্লব। দুনিয়ার বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ। দুনিয়াজুড়েই তার প্রভাব ছড়াতে লাগল। ভারতে বিপ্লবীদের সামনে উন্মোচিত হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন একটা অধ্যায়। সংগ্রামের বিভিন্ন ধারার অন্তর্ভুক্ত অনেকেই নতুন করে পথ খুঁজে পেতে চাইলেন।

অনুশীলন সমিতির কর্মী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, এম. এন. রায় নামেই সমধিক পরিচিত। বাঘাযতীনের নির্দেশে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াইতে অস্ত্রের সন্ধানে নানা দেশে ঘুরতে ঘুরতে মেক্সিকোতে যান। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তাসখন্দে বসে ১৯২০ সালে গঠন করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনেই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেন কমিউনিস্টরা। এম এন রায়দের স্বাক্ষরিত ইস্তাহার বিলি করা হতে থাকে কংগ্রেস অধিবেশনে। এর পরেও আট বছর সময় লেগেছে। অবশেষে ১৯২৯ সালে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করে কংগ্রেস। কমিউনিস্টদের বক্তব্য এবং ক্রমবর্ধমান প্রভাব ব্রিটিশের চোখ এড়ায়নি। শক্তির বিচারে ছোটো হলেও কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযানে যথেষ্টই তৎপর ব্রিটিশ বাহিনী। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং ষড়যন্ত্র মামলা চাপিয়ে ও নানাবিধ নির্যাতন করে কমিউনিস্টদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই ছিল ব্রিটিশের লক্ষ্য। সে লক্ষ্য ব্রিটিশের যে পূরণ হয়নি - তা নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না।

বিংশ শতাব্দীর তিরিশ এবং চল্লিশের দশক অত্যন্ত ঘটনাবহুল সময়। এই সময়কালের মধ্যে কখনো এককভাবে আবার কখনো কংগ্রেসের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে শামিল থেকেছেন। এই সময় একইসাথে গণসংগ্রাম গড়ে তোলা এবং সংগঠন, গণসংগঠন গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত থেকেছেন কমিউনিস্ট কর্মীরা। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, সংগ্রামের সমস্ত সুযোগগুলোকে ব্যবহার করেছে কমিউনিস্ট পার্টি।

১৯৩০ সালের মার্চ মাসে গান্ধীজি অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলেন। শুরু করলেন লবণ সত্যাগ্রহ। বিলাতি দ্রব্য বয়কট শুরু হলো। এই পরিস্থিতিতে বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলনের চাপ বাড়তে থাকল। সংগঠিত হলো কলকাতায় গাড়োয়ান ধর্মঘট এবং বাংলায় চটকল ধর্মঘট। অত্যাচারের মাত্রা বাড়ল। পুলিশি অত্যাচারে বহু গাড়োয়ান মারা গেলেন। কমিউনিস্ট নেতারা গ্রেপ্তার হলেন।

প্রায় একই সময়ে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ। অভ্যুত্থানই বটে। বিদ্রোহীদের অনেকেই আন্দামান সেলুলার জেলে কারাদণ্ড ভোগ করলেন। জেলে বসে তারা মার্কসবাদের চর্চায় দীক্ষিত হলেন। পেলেন নতুন পথের সন্ধান। এই সময়েই রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দ যুদ্ধ। চট্টগ্রামের ইয়োরোপিয়ান ক্লাবের উপর আক্রমণ। নানা কিছু। সংগ্রামের পথেই বাংলার লড়াই। হার না মানা লড়াই।

সমসময়েই কলকাতা সহ বাংলার নানা কেন্দ্র থেকে অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় বামপন্থার মনোভাবের প্রকাশ ঘটতে থাকল। লাঙ্গল, গণবাণী, কারখানা, চাষী-মজুর, দিন-মজুর, সাম্য, গণনায়ক এরকম নানা পত্রিকা। স্বল্পকালীন হলেও সংগ্রামী মনন গড়ে তুলতে পত্রিকাগুলি সাহায্য করেছে। তিরিশের দশকেই জেলায় জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠিত হয়েছে। কৃষক, ছাত্র, লেখক-শিল্পী সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংগঠন, সংগ্রাম এবং পত্র-পত্রিকার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এবং মুক্তির স্বপ্নের লড়াইকেই ক্রমশ জোরদার করা হয়েছে। এর প্রতিফলন ক্রমশই স্পষ্ট হতে থাকল।

মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ কমিউনিস্টরা

চল্লিশের দশক আরও ঘটনাবহুল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিস্ট জার্মানি আক্রমণ করে সোভিয়েত রাশিয়াকে। ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করতে না পারলে শুধু সোভিয়েত না, বিপর্যস্ত হবে দুনিয়াজুড়ে স্বাধীনতাকামী গণতান্ত্রিক শক্তি। ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে যেমন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বিজয় ঘোষিত হবে, তেমনই দেশে দেশে স্বাধীনতা এবং মুক্তির লড়াই বেগবান হবে। কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি. সি. যোশী পুস্তিকা লিখলেন - ‘Forward to Freedom’। লিখলেন - এই যুদ্ধে হিটলারের পরাজয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জয় পৃথিবীর সমস্ত পরাধীন দেশের স্বাধীনতার পথ খুলে দেবে। পার্টির বিরুদ্ধে তখন দারুণ কুৎসা। অথচ বাস্তব এটাই যে, একদিনের জন্যও পার্টি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্রোতধারা থেকে সরে যায়নি।

পার্টি আইনি হবার পর বাংলা জুড়ে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের বিরুদ্ধে, বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনুষ্য সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ, মানুষকে বাঁচাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করল পার্টি এবং গণসংগঠনসমূহ। পাড়ায় পাড়ায় মানুষের সাহায্য সংগ্রহ করে পীড়িত মানুষের পাশে রক্ষাকর্তা হিসাবে কমিউনিস্টরা। শিল্পী-সাহিত্যিকরা রাস্তায় নামলেন। পিপলস্ রিলিফ কমিটি গড়ে উঠল। মানুষ দেখল কমিউনিস্টদের সামাজিক, মানবিক দায়বদ্ধ চেহারা। পুস্তিকা প্রকাশিত হলো - ‘মৃত্যু ও মহামারীর বিরুদ্ধে খাদ্যের জন্য লড়ো’। এই পুস্তিকায় বাংলাকে বাঁচানোর জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়ের প্রতি আবেদন জানানো হয়েছিল।

চল্লিশের দশক - বিক্ষোভ-বিদ্রোহে বাংলা

ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর দেশে দেশে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। আমাদের দেশেও বটে। পার্টির নেতৃত্বে এবং প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক নানান শক্তির সাথে যৌথভাবে দেশজুড়ে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের জোয়ার। অন্যদিকে ব্রিটিশ ও ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণির মধ্যে আপসের প্রয়াস। ব্রিটিশ বাহিনী বুঝতে পারছিল যে তাদের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে লড়াই। ১৯৪৬-এর ১১ ফেব্রুয়ারি রশিদ আলি দিবস। কলকাতায় মিছিলে পুলিশের গুলিতে দুই শতাধিক হতাহত। প্রতিবাদ থামছে না। ক্রমশই বাড়ছে। এর পর নৌ বিদ্রোহ। নৌসেনাদের অভ্যুত্থান। ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিলেন কংগ্রেস, কমিউনিস্ট আর মুসলিম লিগের পতাকা। নাবিকরা যখন ধর্মঘটে লিপ্ত তখন কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করেই পাশে দাঁড়াল। অথচ কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ সমর্থনের পরিবর্তে নাবিকদের আত্মসমর্পণ করতে বলল। জনযুদ্ধ পত্রিকায় লেখা হলো - ‘নৌ সেনাবাহিনীর রক্তের ডাক দেশবাসী ভুলিবে না, লক্ষ লক্ষ ধর্মঘটী শ্রমিকের কঠোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা’। এই সময়েই দেশব্যাপী শ্রমিক-কৃষকের নানান আন্দোলন। দেশজুড়ে কৃষক সংগ্রাম। বাংলাজুড়েই কৃষকদের বিদ্রোহ। তেভাগা আন্দোলন। কাকদ্বীপ, ভুবিরভেড়ি, বড়া কমলাপুর, রংপুর, হাজং বিদ্রোহ। অভ্যুত্থানের মতো পরিবেশ। ১৯৪৬ সালে সারা ভারত ডাক-তার ধর্মঘট। ২৯ জুলাই। সমর্থনে বাংলাতেই ৬ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী শামিল। অভূতপূর্ব ঐক্য। অতএব এর পরেই শুরু হলো নতুন ধরনের চক্রান্ত। ২৯ জুলাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ১৮ দিনের মাথায় রক্তস্নাত করা হলো কলকাতাকে। দাঙ্গা। বিভাজনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতের স্বাধীনতাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অতএব ক্ষমতা হস্তান্তরের পর্ব এবং তার অংশ হিসাবেই দেশভাগ। বাংলা ভাগ।

বামপন্থাতেই গর্ব

কমিউনিস্ট পার্টি তখন তুলনামূলকভাবে খুবই ছোটো। কিন্তু দেশ এবং বাংলার মানুষের স্বার্থ বিবেচনায় যথাযথ বিশ্লেষণ ছিল কমিউনিস্টদেরই।

১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ভারতে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন এসেছিল। মিশনের কাছে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে স্মারকলিপি পেশ করা হয় ১৭ এপ্রিল। এর মূল কথা ছিল - এই মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা চাই। ব্রিটিশ সৈন্যের অপসারণ চাই। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাস। জনযুদ্ধ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ঘোষণা করা হলো - ‘বঙ্গ-ভঙ্গ চাই না’। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল। স্বাধীনতা পত্রিকায় - ‘স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ বাংলার জন্য আওয়াজ তুলুন’ - এই আহ্বান। বলা হলো ‘বঙ্গভঙ্গ দাঙ্গা থামাইবে না। বাড়াইবে।’ বলা হলো - বাংলার ভাগ বাংলার অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে।

দীর্ঘ লড়াই। অবশেষে স্বাধীনতা। ক্ষমতা হস্তান্তর। কঠিন কঠোর সংগ্রাম কমিউনিস্টদের। শ্রমিক-কৃষক সহ সমাজের সর্বস্তরকে ঐক্যবদ্ধ করা। জাতীয় আন্দোলন এবং বিপ্লববাদী আন্দোলনের ধারাকে যুক্ত করেই গুণগতভাবে এগিয়ে চলার ব্যবস্থা। সামাজিক-মানবিক দায়বদ্ধতা নিয়ে পথচলা। স্বাধীনতার লড়াইতে বাংলার বাপন্থীরা আমাদের গর্বিত করে।