৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯
ইতিহাসে থেকেও যাঁরা ইতিহাসে নেই
অলকেশ দাস
ইতিহাস লেখার কলম যাদের হাতে তাদেরও শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। তারা নিজেদের শ্রেণির ভাষায় ইতিহাস রচনা করে। সেজন্যই দলিতের ইতিহাস ভেসে যায়। লেখা হয় না। হাঁড়ি, ডোম, চণ্ডাল, বাগদি... আদি অধিবাসীরা... মানে শুদ্ররা সমাজে যেমন অপাঙক্তেয় হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি ইতিহাসেও তারা অস্তিত্বহীন, সীমানায় বন্দি হয়ে থাকে। সম্প্রতি অমর্ত্য সেন তাঁর শৈশবের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বের করেছেন সেই মুহূর্ত - যখন আবেগাপ্লুত বালক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। মোহনদাস করমচাঁদের সই নিতে। গান্ধী ছোটো অমর্ত্যকেও রেয়াত করেননি। চেয়েছেন তাঁর কাছেও - অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য পাঁচ টাকা। বড়োদের থেকে পাঁচ টাকা এনে নাছোড়বান্দা অমর্ত্য গান্ধীজির সই খাতায় নিয়েই ছেড়েছেন। গান্ধীজি তার খাতায় লিখে দেন - ‘‘আজ থেকে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তোমার লড়াই শুরু হলো’’। এটা সেই বিংশ শতাব্দীর মধ্য সময়ের ঘটনা। অত দূরে গিয়েই বা লাভ কী? বর্তমান সময়ের ঘটনা। স্বামী টেনে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে স্ত্রীর মৃতদেহ পায়ে দড়ি পড়িয়ে টেনেহিঁচড়ে। কেন? দলিত বলে শ্মশানে তার স্ত্রীকে দাহ করতে দেওয়া হয়নি। এই ঘটনা কি মনে করায় না ট্র্যাডিশনের সেই কথা - যা শঙ্খ ঘোষ কবিতায় তুলেছিলেনঃ বুঝতে পারি এই এতদূর এসে/ সত্যি শুধু এস ওয়াজেদ আলী/ সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
যারা জাতির ভাগ করল শোষণের চিরস্থায়ী বংশানুক্রমিক রূপ দেওয়ার জন্য, যারা অস্পৃশ্যতার ঘেরাটোপে বাঁধল আধিপত্যবাদের চূড়ান্তে, লেখাপড়া আর সম্পদে ব্রাত্য করে সেবার অনুশাসনে বন্দি করল শুদ্রকে, যারা নিজেরাই আরামকেদারা বজায় রাখতে লোভ আর আপসে যুক্ত করল নিজেদের - তারাই প্রচার করে যে দলিত মানুষেরা ব্রিটিশদের তাড়ানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। এর চেয়ে বড়ো অসত্য আর হতে পারে না।
এ দেশে দলিতদের আন্দোলন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ত্রিমুখী ধারায় বয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বের সম্মুখভাগে ছিলেন যাঁরা,তাঁদের বড়ো অংশ ছিল ভূস্বামী এবং বর্ণহিন্দু মত দ্বারা পরিচালিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমি সংস্কারের প্রয়োগে অনাগ্রহ তাকে আরও স্পষ্ট করেছে। সেই জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্বই নিম্নবর্গীয়দের ব্রাত্য করে রেখেছিল। কিন্তু সাঁওতাল বিদ্রোহ, স্বাধীনতার অজস্র ছোটো-বড়ো লড়াই, সিপাহি বিদ্রোহ, বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে অসংখ্য দলিত, আদিবাসী মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তন্তুবায় বিদ্রোহ, নীল চাষিদের বিদ্রোহ, রেশম চাষিদের বিদ্রোহ, মালঙ্গী, লবণ শিল্পের বিদ্রোহ - এইসব বিদ্রোহ ছোটো, কিন্তু প্রভাবের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নবর্গীয়দের এই সব আন্দোলনে ঈর্ষণীয় অংশগ্রহণ। দ্বান্দ্বিকভাবে পূর্বশর্ত হিসাবে সিপাহি বিদ্রোহের ক্ষেত্রে এগুলো ঘটেছিল। এমনকী সিপাহি বিদ্রোহের অব্যবহিত পূর্বে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহে রূপান্তরের ভূমিকা নিয়েছে। স্ফুলিঙ্গ যদি দাবানল সৃষ্টি করে তবে দলিত, আদিবাসীদের বিদ্রোহ গাঁথা সিপাহি বিদ্রোহের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে।
বাংলার এ’রকম এক বিদ্রোহ চোয়াড় বিদ্রোহ। অষ্টাদশ আর ঊনবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে। জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ চোয়াড়। বনকে কেন্দ্র করেই তাদের বাস, আহার, জীবনযাপন। তীর, ধনুক, টাঙ্গি ব্যবহার তাদের সহজাত। স্থানীয় রাজা জমিদার এদের নিয়োগ করেছিল নিরাপত্তার কাজে। তাই নাম হলো ‘পাইক’। বিনিময়ে পেল বেতন অথবা জমি। জমির নাম হলো ‘পাইকন’ বা ‘খাস’ জমি।
মেদিনীপুরের নিকটস্থ কর্ণগড় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা ১৫৬৮ সালে। এদেরই এক রাজা অজিত সিংহর দ্বিতীয় স্ত্রী রানি শিরোমণি। চোয়াড় কৃষক পরিবারের কন্যা। ১৭৬০ সালে কর্ণগড়ের রানি হন শিরোমণি। সাহসিকতার পরিচয় রানি দিতেন প্রজাদের সঙ্গে আলোচনায়। অভিযোগ শোনার সময় তাদের ন্যায়বিচার দেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত রাখতেন রানি। প্রজারা, যাদের মধ্যে চোয়াড়ের সংখ্যাই বেশি রানিকে নিয়ে উৎসাহিত ছিলেন। এই বছরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মেদিনীপুর রাজ্যের পূর্ণ দখল পায়। প্রথমে তারা জমিদারদের চটায় না। কিন্তু মুনাফা বড়ো দায়। ধীরে ধীরে তারা জমিদারদের রাজস্ব এবং প্রজাদের কর বাড়াতে শুরু করে। সহ্য করতে না পেরে এবার জমিদার ও প্রজার স্বার্থ অভিন্ন হয়। তারা কোম্পানির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ইংরেজ বিপদ বুঝে রাজা, জমিদারদের সৈন্য সংখ্যা কমাতে হবে - ফতোয়া জারি করে। এবার রাজা, জমিদার, প্রজারা সবাই মিলে বিদ্রোহে অংশ নেয়। সামনে থাকে চোয়াড়েরা। গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে ইংরেজ বাহিনীকে। এই যুদ্ধে সামনে থাকত যারা তারা হলো লোধা, শবর, বাগদি, ভূমিজ, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি। বিদ্রোহের মূল কথা ছিল - ‘জান দেবো তবু জমি দেবো না’। চোয়াড়েরা ইংরেজ কাছারি বাড়িতে হানা দিত। পাইকরা নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল ইংরেজদের। ব্রিটিশ সেনাপতি ফার্গুশন বিদ্রোহ দমনের জন্য রানি শিরোমণির কাছে সৈন্য সামন্ত চাইল। শিরোমণি বিনিময়ে টাকা চাইল ইংরেজদের থেকে। ক্ষুব্ধ ফার্গুসন রানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। রানি, জমিদার প্রজার বিদ্রোহের আগুন জ্বলল ১৭৯৮ সালে। বিদ্রোহর সম্মুখে বাগদি সরদার গোবর্ধন দিকপতি। ইংরেজদের এমন অবস্থা করে ছাড়ল চোয়াড়রা যে তারা সেনাবেষ্টনীর বাইরে বেরোতে পারল না। এই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম গণবিদ্রোহ। দালাল, ইংরাজ, অত্যাচারী - কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি বিদ্রোহীরা। ইংরেজরা দেশকে লুট করেছে,এদের দেশ থেকে - জঙ্গলমহল থেকে তাড়াতে হবে। এই ছিল বিদ্রোহের মেজাজ। টাঙি, বল্লমের এই বিদ্রোহ ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম নিম্নবর্গীয় আন্দোলন। পিছিয়ে পড়া শ্রমজীবী, দরিদ্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। পুরুষশাসিত সমাজের একজন দলিত নারী যার মুখ্য চরিত্রে।
চাকমাদের বিদ্রোহ হয়েছিল দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কায়িক পরিশ্রম করে, পাহাড় কেটে ‘ঝুম’ প্রথায় তারা চাষ করত। এমনকী মোগল আমলেও তারা স্বাধীন সত্তা বজায় রেখেছিল ন্যূনতম রাজস্ব হিসেবে ফসল মোগলদের দিয়ে। গোল বাঁধল ১৭৬০ সালে। যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করল। ইংরেজদের হয়ে ইজারাদারেরা চাষিদের কাছ থেকে জোর করে রাজস্ব বাবদ তাদের উৎপন্ন অতিরিক্ত তুলো আদায় করত। এর এক অংশ ইংরেজদের দিয়ে বাকিটা নিজেরা ভোগ করত। এটা ছিল তাদের কষ্টার্জিত সেই কার্পাস তুলো যা সমতলে এসে তারা বিনিময় প্রথায় সমান ওজনের চাল, লবণ ইত্যাদি সংগ্রহ করত। সেই সময়ে ২ টাকা মূল্যের এক মন লবণের জন্য তাদের আট টাকা মূল্যের এক মন তুলো দিতে হতো। ইজারাদারদের দেওয়ার পর পড়ে থাকা উৎপন্ন তুলো দিয়ে বিনিময়ে জীবনধারণের কিছুই জুটত না। ঠকছে জেনেও কিছু করার ছিল না। তাই মৃত্যুবরণের চেয়ে প্রতিবাদ করাই ভালো এই মর্মে তারা বিদ্রোহ সংঘটিত করে। ১৭৭৬-এর মধ্যভাগে বিদ্রোহ শুরু হয়। ইজারাদার আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ইজারাদারদের খাঁটি ব্যাপারিদের দোকান-গোলা লুট করে বিদ্রোহীরা। গেরিলা কায়দায় চাকমাদের যুদ্ধে ইংরেজরা পেরে ওঠে না। তখন কৌশল করে তারা সমতলের বাজার অবরুদ্ধ করে। এই সমতলেই দোকানগুলো ছিল। পাহাড় থেকে নেমে চাকমারা এই দোকানগুলো থেকেই খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করত। এর ফলে চাকমাদের খাদ্য সরবরাহে বাঁধা ঘটল। এই কৌশলেই শেষ অবধি এদের বশ্যতা স্বীকার করালো ইংরেজরা। চুক্তি হলো চাকমারা বছরে ৫০১ মন তুলো ইংরেজদের দেবে রাজস্ব কর হিসাবে। কিন্তু বিদ্রোহ শেষ হলো না। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ চাকমা বিদ্রোহ চলতেই থাকল। ১৭৭৬-১৭৮৯ চাকমা বিদ্রোহ চলেছে। চাকমাদের গেরিলা যুদ্ধের তৎপরতায় কম ইংরেজ সেনাকে মরতে হয়নি। শেষঅবধি বশ্যতা স্বীকার করেছে ইংরেজরা চাকমাদের ইজারা প্রথার অবসান ঘটিয়ে।
ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে বিদ্রোহ একই চরিত্রের ছিল। কোচ, হাজং প্রভৃতি পার্বত্য আদিবাসীরা জমিদারের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল ১৭৩৭, ১৭৪৮, ১৭৬১-তে। বিদ্রোহ চলেছিল ১৮৬৬-তেও। যখন গারো পাহাড় অঞ্চলে খাজনা ধার্য করে জোর করে আদায় করার চেষ্টা করে জমিদারেরা। তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। জমিদারের ঘাঁটিগুলোর উপর রেগেমেগে গারোরা আক্রমণ করে। জমিদার সাহায্য চায় ইংরেজদের কাছে। ইংরেজরা সেনাবাহিনী পাঠায়। লড়াই ঘুরে যায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে। লড়াই হয়। কিন্তু ইংরেজদের আগ্নেয়াস্ত্রর সঙ্গে গারোরা তাদের সামান্য স্থানীয় অস্ত্র উপাদান নিয়ে পাল্লা দিতে পারে না। এরমধ্যে ইংরেজরাও কৌশল করে।তারা কিছু গ্রামকে প্রত্যক্ষ শাসন করতে শুরু করে এক ইয়োরোপিয়ান সামরিক কর্মচারীকে দিয়ে। ক্ষোভকে খানিকটা প্রশমিত করে। ১৭৭৫-এ করিম শাহ বলে একজন ফকির এই এলাকায় বাউল ধরনের এক ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের নাম দেওয়া হয় পাগলপন্থী। সত্যনিষ্ঠ হও এবং সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলো - এটাই ছিল তার ধর্মের মূল কথা।এটাই ছিল উৎপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যের এক রসদ। পরবর্তীতে এই মতে টিপু-গারো ধর্মমত তৈরি হয়। সকল মানুষ সমান - এই বিশ্বাসে। ১৮৩৩ সাল অবধি চলেছিল গারো বিদ্রোহ।
সাঁওতাল বিদ্রোহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আঘাত এনেছে ১৮৫৫- ৫৬ সালে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ। ভারতবর্ষের জমিদারি- মহাজনি যে শোষণ সেই শোষণব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত হেনেছিল এই বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ শেষ অবধি ঘুরে গিয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। এই বিদ্রোহের অন্যতম মূল বিষয় ছিল শুধু সাঁওতাল নয়- শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আন্দোলনের সাফল্য।এটাই আন্দোলনের শিক্ষা ছিল।
বিরসা মুন্ডারা যে বিদ্রোহ করেছিল তার মূল বর্শাফলক ছিল রাজা, জায়গিরদার, জমিদার ও অন্যান্য সামন্তদের বিরুদ্ধে। এরা বাইরে থেকে খাজনাবিহীন স্বত্বে এলাকায় লোক এনে তাদের উৎসাহিত করছিল। এতে মুন্ডা, মানকিদের ক্ষমতা, আধিপত্য খর্ব হচ্ছিল। জমিদারি ব্যবস্থার সঙ্গে নিজ নিজ প্রজাস্বত্ব কায়েম করার জন্য জমিদার শুরু করল ব্যক্তিগত খাজনা। মুন্ডাদের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় এতদিন যারা সম্মানের আসনে ছিল তারা হয়ে গেল মহাজন, খাজনা আদায়কারীদের দাস। এই সময়ে মুন্ডাদের ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আড়কাঠিরা আসামে চা বাগানের কাজে। অসন্তোষ শুরু হয়ে গেল মুন্ডাদের মধ্যে। ১৮৯৫ সালে ছোটনাগপুরে। আওয়াজ উঠল - চাই মুন্ডারাজ। চাই রাজনৈতিক, ধর্মীয় স্বাধীনতা। বিদেশি বিতাড়িত করতে হবে। জমির খাজনা মকুব করো। লড়াই শুরু হয়। জমিদার, বানিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নায়ক বীরসা মুন্ডা। তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এক জেল থেকে আর এক জেলে ঘোরায়। ছেড়ে দেয়।বিদ্রোহ নতুন করে শুরু হয়। তীর, পাথরের লড়াইয়ের সঙ্গে ইংরেজ আগ্নেয়াস্ত্রর। বিরসা ধরা পড়ে। মৃত্যু হয়। সঙ্গীদের কারো ফাঁসি হয়, কারো কারাদণ্ড। অনেকে ছাড়া পায়। বিদ্রোহের সুর পরবর্তী বিদ্রোহগুলির মৃতসঞ্জীবনী হিসেবে থেকে যায়।
১৯৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলনের শুরু। তার আগে ১৯৪৩- এর দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছে বাংলার মানুষ। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা কৃষকদের যন্ত্রণা বুঝে স্লোগান তোলে উৎপাদনের অর্ধেক নয়, তিন ভাগের এক ভাগ পাবে জোতদার। বাকিটা উঠবে বর্গাদার বা ভাগচাষির গোলায়। বাংলার ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন সেই সময় এই মর্মে এক রিপোর্ট তৈরি করেছে যেখানে এই তেভাগার উল্লেখ আছে। এই কমিশনকে ফ্লাউড কমিশন বলেই লোকে জানতো। জলপাইগুড়ি জেলার দেবীগঞ্জ এলাকায় তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয়।
আদিবাসী কৃষকরা তীর, ধনুক, মাদল নিয়ে বিপুল উৎসাহে সারারাত জেগে তেভাগার জন্য অপেক্ষা করত। ভোরবেলায় তেভাগা কখন হবে? এই প্রথা কিছুতেই মানতে চায়না জোতদাররা। তারা পুলিশকে কাজে লাগায়। এই জোতদার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয় বর্গাদারদের। বাংলার তেভাগা সংগ্রামের প্রথম শহিদ দিনাজপুরের আদিবাসী কৃষক শিবরাম মাঝি এবং মুসলিম কৃষক সমীরুদ্দিন। খাঁপুড়ে সংঘর্ষ হয়। ২২ জন কৃষকের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৯ জন আদিবাসী। বালুরঘাটে কৃষকদের উপর গুলি চলে। তার প্রতিবাদে পূর্বাঞ্চল থেকে ঠাকুরগাঁও অবধি যে মিছিল হয় তাতেও গুলি চলে। পাঁচ জন নিহত হয়। দু’জন সাঁওতাল, দুজন রাজবংশী, একজন মুসলমান। যারা সবচেয়ে শোষিত ছিল তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে জাতীয় নেতৃত্ব নিষ্ক্রিয়, নীরব থেকেছে। বামপন্থী কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের আদর্শ এবং বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে।
নীল চাষের শুরু এ দেশে ১৭৭৭ সালে। নীলকরদের আগাম দিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। স্বল্প সুদে সমস্ত নীল নীলকরদের থেকে কিনে নিতো কোম্পানি। এবং সবটা কোম্পানি ইংল্যান্ডে পাঠাতো। নীল চাষে যা খরচ হতো সেই পরিমাণ টাকা চাষি পেত। আর এই দুই খরচের চারগুণ লাভ করত নীলকর। নীল চাষে চাষিদের লাভ ছিল না। লোকসান ছিল। কিন্তু বাংলায় নীলচাষিদের নিজের জমিতে, নিজের খরচে নীল চাষ করতে হতো নীলকরদের চাপে বাধ্য হয়ে। নীলকর ছিল ইংরেজ শাসনের আইন দ্বারা সুরক্ষিত। অত্যাচারী, আধিপত্যবাদের চূড়ান্ত। এর বিরুদ্ধে টানা ৮৪ বছর লড়তে হয়েছে বাংলার চাষিকে। লড়াইয়ের সামনে ছিল কারা? নিম্নবর্গীয় হিন্দু- মুসলমান কৃষকেরা। ইংরাজ সরকারের অত্যাচারে হাত মিলিয়েছিল নানা প্রকরণে জমিদার এবং মধ্যবিত্ত অংশ।
নীলকরদের বিরুদ্ধে যে প্রথম সরবে গর্জে উঠেছিল তার নাম বিশে সরদার। অত্যাচারের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচাতে এক বাহিনী সে গড়ে তুলেছিল। লাঠি, ঢাল, সড়কির বাহিনী। নীলকর সাহেবদের কুঠি আক্রমণ, লুণ্ঠন করা তার কার্যক্রম ছিল। অত্যাচারী কুঠিয়াল স্যামুয়েল ফেডিকে তার বাহিনী নিজে ধরে তাকে কবুল করায় যে সে আর নীলচাষিদের ওপর অত্যাচার করবে না। যদিও সে কথা রাখেনি। বিশ্বনাথ সরদারের বাহিনীর হাতে ইংরেজ বাহিনী নাস্তানাবুদ হতে থাকে। ইংরেজ সেনাবাহিনী বিশ্বনাথকে শেষ অবধি গ্রেফতার করে এবং তাকে ফাঁসি দেয়। তার মৃতদেহ লোহার খাঁচায় ঢুকিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই পচে যায় তার দেহ। হয়তো নিম্নবর্ণীয় বলে ভদ্রলোকের ইতিহাস তাকে ‘বিশে ডাকাত’ বলে অভিহিত করে। নীল বিদ্রোহে তারপরে পরম্পরার ইতিহাস তিতুমীর এবং দুদুমিঞাদের। মতুয়া ধর্মমতের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর পর্যন্ত জোনাসুর কুঠি অভিযান করেন নীলকরের অত্যাচারের হাত থেকে তার কৃষক ও ভক্তদের বাঁচাতে। নীল বিদ্রোহে কৃষকরা ছাড়া অন্যরা অংশগ্রহণ করেনি। কার্যত জাতীয় অভ্যুত্থানের চেহারা নিয়েছে নীল বিদ্রোহ, যাতে নিম্নবর্ণীয় কৃষকদের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় নিম্নবর্ণীয়দের মধ্যে শ্রেণির, ধর্মের, জাতের প্রভাব ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র আক্রমণ, বর্ণীয় আধিপত্যবাদ যত প্রখর হয়েছে নিম্নবর্ণীয় মানুষ এই অংশের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। কংগ্রেসের জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে যখন এদের দেখেছে তখন জাতীয় আন্দোলনের সাফল্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের অশনিসংকেত প্রত্যক্ষ করেছে নিম্নবর্ণীয়রা। ফলে একাংশ নিস্পৃহ থেকেছে। ব্রিটিশ তাড়ানোয় তত স্বার্থ নেই যতটা মুসলমানদের তাড়ানোয় আছে। এই ধর্ম বিকৃতির কারিগররাও ফাঁদ পেতেছিল নিম্নবর্ণীয়দের কাছে। জীবনের অভিজ্ঞতায় এই দুই পথের অসারতায় নতুন পথে স্বাধীনতার খোঁজ করেছে নিম্নবর্ণীয়রা।