৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে যুব জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও বিপদ
মীনাক্ষী মুখার্জি
আকাঙ্ক্ষা একটি নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়।
আবার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করাতেও হয়, সঞ্চারিত করতে হয় জনমানসে এবং তাকে কেন্দ্র করে লক্ষ্য স্থির করতে হয়। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে মাধ্যম, উপাদান ও রসদ একত্রিত করতে হয় এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে পরের লক্ষ্য বা আকাঙ্ক্ষাও নির্দিষ্ট করতে হয়।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর মানে ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া একটা শিশু আজ তার যৌবন পেরিয়ে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। বয়সের ধর্ম হিসেবে নির্দিষ্ট বয়সে নির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। সে সবকিছু পার হয়ে এখন সে হয়তো বা মূল্যায়ন বা নিদেনপক্ষে জীবনের হিসাব-নিকাশ করবে। যদিও ভারতের গড় আয়ু কমেছে। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুসারে ভারতের জনগণের গড় আয়ু ৬৯.৮৯ বছর। পুরুষের গড় আয়ু ৬৭.৪৬ বছর ও নারীর গড় আয়ু ৭২.৬১ বছর।
আবার এতগুলো বছরে অসংখ্য মানুষের যুব জীবন অতিবাহিত হয়েছে। আমাদের দেশ শুধু ৭৫ বছর নয় তারও আগে ২০০ বছরের ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের দেশ। সেই ২০০ বছর যুব ছিল না? সেই সময়ে যুবজীবনের আকাঙ্ক্ষা ছিল না? নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই ছিল। আবার আমরা যখন বলি জীবনের আকাঙ্ক্ষা - তখন ধরে নিই সকলের আকাঙ্ক্ষা একই। কিন্তু তা হয় না। তাহলে বেশিরভাগ যুবর আকাঙ্ক্ষাকে সকলের আকাঙ্ক্ষা বলে স্থির করি। আবার বেশিরভাগ যুবক একই সময়ে একই লক্ষ্য স্থির করতে পারে না। প্রত্যেকের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। ভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধা সমস্যা কোথায় তা খুঁজে দেখতে হয়। সেই সমস্যাকে অতিক্রম করাটাও লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। হয়েও ছিল তাই। সাধারণত জীবনের আকাঙ্ক্ষা কী হওয়া উচিত? নিজে যোগ্যতা দক্ষতা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হওয়া, পরিবার দেশ ও সর্বোপরি সমাজ বিকাশে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সার্বিক উন্নতি। কারণ উন্নতি, বিকাশ, অগ্রগতি এগুলো কখনোই একার আলাদা করে হয় না। এগুলো সার্বিক ও সমষ্টিগত।
ব্রিটিশ ভারতের ২০০ বছরের সকল যুবদের কী আকাঙ্ক্ষা ছিল? অতি সাধারণ। সব যুগের মতই। তখনও আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজ জীবনে সকলে একটু ভালো করে বেঁচে থাকা। এই লক্ষ্যে থাকতে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে। কেউ যা চলছে তার মধ্যে সমস্ত সমস্যাকে না দেখা করে কোনো রকমে বেঁচে থাকে। আবার কারো প্রচলিত ব্যবস্থার সকল প্রতারণা, অত্যাচার দেখেও শুধু নিজেরটুকু দেখে শুনে ভালো করে থাকলেই হয়ে যায়। আবার কিছু মানুষ ছিলেন যাঁরা ওই সময় প্রচলিত ব্যবস্থা পালটে দেবার জন্য বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিলেন। উপরোক্ত তিন ধরনের মানুষই যুব অংশের মধ্যেই ছিল।
যেমন অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক কিংসফোর্ডকে হত্যা করার পরিকল্পনা এবং কাজে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে প্রফুল্ল চাকী কাজ শেষ করে নিজের মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে শহিদ হন। তবু ব্রিটিশদের হাতে ধরা দেননি। আবার ক্ষুদিরাম বোস মাত্র ১৮ বছর বয়সে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন। অপর একজন ছিলেন নরেন গোসাঁই, এই পুরো কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে পরে ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং রাজসাক্ষী হয়ে বাকি বিপ্লবীদের ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কাজ করেছিলেন। কানাইলাল দত্ত ছিলেন আরেক বিপ্লবী বীর যিনি জেলের মধ্যেই নরেন গোসাঁইকে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য গুলি করে হত্যা করেন। অসংখ্য বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশকে স্বাধীন করতে লড়াই করেছেন, করেছেন আত্মত্যাগ। আরএসএস’র সাভারকর যখন মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে নিজের বেরোনোর ব্যবস্থা করেন ব্রিটিশদের বিরোধিতার পরিবর্তে সহযোগিতা করবেন এই কথা দিয়ে, ঠিক তখনই ব্রিটিশরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মাথার দাম ঠিক করছেন। বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেলে আটকে রেখে নির্যাতন-অত্যাচার চালিয়েছে। চিরকালই একটা অংশ দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। সেটা মীরজাফর হোক, নরেন গোসাঁই বা সাভারকর। কিন্তু উলটোদিকে চিরকাল দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেবার লক্ষ্যে অবিরাম আপসহীন লড়াই করে যায় এক অংশ।
ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, মাস্টারদা, চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লা, নেতাজি, গণেশ ঘোষ, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত-এর মতো অসংখ্য সন্তান ছিলেন, তাঁদের নাম আমরা জানি না। ইতিহাসে লেখা নেই। কারণ আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই।
তবে যতটুকুই আছে তাতে এটা বুঝতে অসুবিধা নেই পরাধীন ভারতে যুব জীবন তথা সমগ্র দেশবাসীর সর্বাঙ্গীণ আকাঙ্ক্ষা ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। মুক্তি শোষণ থেকে। অত্যাচার, দারিদ্র্য, লুঠ, অমানবিকতা, কুসংস্কার, অজ্ঞানতা, দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি। অর্থাৎ এগুলি হলো সমস্যা, এই সমস্যার থেকে মুক্তি।
তাহলে সমস্যার কারণ কী? কারণ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা না থাকা। শ্রমের মজুদ বাহিনী হিসাবে কাজ করা। নিজেদের সম্পত্তি অন্যদের সমৃদ্ধির জন্য তুলে দিতে বাধ্য হওয়া এবং নিজেরা দরিদ্রতা-বুভুক্ষার সম্মুখীন হওয়া। অতএব স্বাধীন হতে হবে। নিজেদের সম্পদ নিজেদের সমৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে হবে। লুঠ শোষণকে আটকাতে হবে। প্রান্তিক মানুষকে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভর করতে হবে। গরিব মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। আর এটা তখনই সম্ভব যখন দেশ সঠিক অর্থে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে। যে স্বাধীনতায় অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক সহ সকল স্বাধীনতা থাকবে।
সুতরাং যুব-জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ স্বাধীন হওয়া, যে স্বাধীনতার দ্বারা মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব। আজ তার কাটাছেঁড়া করতে বসলে আমরা কতকগুলি ভয়ানক বিষয়ের মুখোমুখি হতে বাধ্য হবো।
স্বাধীন ভারতে শেষ ৪৫ বছরে বেকারি সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় সম্পদ, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র, ম্যানুফ্যাকচারিং ডিপার্টমেন্ট হয় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে নয় বেঁচে দেওয়া হচ্ছে। নাম দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন। এক ধাপে হঠাৎ করে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে এই জায়গায় ভারত এসেছে। তাছাড়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করা একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে সাধারণত নেতৃত্ব দেবার জায়গায় ছিল, ব্যাংক শিল্পের জাতীয়করণের ধারণা নিয়ে চলা একটা দেশ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন গঠন করার একটা দেশ, এই জায়গায় কী করে এলো? যেখানে ইয়ংগেস্ট কান্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড হওয়া সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ লোক শ্রমের বাজার থেকে সরে যাচ্ছেন। তারা এখন আর কাজ খুঁজছেন না। সম্ভাব্য কারণ তারা কাজ খুঁজে খুঁজে হতাশ হয়ে পড়েছেন। কাজ পাবার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন না। সিএমআইই’র রিপোর্টের ভাষ্য অনুযায়ী - ‘মার্চের শ্রমের পরিসংখ্যান ভারতের অর্থনৈতিক দুর্দশার বৃহত্তম কারণ’। কর্মসংস্থানের হার ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৩৬.৭ শতাংশ, মার্চ মাসে তা কমে হয়েছে ৩৬.৫ শতাংশ। বেকারির হার ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৮.১ শতাংশ, মার্চ মাসে হয়েছে ৭.৬ শতাংশ। স্থায়ী কাজের পরিবর্তে ঠিকা প্রথায় কাজ করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। যেখানে ন্যূনতম শ্রমের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ নেই। এখন অনিশ্চিত জীবন যাপনে বাধ্য এদেশের যুব সম্প্রদায়। নিজের শ্রম ও মগজ নিয়ে সস্তায় বিক্রি করতে ছুটে বেড়াচ্ছে এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য, এমনকী অন্য দেশেও গাল ভরা নাম পরিযায়ী শ্রমিক। এই বিপুল শ্রমশক্তিকে লুট করে নিচ্ছে পুঁজিবাদ। পাহারায় পুঁজিপতিদের বন্ধু সরকার। দেশের শাসক যখন দেশবাসীর বিরুদ্ধে ধনী বন্ধুর হয়ে কাজ করে তখন সে পরাধীন শাসকে পরিণত হয়। এবং শাসক তখন পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশের শাসন- আইন-বিচার-গণতন্ত্র-নির্বাচন সব কিছুকেই জলাঞ্জলি দেয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।
ফলত এক আতঙ্ক-অবসাদ উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশ মানে কখনোই শুধু এক টুকরো ভূখণ্ড নয়, দেশ মানে দেশবাসী, তার সংস্কৃতি, তার কৃষ্টি, শ্রম সব। কিন্তু এসবের বাইরে গিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে দেশবাসীকে কোন ধর্মের, জাতের। তাকে কেন্দ্র করে ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা, সেই ঘটনার সাথেও যুক্ত থাকছে দেশের যুবসমাজ। স্বাধীন দেশে অবাধে লুট চালানোর জন্য গড়ে তুলেছে সুবিধাভোগী, সুযোগসন্ধানী, অসৎ, ফড়ে কিছু অংশ, সেখানেও ভিড় যুবদের।
৭৫ বছর আগে অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবীরা-যুবরা যে উদ্দেশে দেশের স্বাধীনতা আনতে নিজেদের জীবন ত্যাগ করেছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন আজ তাদের উত্তরসূরি হয়ে এক অংশের যুবক সেই স্বাধীনতাকে পরাধীনতার অন্ধকারে নিয়ে যেতে অন্ধকার কানাগলিতে পরিচালিত হচ্ছে পুঁজিপতিদের বন্ধু জনস্বার্থ বিরোধী সরকার ও সিস্টেমের দ্বারা। যুবদের হাতে কাজ, পেটে ভাত, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা, দেশকে- সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার বিপদ এগুলোই। তাই এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চাই। সংগ্রাম ছাড়া এ বিপদের মোকাবিলা করা দুরূহ। যুব জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে গেলে, দেশ বিক্রি, দেশ ভাগ, রাজ্য ভাগ, মানুষে মানুষে ধর্ম, জাতপাতের নামে বিভেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াতে হবে মেরুদণ্ড সোজা রেখে মগজ পরিষ্কার রেখে। দেশের জন্য, দেশের পক্ষে লড়তে হবে দেশের স্বার্থপর শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে - আসলে পরাধীনতার শিকল আবার পরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাই দেশ বাঁচাতে হবে। দেশবাসীকে বাঁচাতে হবে। নিজেকে বাঁচতে হবে সকলকে সাথে নিয়ে।