৬০ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১২ আগস্ট, ২০২২ / ২৬ শ্রাবণ, ১৪২৯
স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ - ‘অমৃত মহোৎসব’
শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়
ভারতের জাতীয় স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে অমৃত মহোৎসবের ডাক দিয়েছেন, ঘরে ঘরে তেরঙা পতাকা তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কী?
ভারতের স্বাধীনতার চরিত্র নিয়ে অবিভক্ত পার্টির অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন বিতর্ক হয়েছিল। আলাপ আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চরিত্র নির্ধারিত হয়েছে দুই কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচির মাধ্যমে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র কর্মসূচিতে বলা হয়েছে ‘‘ফ্যাসিবাদের পরাজয় ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ক্রমবর্ধমান ঢেউয়ের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই গণসংগ্রামের মুখোমুখি পড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও প্রধান বুর্জোয়া দল কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের নেতারা সমঝোতায় উপনীত হয়। ফলশ্রুতিতে দেশ ভাগ হয়ে যায় এবং বুর্জোয়া ভূস্বামী শ্রেণিগুলির নেতৃত্বে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়।’’ সিপিআই তাদের কর্মসূচিতে লিখেছে যেঃ ‘‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতে কংগ্রেস ও পাকিস্তানের মুসলিম লিগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন।’’ এইভাবে স্বাধীনতা এলো।
ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের ছিল তিনটি ধারা। একটি ধারা হলো মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন, যা একটি গণআন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল। আর একটি ধারা হলো বিপ্লবী যুবকদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারা। তাঁরা দেশের মানুষের বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাস করেননি, অত্যাচারী রাজপুরুষদের বিরুদ্ধে ছিল তাঁদের আক্রমণ। ভগৎ সিং, রাজগুরু, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, মাস্টারদা সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ সহ বিপ্লবী যুবকদের অবদান স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিস্মৃত হবার নয়, এদের অনেকের যৌবন কেটেছে আন্দামান সহ বিভিন্ন কারাগারে। অনেকে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন। তৃতীয় ধারা হলো শ্রমিক কৃষকের শ্রেণি ও গণআন্দোলন - যাতে মুখ্য ভূমিকা ছিল কমিউনিস্টদের। ১৯২০ সালে তাসখন্দে যে পার্টির প্রতিষ্ঠা সেই পার্টিকর্মীরা শ্রমিক কৃষকদের সংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯২০ সালে এআইটিইউসি’র প্রতিষ্ঠা, ১৯৩৬ সালে সারা ভারত কৃষক সভার প্রতিষ্ঠা, ১৯৩৬ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা এ দেশে স্বাধীনতার লড়াইকে জোরদার করেছিল। তখন কংগ্রেস ছিল সব দলমতের মিলিত মঞ্চ। তাই জাতীয় আন্দোলনের বরেণ্য নেতৃবৃন্দ অনেকেই এআইটিইউসি বা কৃষক সভার নেতৃত্বে সমাসীন হয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদের পরাজয় আর ভারতের শ্রমিক কৃষকের জাগরণ স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করেছিল।
দেশের মানুষ স্বাধীনতা বলতে কী বুঝেছিলেন আর কী চেয়েছিলেন? ‘‘তাঁরা আশা করেছিলেন দারিদ্র্য ও শোষণের দুর্দশার অবসান ঘটবে। তাঁদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল জমি, খাদ্য, ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা, আবাসন, চিকিৎসার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান। স্বাধীনতার অর্থ ছিল জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার মতো সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্তি, গণতান্ত্রিক এক কাঠামোয় মানুষের সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ।’’ (পার্টি কর্মসূচির ৩.১ ধারা)
স্বাধীনতার ৭৫তম বৎসরে দাঁড়িয়ে আমাদের হিসাব নিকাশ করতে হবে আমরা কোথায় আছি। ভারতের শাসকশ্রেণি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন না করে দেশকে নিয়ে গেল পুঁজিবাদী বিকাশের পথে। সামন্ততন্ত্র ধ্বংস হলো না। ফলে দেশে প্রকৃত ভূমিসংস্কার হলো না। পরিকল্পনা কমিশনের টাস্ক ফোর্স বলল যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দেশে প্রকৃত ভূমিসংস্কার হয়নি। বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে যে সব রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র গড়ে উঠলো তা একসাথে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। তবু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র থাকলে শ্রমিকশ্রেণি, কৃষক সমাজ হস্তক্ষেপ করতে পারে। দেশের মানুষের প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে যদি শিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটে, ভূমিসংস্কারের মধ্য দিয়ে গ্রামে উন্নয়নের ধারা তৈরি হয়।
কিন্তু কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি?
ভারতে সংকুচিত হচ্ছে শ্রমের বাজার। একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে ১৫ থেকে ৬৪ বৎসর বয়সি মানুষের মধ্যে ৪৬ শতাংশ ছিলেন কর্মরত। ২০২১ সালে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। ভারতে কর্মরত মানুষের মাত্র ২০ শতাংশের কোনো না কোনো চাকরি আছে, অর্থাৎ তাদের আছে নিয়মিত বেতন, সঞ্চয় ও ছুটির সুবিধা। অপরদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে আজ ৯৩ শতাংশ কর্মরত। এদের জন্য না আছে কোনো শ্রমআইন, না আছে সামাজিক কল্যাণ প্রকল্প, না আছে চাকরির নিরাপত্তা, এরাই হচ্ছে শ্রমশক্তির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।
যেটা সকলকে ভাবাচ্ছে যে, যেখানে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৯০ কোটির অধিক, সেখানে প্রকৃত চাকুরিজীবী মাত্র ২.৭৩ কোটি। যে পরিবারগুলির ঘর দরকার তাদের ৪০.৬ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে, ৫৬.৮ শতাংশ বিপিএল নয়, কিন্তু মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকার কম।
বর্তমানে কেন্দ্রে রয়েছে বিজেপি-র নেতৃত্বে একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল-সাম্প্রদায়িক সরকার, যারা ধর্মের নামে দেশের শ্রমজীবী মানুষকে ভাগ করতে চায়। এরা হচ্ছে - একচেটিয়া পুঁজির, করপোরেট পুঁজির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। তাই তারা একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে যা শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের স্বার্থবিরোধী। তাই নির্বিচারে চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ। কমছে কর্মীর সংখ্যা। নব্বই-এর দশকে যখন নয়া উদারবাদী অর্থনীতি চালু হলো অর্থাৎ উদারীকরণ, বিশ্বায়ন এবং বেসরকারিকরণ ব্যাপকমাত্রায় প্রয়োগ শুরু হলো তখন শিল্পপতিরা দাবি করেছিলেন যে, ভারতে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো প্রচলিত শ্রমআইন। শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে উপেক্ষা করে যে শ্রম কোড বিল সংসদে পাশ হয়েছে, এক কথায় বলা যায় যে, তার মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষকে দাসত্বের বন্ধনে বেঁধে রাখতে চাওয়া হয়েছে। যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকবে না, মালিক পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে কারখানা বন্ধ করে দিতে পারবে, স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, চুক্তিভিত্তিক মজুরি হবে, ধর্মঘট করার অধিকার থাকবে না। তেমনি ৩টি কৃষি বিল (আন্দোলনের চাপে সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে) কৃষি ক্ষেত্রে করপোরেট পুঁজির আসার পথকে প্রশস্ত করেছে। হিন্দু রাষ্ট্রের নাম করে চলছে এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ। জাতীয় স্বাধীনতার একটা পর্বে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন যে, ভারতে বিপদ কমিউনিজম নয়, বিপদ হিন্দু দক্ষিণপন্থী উগ্র দল আরএসএস। যার রাজনৈতিক শাখা হচ্ছে বিজেপি।
এ দেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শ্রমিকশ্রেণিকে, কৃষক সমাজকে ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে বারে বারে আন্দোলন সংগ্রামের রাস্তায় নামতে হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত ২১ বার সর্বভারতীয় ধর্মঘট করতে হয়েছে। ধর্মঘটের দাবিগুলি ছিল নীতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়া। এখনও সেই দাবিগুলির সমর্থনে যে বিকল্প শক্তি গড়ে ওঠা দরকার তা হয়নি, শ্রেণি চেতনা তথা রাজনৈতিক চেতনা সেভাবে সঞ্চারিত হয়নি। এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মূল কাণ্ডারি হচ্ছে সিআইটিইউ।
ট্রেড ইউনিয়নগুলি যে ৭ দফা দাবি তুলেছে তা হলো -
১। আয়করদাতা নয় এমন প্রতিটি পরিবারের জন্য প্রতি মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা দিতে হবে।
২। ওই সমস্ত পরিবারকে মাথাপিছু ১০ কেজি করে খাদ্যশস্য দিতে হবে।
৩। গ্রামীণ রেগা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ নিশ্চিত করতে হবে, এই প্রকল্প শহরেও চালু করতে হবে।
৪। সংসদে জোরজবরদস্তি পাশ করানো শ্রমকোড বাতিল করতে হবে।
৫। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থায় ঢালাও বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে। বাধ্যতামূলক অবসর প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
৬। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প সহ সর্বজনীন পেনশন চালু করতে হবে।
ঐক্যবদ্ধ কৃষক সংগ্রামের পাশে শ্রমিকশ্রেণি ও গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থন সরকারকে সাময়িকভাবে পিছু হটতে বাধ্য করেছে, কিন্তু মৌলিক নীতি পরিবর্তনের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। দেশজুড়ে বিএমএস এবং তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া সব কেন্দ্রীয় ও রাজ্যভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন যে ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তুলেছে তাকে আরও সংহত ও প্রসারিত করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। একটা চরম প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরাচারী দুর্নীতিগ্রস্ত দল হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। এরা করপোরেট পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী দল। তাই যখনই ভারতে শ্রমিকশ্রেণি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে এরা তার বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিক আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টিকারী, মালিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠন। এই শক্তির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম অব্যাহত আছে।
স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে আমাদের শপথ হবে ভারতের প্রজাতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে। শাসকশ্রেণি যখন গণতন্ত্রের পতাকাকে ধূলায় লুটিয়ে দেয়, শ্রমিকশ্রেণিকে সেই পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে - এটাই হলো ইতিহাসের দায়।