৫৮ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২৯ মাঘ, ১৪২৭
বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প প্রতিষ্ঠার ডাকে মিছিল-সমাবেশে উত্তাল রাজ্য
সিপিআই(এম)’র ডাকে রাধানগর থেকে বরদা চৌকান মহামিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের দশ বছরের অপশাসন, রাজ্য পরিচালনায় সার্বিক ব্যর্থতা, জনবিরোধী নানা পদক্ষেপ এবং শাসকদলের নানা দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি ও হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লাগাতার মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ, অবস্থান ইত্যাদিতে এখন উত্তাল রাজ্য। একই সঙ্গে তৃণমূলের অপদার্থতায় রাজ্যের বুকে বেড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক বিজেপি’র বিভেদের রাজনীতি, হিংসা ও প্ররোচনা ছড়ানো এবং অনৈতিক পথে দল ভাঙিয়ে রাজ্যের শাসন ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টার বিরুদ্ধেও প্রচার আন্দোলনে শামিল লালঝান্ডার কর্মীরা।
রাজ্যে এখন তৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যে নীতি-আদর্শহীন নিরন্তর দল বদলের পালা চলছে। বাজারি সংবাদমাধ্যমে সেই নীতিহীন ঘটনাগুলিকে তুলে ধরার কৌশলী প্রচেষ্টা চলছে, যেন রাজ্যে শুধুমাত্র দু’টি দলই বিরাজ করছে, তখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযন্ত্রণা, রুটি-রুজির সমস্যা, দাবিদাওয়ার বিষয়ের সঙ্গে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করছে বামপন্থী ও সহযোগী দলগুলি। কেন্দ্রের সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দেশের সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আন্দোলনের রেশ ছড়িয়েছে এরাজ্যেও। রাজ্যে কলকারখানা বন্ধ, কর্মচ্যুত ও বেকারের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক ও বেকারদের সমস্যা-সঙ্কট এবং মহিলা, আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের সমস্যা যন্ত্রণার কথা ঘুণাক্ষরেও শোনা যাচ্ছে না তৃণমূল-বিজেপি-র কাছে। ওরা ব্যস্ত ক্ষমতা দখলের নেশায়। তখন বামপন্থী-গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি সমস্ত অংশের মানুষের কথা তুলে ধরে, তাদের স্বার্থে আন্দোলন সংগঠিত করছে। সিপিআই(এম)সহ বামপন্থী ও সহযোগী দল এবং কংগ্রেসের যৌথ প্রচার আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশ ও রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিকল্পের কথা তুলে ধরে বাম-গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং বিভিন্ন গণসংগঠনের প্রচারাভিযান মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করছে। তাই রাজ্যের নানা প্রান্তে সভা-সমাবেশ-মিছিলে জনস্রোত ক্রমশ উত্তাল হতে দেখা যাচ্ছে।
৭ ফেব্রুয়ারি ঘাটালের রাধানগর থেকে বরোদা চৌকান পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটার এক মিছিলে জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। বহু বছর পর ঘাটালে লালপতাকার দৃপ্ত মিছিল লড়াইয়ের নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। এই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম।
এদিন হুগলির তারকেশ্বরেও সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিল, আরএসএস-বিজেপি’র সাম্প্রদায়িকতা, অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি ও তীব্র বেকারির বিরুদ্ধে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশ সফল করার আহ্বান জানিয়ে এক সুবিশাল মিছিল তারকেশ্বরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে। মিছিল শেষে জয়কৃষ্ণ বাজারে সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব, পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ। সভাপতিত্ব করেন পার্টি নেতা স্নেহাশিস রায়।
৫ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এম) গোলগ্রাম এরিয়া কমিটির ডাকে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা ব্লকের করোন্ডা বাজার থেকে গোলগ্রাম পর্যন্ত মহামিছিল হয়েছে। এই অঞ্চল বারবার আক্রান্ত হয়েছে তৃণমূলের সন্ত্রাসে। সেই পরিবেশকে কাটিয়ে মানুষ এখন তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে জোট বাঁধছে। এদিনের চার কিলোমিটার দীর্ঘ মিছিলে বিপুল অংশের মানুষের অংশগ্রহণ সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতির বার্তাই দিয়েছে। এই মিছিল যত এগিয়েছে লালঝান্ডার পরিমাণ বেড়েছে। কুলিরা, চন্দনপুর, খাসকেন্দু বাগিচাতে আদিবাসী মানুষ ধামসা, মাদল নিয়ে যোগ দেয় মিছিলে। সংখ্যালঘু মহিলারা ফুল দিয়ে মিছিলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন মহম্মদ সেলিম সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
মিছিল শেষে গোলগ্রাম বাজার সংলগ্ন মাঠে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন মহম্মদ সেলিম, তাপস সিন্হা, সুভাষ দে, নলিনী হেমব্রম। সভাপতিত্ব করেন রবীন দত্ত।
‘ফেরাতে হাল, ফেরাও লাল’ এই স্লোগানে মানুষের রুটি-রুজি, বেকারদের কর্মসংস্থান, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ, রাজ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরির ডাক দিয়ে ডিওয়াইএফআই-র ডাকে শ্যামবাজার থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত বাইক মিছিলে স্পন্দিত হয় কলকাতার রাজপথ। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে এই বাইক মিছিলের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় নেতা ও বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। এছাড়া ৭ ফেব্রুয়ারি শালবনিতে শিল্পায়নের দাবিতে ছাত্র-যুবদের বাইক মিছিল হয়েছে।
৯ ফেব্রুয়ারি তৃণমূল সরকারকে উৎখাত এবং বিজেপি-কে রোখার আহ্বান জানিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ায় বাম-কংগ্রেসের এক দৃপ্ত মিছিল সংগঠিত হয়। এই মিছিলে অংশ নেন বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী, কংগ্রেস নেতা দেবপ্রসাদ রায়, সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম, এসএফআই নেত্রী দীপ্সিতা ধর প্রমুখ।
এই মিছিলগুলি ছাড়াও ৭ ফেব্রুয়ারি হাওড়ার সাঁকরাইল ও বালিতে দু’টি বিশাল জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি সমাবেশ দু’টিতে বলেছেন, বিজেপি এবং তৃণমূল নিজেদের লুটের সম্পদ রক্ষা করতে জনগণের চোখের সামনে কদর্য ঝগড়ার অভিনয় করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে বামপন্থীরাই লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছেন। কংগ্রেস এবং অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে নিয়ে বামপন্থীরাই আগামীদিনে রাজ্যে সরকার গঠন করবে এবং মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিকল্প নীতি রূপায়ণ করবে।
৫ ফেব্রুয়ারি কাকদ্বীপের বাসন্তী ময়দানে বাম ও কংগ্রেসের ডাকে এক বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি এই সমাবেশে বলেন, মানুষের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রেখে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে বিজেপি। এর দোসর হয়েছে তৃণমূল। মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে ফ্যাসিবাদী কায়দায় ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে চাইছে বিজেপি-আরএসএস। তাই বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধী সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী ময়দানে নামতে হবে। তিনি বলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেসকে হটিয়ে, বিজেপি-কে পরাস্ত করে বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।
পার্টিনেতা রাম দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান, সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী, কান্তি গাঙ্গুলি প্রমুখ।