E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২৯ মাঘ, ১৪২৭

পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়ে মিছিল সমাবেশে লাল পতাকার সমারোহ

তৈরি হচ্ছে লড়াই-আন্দোলনের নতুন আবহ

সন্দীপ দে


বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে নন্দীগ্রামে বামপন্থীদের মিছিল।

এক সময়ের তৃণমূলের সন্ত্রাসে অবরুদ্ধ পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় আজ লালঝান্ডার মিছিল-সমাবেশ এক নতুন আবহ সৃষ্টি করছে। রাজ্যের শাসকদলের ডাকসাইটে নেতার সদলবলে কেন্দ্রের শাসকদলে পাড়ি জমানো নিয়ে তরজা-হইহুল্লোড়ের মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবন যন্ত্রণা, অভাব অভিযোগ, দাবি-দাওয়ার কথা বাজারি সংবাদ মাধ্যমে আড়ালে চলে গেলেও, তা সোচ্চারে তুলে ধরছেন বামপন্থীরা। তাই সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের সভা-সমাবেশ-মিছিলে লাল পতাকা নিয়ে মানুষের উপস্থিতির মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। জেলায় আজ এই দৃশ্য খুব সহজেই চোখে পড়লেও একটা সময় ছিল যখন এমন ছবি সচরাচর দেখা মিলত না। বিশেষ করে ২০০৭ সালে মাওবাদী সহ নানা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আজকের শাসকদল তৃণমূল কং‍‌গ্রেস ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নামে যে খুন-সন্ত্রাস-অবরোধ ইত্যাদির নজির তৈরি করেছিল, তখন এদের সমস্ত আক্রমণের লক্ষ্যই ছিল সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা। সোনাচূড়ায় সিপিআই(এম) কর্মী শঙ্কর সামন্তকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনার মধ্যদিয়ে এই জেলায় যে বর্বরতার অভিযান শুরু করেছিল তৃণমূল, তাতে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ, গণতান্ত্রিক আবহাওয়া থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্পূর্ণরূপে ভুলুণ্ঠিত হয়েছিল। এদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই ধরনের হিংস্রতা ও ধ্বংসাত্মক কাজকর্মের মধ্য দিয়ে রাজ্যের শিল্পায়ন, উন্নয়নের কর্মকাণ্ডকে বানচাল করে বামফ্রন্ট সরকারকে কালিমালিপ্ত করা, যে কোনো মূল্যে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা। এই লক্ষ্যে একদিকে যেমন চলেছে নির্বিচার হিংসা-সন্ত্রাস, অন্যদিকে লাগামহীন কুৎসা-অপপ্রচার। এদের এই সন্ত্রাসের মাত্রা আরও তীব্র হয়েছিল ২০১১ সালে রাজ্যের শাসনক্ষমতা দখলের পর।

আজকে ঘৃণ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, নিজের পিঠ বাঁচাতে তৃণমূলের ডুবন্ত তরী থেকে বিজেপি’র আশ্রয়ে যাওয়া একসময়ের ‘দৌর্দণ্ডপ্রতাপশালী’ নেতা শুভেন্দু অধিকারী সদম্ভে হুমকি দিয়েছিল, জেলায় লালপতাকা উড়তে দেওয়া যাবে না। তার নেতৃত্বে বামপন্থীদের ওপর আক্রমণ, খুনের অভিযানের পাশাপাশি শুরু হয়েছিল সিপিআই(এম)সহ বামপন্থীদের একের পর এক দলীয় অফিস, ঘর বাড়ি লুঠপাট, দখল, অগ্নিসংযোগ করে তাঁদের এলাকা ছাড়া করা। এই ভয়াবহতার মধ্যেও যারা আপন ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়েছিলেন, গরিব-মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে তাঁদের দিতে হয়েছিল বিপুল অঙ্কের জরিমানা। বামপন্থী কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক চলাফেরা, স্কুল-কলেজ-অফিস-কাছারিতে যাওয়া, দোকানবাজার ইত্যাদির ওপর নেমে এসেছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট কেটে, পথ অবরোধ করে তখন তৃণমূলের এই দুর্বৃত্তবাহিনী অন্ধকারের রাজত্ব নামিয়ে এনেছিল জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। এরা মহিলাদের সম্মান-সম্ভ্রম পর্যন্ত লুঠ করেছিল। এই সময়কালে এবং পরবর্তী সময়ে এদের হিংস্র আক্রমণে জীবন দিতে হয়েছে ৭০ জনের মতো বামপন্থী নেতা-কর্মী-সমর্থককে।

একটা দীর্ঘ সময় এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যে কাটাতে হয়েছে এ‍‌ই জেলার মানুষকে। কিন্তু নিদারুণ অত্যাচার-নিপীড়ন ও রক্ত ঝরিয়েও অকুতোভয় লালঝান্ডার কর্মীরা হাল ছাড়েননি। তাঁরা লালঝান্ডা নিয়েই নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন গরিব সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেলায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার বদল ঘটাতে। এই প্রচেষ্টা সহজ ছিল না। অনেক প্রতিবন্ধকতা, নানা হুমকি-আক্রমণ-সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে ধীরে ধীরে জেলা জুড়ে লাল পতাকার বিস্তৃতি ঘ‍‌টেছে। শাসকদলের ভয়াবহ সন্ত্রাস-অত্যাচারে বিধ্বস্ত-অবরুদ্ধ নন্দীগ্রাম-খেজুরি সহ জেলার সন্ত্রাস কবলিত সমস্ত অঞ্চলেই আজ মানুষ ভয়-ভীতি কাটিয়ে ধীরে ধীরে শামিল হচ্ছেন লালঝান্ডার মিছিলে, বিভিন্ন কর্মসূচিতে। একদিকে করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, লকডাউনে রুটি-রুজির তীব্র সংকট, অন্যদিকে আমফান ঝড়ে হাজার হাজার মানুষের বিপন্নতা - এই অসহনীয় অবস্থার মধ্যে সরকার ও শাসকদলের দেখা মেলেনি। শুধুমাত্র বামপন্থীরাই তাদের সাধ্যমতো ত্রাণ ও অন্যান্য সাহায্য নিয়ে বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

করোনা মোকাবিলায় প্রচার

২৪ মার্চ রাজ্যে লকডাউন ঘোষণার পর জেলায় পার্টির উদ্যোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচার শুরু হয়। সেই সঙ্গে এলাকায় এলাকায় চাল, ডাল সহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী, মাস্ক, স্যানিটাইজার বণ্টনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হয় - জনগণের সুরক্ষা ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিতে হবে; ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী-সমাজসেবীদের জন্য স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান, করোনা আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে; কাজ হারানো অসহায় মানুষদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি। এই সময়ে সাধারণ মানুষ দেখেছেন তাঁদের পাশে রয়েছেন একমাত্র বামপন্থীরাই। টিভি, সংবাদমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর বিস্তর বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও শাসকদল বা প্রশাসনকে দেখা যায়নি বিপন্ন মানুষদের পা‍শে।

আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে পার্টি

করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার মধ্যেই ২০মে ঘূর্ণিঝড় আমফানের প্রলয়ঙ্কর তাণ্ডবে রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তের মতো এই জেলাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশপ্রাণ, হলদিয়া, মহিষাদল সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় চরম দুর্দশার কবলে পড়েন মানুষ। এই অবস্থায় পার্টি কর্মীরা তাদের সীমিত সাধ্য নিয়ে দুর্গত মানুষদের ত্রাণ ও সাহায্যে এগিয়ে আসেন। পার্টিকর্মীরা অর্থ সংগ্রহ অভিযানে নামেন। পার্টিকর্মীদের এই আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা সংগৃহীত হয়। সন্ত্রাস কবলিত খেজুরি এলাকা থেকেই প্রায় ৪ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন পার্টি কর্মীরা। এই টাকায় প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী, ত্রিপল, জামাকাপড়, বেবি ফুড, পানীয় জল ইত্যাদি তুলে দেওয়া হয় দুর্গত মানুষদের হাতে। পার্টির রাজ্যস্তর থেকেও ত্রাণ ও সাহায্য করা হয়েছে। এক একটি ব্লকে প্রায় তিন থেকে চারশো অসহায় মানুষের জন্য রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এই উদ্যোগ চলে দীর্ঘদিন। আমফান-বিধ্বস্ত মানুষদের জন্য তৃণমূল বা বিজেপি কারও কোনো উদ্যোগ ছি‍ল না। অথচ সরকারি ত্রাণ যেটুকু এসেছে, তা বণ্টনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ স্থানেই শাসকদলের স্থানীয় মাতব্বররা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত করে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আত্মীয় পরিজন ও দলীয় কর্মীদের নাম তালিকাভুক্ত করে। এই দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে পার্টির উদ্যোগে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নানা দাবি-দাওয়া নিয়েও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে বিডিও শাসকদলের স্থানীয় নেতা-মাতব্বরদের সঙ্গে মিলে ত্রাণের অর্থ ভাগ করে নিয়েছে। এই অভিযোগ ব্লক স্তরে এসডিও-র কাছে পেশ করেই বসে থাকেননি পার্টি নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ডিএম-র কাছেও স্মারকলিপি দিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের দাবি জানান। ডিএম-র কাছে লিখিত অভিযোগ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের ঝড়ে-বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির ছবি এবং অন্যান্য নথিও পেশ করা হয়। অবশেষে পার্টির দাবিতে অভিযোগের সত্যতা উপলব্ধি করে ডিএম ব্লকে ক্ষতিগ্রস্তদের আবেদনের সময় সীমা বাড়ানোর এবং সিল, স্ট্যাম্প দিয়ে আবেদনপত্র গ্রহণের নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে নির্দেশ দেন তৃণমূলীদের ভাগ করে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে হবে। ডিএম-র এই নির্দেশের ফলে জেলার বিভিন্ন জায়গায় অন্যায়ভাবে নেওয়া টাকা ফেরতের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পার্টির উদ্যোগে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি দেবার সময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক উপস্থিতিকে ছাপিয়ে তা ২৫-৩০ জন থেকে ২৫০-৩০০ জন মানুষের উপস্থিতিও দেখা গেছে। ডিএম-র এই সদর্থক পদক্ষেপের ফলে চূড়ান্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয় শাসকদলকে। শেষ পর্যন্ত জেলা তৃণমূলের নেতা-মাতব্বরদের দুর্নীতির কলঙ্ক ঢাকতে নবান্নের নির্দেশে সেই ডিএম-কে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ও আনুষঙ্গিক নথি দিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। এই মামলায় রায় হয়েছে আবেদনকারীদের পক্ষে।

বর্তমানে ডিএম-র দায়িত্বে যিনি এসেছেন, তিনি শাসকদলের নির্দেশ অনুযায়ী চলছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য দিতে ঢিলেমি করে যাচ্ছেন। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে।

নন্দীগ্রামে পার্টির উদ্যোগ

পূর্ব মেদিনীপুর জেলাজুড়ে লালপতাকা নিয়ে পার্টির লাগাতার আন্দোলন-কর্মসূচি, দাবি-দাওয়ার লড়াই সন্ত্রাসের পরিবেশকে ছিন্ন করে মুক্ত আবহ তৈরিতে সাহায্য করেছে। সাধারণ মানুষের স্বার্থে রুটি-রুজির লড়াই বিপুল অংশের মানুষকে পার্টির পতাকাতলে সমবেত করতে সাহায্য করেছে। তারই প্রভাবে নন্দীগ্রাম, খেজুরি সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূলীদের কব্জায় চলে যাওয়া পার্টি অফিসগুলো ক্রমান্বয়ে খুলছে। উদ্ধার হওয়া পার্টি অফিসগুলিকে ঘিরে এখন আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে দৈনন্দিন কর্মসূচি। এগুলির অন্যতম হচ্ছে নন্দীগ্রাম বাজার সংলগ্ন পার্টি অফিসটি। এই অফিসটি একটা সময়ে ছিল পার্টির জোনাল কমিটির দপ্তর। বেশ কয়েকবার এই অফিসটি আক্রান্ত হয়। তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা এই অফিসটি আক্রমণ করে চেয়ার-টেবিল সহ আসবাবপত্র ভাঙচুর, লুট করে। এমনকি অফিসটিতে আগুন পর্যন্ত ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের ফলে দীর্ঘদিন অফিসটি খোলা সম্ভব হয়নি। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ৮ এপ্রিল পার্টি অফিসটি দখলমুক্ত করা হয়েছিল। তার এক সপ্তাহের মধ্যে আবার এটা আক্রান্ত হয়। তারপর ২১ এপ্রিল, ২০১৯ পার্টির জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহির নেতৃত্বে পার্টিকর্মীরা লালপতাকা নিয়ে বিপুল সংখ্যায় জমায়েত হয়ে পার্টি অফিসটি দুর্বৃত্তদের দখল থেকে মুক্ত করেন। তারপর থেকেই এই অফিসকে ঘিরে ধারাবাহিকভাবে পার্টির এরিয়া কমিটির কার্যক্রম চলছে।

এখনও কিছু জায়গায় তৃণমূলের দৌরাত্ম্য রয়েছে। তবুও পার্টির কার্যকলাপ থেমে নেই। লকডাউন এবং আমফান ঝড়ে আক্রান্তদের সাহায্যে ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন পার্টিকর্মীরা। এই অঞ্চল থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা সংগৃহীত হয়েছে।

আমফান ঝড়ের তাণ্ডবের পর প্রায় একমাস এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। করোনা ও আমফান বিপর্যস্ত এমন প্রায় ২,৫০০ পরিবারকে চাল, ডাল সহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, ত্রিপল, ওষুধপত্র দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এখানে সাহায্য এসেছে সিআইটিইউ’র রাজ্য কমিটি সহ দমদম এবং টালিগঞ্জের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। পার্টিকর্মীরা এই সমস্ত ত্রাণসামগ্রী তুলে দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষদের হাতে।

নন্দীগ্রামের অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক কর্মরত ছিলেন ভিন্‌রাজ্যে। লকডাউনে কাজ হারিয়ে তাঁরা এলাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের যথাসাধ্য সাহায্যে এগিয়ে আসেন পার্টিকর্মীরা। তাঁদেরই মধ্যে একজন পরিযায়ী শ্রমিক‍‌ গোলাম মোর্তাজা। তাঁর কাছে জানা গেল দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা। ওরা ৩০-৩৫ জন নাগপুরে দর্জির কাজে যুক্ত ছিলেন। আকস্মিকভাবে সেই কাজ চলে যাওয়ায় যার যেটুকু আর্থিক সম্বল ছিল তা দিয়ে ট্রাকে করে নিদারুণ কষ্ট করে ফিরে আসতে হয়েছিল। প্রায় দু’দিন কোনো খাবার মেলেনি। এখানে ফেরার পর স্থানীয় প্রশাসন তাদের একটি ফাঁকা স্কুলবাড়ি দেখিয়ে দিয়ে দায় সেরেছে। সেটাই ছিল সরকারিভাবে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। অথচ সেখানে ছিল না বিদ্যুৎ, পানীয় জল, খাবার ও থাকার ন্যূনতম ব্যবস্থা। তিনি জানালেন, এই অবস্থায় স্থানীয় পার্টিকর্মীরা সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তাঁদের আন্তরিক উদ্যোগে এবং সাহায্যে সেই যন্ত্রণার দিনগুলি পার করতে পেরেছেন তাঁরা। এই পরিযায়ী শ্রমিকরা দেখেছেন লালঝান্ডার কর্মীরা কীভাবে মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা ও অসহায়তার মুহূর্তে মানবিক আদর্শে দাঁড়ান মানুষের পাশে। তাই তাঁদের অধিকাংশই আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছায় লালপতাকা তুলে নিয়ে শামিল রয়েছেন পার্টির প্রতিদিনের কর্মসূচিতে - লড়াই-আন্দোলনের ময়দানে।

এখানেও বিপন্ন অসহায় মানুষদের ত্রাণবণ্টন ও সাহায্য নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়েছে শাসকদল। এর বিরুদ্ধে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে পার্টি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের দাবি নিয়ে টেঙ্গুয়া থেকে বিডিও অফিস পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মানুষের বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করেছে পার্টি।

২৬ নভেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের ভা‍‌লো প্রভাব পড়ে এখানে। ধর্মঘটকে সফল করার বার্তা নিয়ে চণ্ডীপুর থেকে নন্দীগ্রাম পর্যন্ত বাইক র‌্যালিতে অসংখ্য ছাত্র-যুব অংশ নিয়েছেন। এর পাশাপাশি ৮ ডিসেম্বর কৃষি আইনের প্রতিবাদে গ্রাম বন্‌ধেও ভালো সাড়া পড়ে এখানে।

এর আগে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে এখানে। ৩১ আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহিদ দিবস পালন করতে গিয়ে মহম্মদপুরে আক্রান্ত হন স্থানীয় পার্টিনেতা মহাদেব ভুঁঞ্যা, দেবেশ ভুঁঞ্যা, সেখ নইমুদ্দিন, সেখ সামাদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এই আক্রমণ সত্ত্বেও সামসাবাদ সহ নন্দীগ্রামের বেশ কয়েকটি এলাকায় এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে নন্দীগ্রাম থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে স্থানীয় পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উলটে আক্রান্তদের নামেই মিথ্যা মামলা দায়ের করে। স্থানীয় প্রশাসন এভাবে শাসকদলের অনুগত হয়ে পার্টির কর্মতৎপরতাকে বানচাল করতে প্রতিনিয়ত অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও পার্টিকর্মীদের মনোবল ও সাহস এতটুকু শিথিল হয়নি। বরং তাঁরা বিপুল উৎসাহ নিয়ে লালপতাকার অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।

আগামী লড়াইয়ের প্রস্তুতি

এইসময়ে এই জেলায় সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের প্রচার ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অসংখ্য মানুষকে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। এই মানুষেরা প্রতিনিয়ত লক্ষ করছেন, অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করছেন রাজ্যের শাসকদলের শিবির বদল, সাম্প্রদায়িক বিজেপি’র নানা অপকৌশলে দল ভাঙানোর খেলা বাজারি মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে প্রচার আন্দোলনে রয়েছেন একমাত্র বামপন্থীরাই। তাই লালঝান্ডার প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের জোয়ারে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে দখল হয়ে যাওয়া পার্টি অফিসগুলি পুনরুদ্ধার করে আবার সেগুলিতে জনসমাগম বাড়ছে। খেজুরির বাঁশগোড়া বাজার, কামারদা, কলাগাছিয়া, নন্দীগ্রামের বাজার সংলগ্ন মূল পার্টি অফিস সহ দাউদপুর সামসাবাদ, মুগবেড়িয়ার বরোজ, মেচেদার শান্তিপুর, হলদিয়ার ক্ষুদিরামনগর প্রভৃতি অঞ্চলে অসংখ্য পার্টি অফিসে আজ লালপতাকা উড়ছে। এই অফিসগুলিকে কেন্দ্র করে পার্টি ও বামফ্রন্টের দৈনন্দিন প্রচার কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে জেলাজুড়ে লালঝান্ডার পক্ষে এক নতুন আবহ, কর্মীদের মনে নতুন প্রেরণা সঞ্চারিত হয়েছে। তাই সাম্প্রতিককালে কাঁথি ও হলদিয়া সহ বিভিন্নস্থানে যে সমাবেশ-মিছিলগুলি হয়েছে তাতে ভয়-সন্ত্রাসের আগল ভেঙে মানুষের নতুন নজির গড়ার প্রত্যয় পরিলক্ষিত হয়েছে। সর্বশেষ কেন্দ্রের সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে চাক্কাজ্যাম কর্মসূচিতে জেলায় ১৪টি স্থানে অবরোধ- বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। জেলায় এসব চিত্রই জানান দিচ্ছে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামে লালপতাকার পদাতিকরা অসীম সাহস আর দৃঢ়তা নিয়েই প্রস্তুত হচ্ছেন ঘরে ঘরে।