৫৮ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২৯ মাঘ, ১৪২৭
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গণআন্দোলনের সংবাদ
সংবাদদাতাঃ সৌম্যদীপ রাহা
কোভিড-১৯ জনিত প্যানডেমিক ব্যবস্থায় সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগুলিকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়ে, কৃষির সঙ্গে যুক্ত, রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাদেশ গত বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৫ জুন ‘The Gazette Of India’-এর মাধ্যমে জারি হলো। ঐ তিনটি বিল হলোঃ ১) The Farmer’s Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill 2020, ২) The Farmer’s (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Bill, 2020, ৩) The Essential Commodities (Amendment) Ordinance, 2020। এই তিনটি কৃষি বিল ‘নয়া-উদারবাদী’-র সংস্কার হিসাবে সরকারের আগ্রাসী মনোভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে দেশের কৃষক সমাজের উপর।
দেশের সর্বত্র এর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে। আমাদের রাজ্যের সব জেলাতেই কৃষকদের ওপর নামিয়ে আনা এই পরিকল্পিত আক্রমণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। অতীতের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে, সেই তেভাগার লড়াই থেকে শুরু করে প্রথমে অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা ও পরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা আজকের এই আন্দোলনেও তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। জেলার পাঁচটি মহকুমা-আলিপুর, বারুইপুর, ডায়মন্ডহারবার, কাকদ্বীপ ও ক্যানিং-এ অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিবাদ কর্মসূচি, সংগঠিত হচ্ছে কৃষকরা। গত ৮ ডিসেম্বর ২০২০-এর ভারত বনধ্ উপলক্ষে জেলায় সংগঠিত হয়েছে ব্যাপক প্রচার, মিছিল। বনধের দিন সকালে ব্লকগুলিতে এবং শহরে হয়েছে মিছিল ও অবরোধ। এরপর ১৬ ডিসেম্বর এআইকেসিসি’র ডাকে রাজভবন অভিযানে শিয়ালদহ থেকে রানি রাসমণিতে মিছিলে জেলার ৪৫০০-রও বেশি কৃষক সহ গণতন্ত্রপ্রিয় সচেতন মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ১ জানুয়ারি পাথরপ্রতিমার রামগঙ্গা বাজারে কৃষি বিলের প্রতিবাদে মিছিল ও বিল পোড়ানো হয় । উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবাশিস দে, সত্যরঞ্জন দাস প্রমুখ সহ এলাকার কৃষক ও সাধারণ মানুষ। এরপর এআইকেএসসিসি-র ডাকে ২০, ২১ ও ২২ জানুয়ারি কলকাতায় অবস্থান বিক্ষোভ। ২১ জানুয়ারি রাত্রে আমাদের জেলার কর্মীরা অবস্থান করেন এবং ২২ জানুয়ারি তারা ও আরও অনেকে শিয়ালদহ থেকে মিছিল করে ওয়াই-চ্যানেলে অবস্থানে যোগ দেন। ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে জেলার গ্রাম ও শহরাঞ্চলে কর্মসূচি পালিত হয়। বারুইপুর ও সাগর ব্লকে ট্রাক্টর সহ মিছিল হয়। বারুইপুরে উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, রাহুল ঘোষ, অলোক ভট্টাচার্য, গৌতম চক্রবর্তী, খালেক ঢালী প্রমুখ সহ কৃষক ও সাধারণ মানুষ। এছাড়া ভাঙরের ভোজেরহাট থেকে সোনারপুরের শামুকপোতা পর্যন্ত বাইক মিছিল সহ অন্য জায়গাগুলিতে মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। গত ৩১ জানুয়ারি এআইকেএসসিসি-র ডাকে জেলার গ্রামাঞ্চলে এবং শহরাঞ্চলগুলিতে কৃষক আন্দোলনের উপর দমনপীড়নের প্রতিবাদে পথসভা, মিছিল, মোদীর কুশপুতুল দাহ কর্মসূচি পালিত হয়। এছাড়া জেলার ৩০টি স্থানে চাক্কা জ্যাম কর্মসূচি পালিত হয়। সেখানে সাধারণ মানুষজনের স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত ছিল।
আমাদের কৃষিনির্ভর দেশে কর্পোরেটদের ঋণমকুব হয়ে যায় কিন্তু কৃষকদের হয় না। প্রতি ১২মিনিট ৩৭ সেকেন্ড অন্তর আমাদের দেশে একজন করে কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দিল্লিতে কৃষকরা যে অবস্থান করছেন, তাঁদের এই সংগ্রামই তাঁদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন। শাসক বুঝেই গেছে যে, তাদের পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে গেছে। যখন আক্রমণ নেমে আসে কৃষির উপর তখন আক্রান্ত শুধু কৃষকরাই হন না, আক্রান্ত হন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। তাই দেশ আর রাজ্য তো আছে, আমাদের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলাতেও দেখা যাচ্ছে কৃষক সহ প্রায় সমস্ত অংশের মানুষের মধ্যে শাসক বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠছে।
দীর্ঘ লকডাউন পর্ব থেকে আনলক্ পর্বের আগে পর্যন্ত প্রায় শতাধিক শ্রমজীবী ক্যান্টিন চলেছিল। এখনও আটটি শ্রমজীবী ক্যান্টিন চলছে আমাদের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলাতে। তাতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা খুবই উল্লেখযোগ্য।
সামনে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন। এই দু’টি সরকারের একটি ‘আত্মনির্ভর’ আরেকটি ‘উন্নয়ন’ নামক ভাঁওতা প্রচারের মুখোশ উন্মোচন করতে শপথ নিচ্ছেন প্রতিটা সচেতন নাগরিক। তার ইঙ্গিত এখন থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, আমাদের জেলার প্রতিটা বুথে বুথে সংগঠিত প্রতিবাদে, প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রামে পাশে পেয়েছেন বামপন্থী কর্মীদের। এই ধারাবাহিক সংগ্রামে তাঁরা বুঝেছেন, একমাত্র বামপন্থীরাই তাঁদের সঙ্গী। সেই কথা তাদের কর্মস্থল থেকে আড্ডার আলোচনায় উঠে আসছে। রুটি - রুজি আর বেঁচে থাকার এই আন্দোলন প্রতিনিয়তই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।