৫৮ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২৯ মাঘ, ১৪২৭
এবিটিএ-র গৌরবময় শতবর্ষ পূর্তি ও ফিরে দেখা
অমর বন্দ্যোপাধ্যায়
শতবর্ষ পূর্তি সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন সুজন চক্রবর্তী।
বহু সংগ্রামের গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি (এবিটিএ) একশো বছর অতিক্রম করল। শুধু সমিতির জীবনে নয়, ভারতের শিক্ষা আন্দোলনের জগতে ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-অভিভাবক সমাজের কাছে এবিটিএ এক এবং অদ্বিতীয় নাম। ১৯২১ সালে বাংলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু করেন। রুশ বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। সমাজ পরিবর্তনের সেই ভাবনাকে পাথেয় করে অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাই স্কুলে এবিটিএ’র প্রতিষ্ঠাতা সম্মেলনের সভাপতি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন - এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা যখন পঁচিশ হাজার হবে, তখন কোনো বিরুদ্ধ শক্তি এর গতিপথ রুদ্ধ করতে পারবে না। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে পথ চলা শুরু করে এবিটিএ। সেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার পথ থেকে এবিটিএ-কে একচুলও নড়াতে পারেনি কেউ।
সেজন্য ১৯২১-এর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ এবং রামমোহন-বিদ্যাসাগরের শিক্ষা সংস্কারের দীপ্ত উদ্বেলিত প্রান্তরে আমাদের পৌঁছতেই হবে। সাম্রাজ্য রক্ষা ও শাসনের জন্য ব্রিটিশ ইংরেজি শিক্ষা এবং আধুনিক শিক্ষার প্রবর্তন করেছিল, কিন্তু উপনিবেশিক শাসকশ্রেণির স্বার্থ সংকীর্ণ চিন্তাকে জাতীয় চিন্তাভাবনার সাথে খাপ খাওয়ানো যেতে পারে কতটা, তা নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষার নতুন রূপ দিলেন। তিনি সেদিনের বাতাবরণের উপযুক্ত এক আন্দোলনের ডাক দিলেন। এই আন্দোলন প্রাচ্য শিক্ষায় নতুন ধারার নতুন আঙ্গিকের সৃষ্টি করেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ নতুন এক শিক্ষক সমাজের সৃষ্টি হয়। সেই শিক্ষক সমাজের অবস্থান, জীবনচর্চা, চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষাদর্শনে ফরাসি বিপ্লবের ঢেউ লাগে এবং এরা অনুপ্রাণিত হয় রুশ বিপ্লবের দেখানো পথে। এদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ভাবনা মধ্যযুগের স্কুল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয় এবং পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবনা তাদের প্রাচীন যুগ থেকে স্বতন্ত্র করে দেয়। এই শিক্ষক সমাজ মধ্যবিত্তের বিপুল অংশকে যেমন প্রভাবিত করল, একই সঙ্গে শিক্ষক সমাজ নিজে নতুন যুগের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজসেবী, ধর্মসংস্কারক ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হলো।ফলত, বঙ্গদেশে যুক্তিবাদী এবং মানব ধর্মের ধারাবাহিকতার পথের উন্মেষ ঘটে। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়-১৯০১ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা এই সমস্ত কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।এর ফলশ্রুতিতে জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ শিক্ষিত মানুষদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশীয় বিদ্যালয়। নারী শিক্ষা প্রসারে ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য অধিক সংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপনে এগিয়ে আসেন মানুষ।
সমাজের বিভিন্ন অংশের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত করার বাসনার পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রতি বিক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছিল। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্বাদেশিকতার চেতনা জাগতে থাকে। স্বাদেশিকতাবোধ জাতীয় শিক্ষাভাবনার উন্মেষ ঘটায় এবং দিকে দিকে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে উঠতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের এই জোয়ারের স্রোতে জাতীয় শিক্ষার দাবি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায় এবং শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হিসাবে এবিটিএ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মতলার সুবিশাল সমাবেশে স্মৃতিচারণ করছিলেন শতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। রাসমণি রোডে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। তিনি বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই যুক্ত ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।পরবর্তীকালে যুক্ত হন হীরেন্দ্র নাথ রায়, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, সত্যপ্রিয় রায় ও অনিলা দেবীর মতো নেতৃত্ব। এদের নেতৃত্বে আন্দোলনে গতিসঞ্চার ঘটে। বক্তৃতা করতে করতে কিছুটা নস্টালজিক বিমান বসু বলেন, ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকদের বিক্ষোভ সমাবেশ দেখতে গেছি। চুয়ান্নর স্মরণীয় আন্দোলন দেখেছি। পরবর্তীকালে শহিদ হতে দেখেছি শিক্ষক সন্তোষ ভট্টাচার্যকে। অরুণ চৌধুরী, রথীন্দ্র কৃষ্ণ দেব সহ অন্য অনেক যোগ্য নেতৃত্বের নিরলস প্রচেষ্টায় এবিটিএ-র শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়, গোটা রাজ্যজুড়ে। পঞ্চাশের দশকের শিক্ষকদের যে সংগ্রাম তা ভোলা যায় না, শুধু বাংলা নয় গোটা দেশের শিক্ষক আন্দোলনে উজ্জ্বল দিশা দেখিয়েছিল এবিটিএ-র নেতৃত্বে লড়াইয়ের সেই দিনগুলো। শিক্ষকদের নিজেদের দাবির সপক্ষে অবস্থান নয়, শিক্ষার দাবিকে জাতীয় দাবিতে পরিণত করতে এবিটিএ-র আন্দোলন মাইলফলক হয়ে উঠল।
রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজ যে অবদান রেখেছেন তা ইতিহাস মনে রাখবে। বিমান বসু আবেগদীপ্ত কণ্ঠে বলছিলেন, সেই গৌরবের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসাবে আপনাদের সাধারণের বিদ্যালয় রক্ষার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। আক্রমণ, মিথ্যা মামলা ও নৈরাজ্যকে উপেক্ষা করে এখনো এবিটিএ সর্ববৃহৎ শিক্ষক সংগঠন হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং, আপনারা তা পারবেন। তিনি বলেন, আজকে কেন্দ্রে যেমন বিজেপি’র মতো দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দল সরকার পরিচালনায়, তেমনই আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দল সরকার চালাচ্ছে। একটি দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য আরেকটি দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দলকে ডেকে আনা কতটা ভয়ানক হতে পারে তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে বেসরকারিকরণের সমস্ত ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তেমনি রাজ্যের তৃণমূল সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে শিক্ষায় বেসরকারিকরণের। লকডাউনের সময় থেকে স্কুল-কলেজ বন্ধ, সারা দুনিয়ার স্কুল খুলছে। কেন এখানে বন্ধ থাকবে? সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্কুল থেকে দূরে রাখতে চায় শাসকরা। স্কুল খোলানোর জন্য পথে নামতে হবে আপনাদের।
সমাবেশে এসেছিলেন ত্রিপুরার শিক্ষক ও কর্মচারী আন্দোলনের নেতা স্বপন বল। ত্রিপুরায় ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে বিজেপি সরকার। মুখে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি ত্রিপুরায় সরকারে আসীন হয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে নানা ধরনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রলোভনে বিশ্বাস করেছিলেন কর্মচারী শিক্ষকদের একাংশ। শুধু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনি বিজেপি সরকার, শিক্ষক-কর্মচারীদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে দিয়েছে। কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে, নামিয়ে এনেছে ভয়ানক শারীরিক আক্রমণ এবং খুন করে হত্যা করতেও তারা পিছপা হচ্ছে না।
সমাবেশে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ পবিত্র সরকার বলেন লকডাউনের সুযোগে শিক্ষাব্যবস্থাকে অনলাইন করার অছিলায় ব্যাপক হারে শিক্ষা সংকোচনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। মহামারীর সুযোগ নিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে স্কুলের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে তারা পরিচালনা করতে চায়। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং শিক্ষক-ছাত্রের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত এই শিক্ষা কখনোই মানবিক শিক্ষা হতে পারে না। ছাত্ররা শিক্ষকদের ভালোবাসা যেমন পাবে তেমনি তিরস্কার লাভ করে এবং এই পারস্পরিক সংযোগের মধ্যে দিয়ে একদিন সে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত হয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে এ কাজ কখনোই হতে পারেনা। পাশাপাশি আমাদের রাজ্যে পার্শ্ব শিক্ষক থেকে মাদ্রাসা শিক্ষক সবাই আক্রান্ত এবং সবাই বঞ্চিত। সর্বত্র চলছে দুর্নীতি, তোলাবাজি এবং নৈরাজ্যের রাজত্ব। এর বিরুদ্ধে শিক্ষক সমাজকে সংঘবদ্ধ করতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সমাবেশে বামফ্রন্টের পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিল, পরিকাঠামো তৈরি করেছিল। রাজ্যজুড়ে স্কুল তৈরি করেছিল, তেমনি শিক্ষকদের মর্যাদাও দিয়েছিল। শিক্ষকদের জন্য প্রথম পে-কমিশন তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। তৃণমূল সরকার গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। স্কুল কমিটি দখল করেছে। শিক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন লোকজনকে কমিটির মাথায় বসিয়েছে। এসএসসি-আপার প্রাইমারি থেকে প্যারাটিচার, ভোকেশনাল টিচার নিয়োগ সবেতেই ব্যাপক দুর্নীতি করেছে, টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে তৃণমূল একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করেছে।এই সরকার যদি বেসরকারি স্কুলের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে বেসরকারি স্কুলকে সাহায্য করছে কিন্তু সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করছে না। এইভাবে বেসরকারিকরণের পথে রাজ্যকে ঠেলে দিচ্ছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হবেই। সেই সরকার প্রথম ১৫দিনের মধ্যে তোলাবাজি বন্ধ করবে। শিক্ষকদের মর্যাদা দেবে ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবে। সেই লড়াইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন শিক্ষকরা। শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সম্পাদক বিজয় প্রসাদ সিনহা এবং এবিপিটি-র সম্পাদক মোহন দাস পণ্ডিত।
সমাবেশে সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন সমসাময়িক সময়ের শিক্ষা আন্দোলনের সূচিমুখ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বামফ্রন্টের সময় প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষা হতো। প্রতিবছর শিক্ষক নিয়োগ হতো। সর্বস্তরে বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের মানোন্নতি ঘটেছিল। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারগুলো থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয় ভরিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষকদের মর্যাদা দিয়েছিলেন বামফ্রন্ট, তৃণমূল তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ভয়ঙ্কর দু’টি শক্তি কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় আসীন। একদিকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিপদ, অন্যদিকে কর্পোরেট পুঁজির অঙ্গুলিহেলনে জাতীয় শিক্ষানীতি বলবৎ করে শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের চক্রান্ত - একে রুখতে হলে আজকের শিক্ষক আন্দোলনকে দেশের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে মিলিত হতে হবে। বহু সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, তাকে সমূলে লোপাট করে নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে টিএমসি পরিচালিত সরকার।
সমিতির সভাপতি সভার পরিচালক কৃষ্ণ প্রসন্ন ভট্টাচার্য নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশে থেকে শিক্ষক সমাজকে লড়াই সংগ্রাম করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন শিক্ষায় গণতন্ত্র বিপন্ন। দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নির্বাচন না করে মনোনীত দলীয় ব্যক্তিকে দিয়ে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ও পঠন-পাঠন পরিচালনা করছে বর্তমান সরকার। পাঠ্যপুস্তক রচনা, সিলেবাস তৈরি ইত্যাদি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে মুখ্যমন্ত্রী তার নিজের ব্যক্তিগত প্রচারের জন্য ব্যবহার করছে। শিক্ষকদের পেশাগত দাবি আজ বিপন্ন। প্যারাটিচার, আংশিক সময়ের শিক্ষক, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও বিভিন্নস্তরের শিক্ষক-শিক্ষা কর্মীদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিদ্যালয়ে আমলাতন্ত্রকে চাপিয়ে দিয়ে প্রধানশিক্ষক থেকে শুরু করে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীকে দাসে পরিণত করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলছে। এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে।
সমিতির শতবর্ষের ইতিহাস দেশের শিক্ষা আন্দোলনে গৌরব টিকা পরিয়ে দিয়েছে। দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত বাংলা প্রদেশে এই সংগঠন ছিল মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন। দেশ ভাগ হওয়ার পরে নবগঠিত পশ্চিমবাংলাতে সত্তর দশক পর্যন্ত এই সংগঠনই একমাত্র সংগঠন ছিল। সাতের দশকে তৎকালীন শাসকশ্রেণির মদতে এই সংগঠন ভাঙবার চক্রান্ত হয়েছে। কিছু শিক্ষক শাসকের লেজুড় ও সংশোধনবাদী হয়ে আলাদা সংগঠন করেছেন, কিন্তু এবিটিএ বৃহত্তম সংগঠনই থেকেছে এবং মতাদর্শে অবিচল থেকে লড়াই চালিয়ে গেছে। সেজন্য বর্তমান সময়ে যখন কেন্দ্রের আরএসএস পরিচালিত বিজেপি-র জোট সরকার সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলে শিক্ষার সাম্প্রদায়িক বিভেদের পাঠ্যসূচি চালু করতে উদ্যত, তখন সূর্য-লাঞ্ছিত পতাকা হাতে নিয়ে সমিতি পথে নেমেছে। আবার রাজ্যে যখন নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের আবর্তে তৃণমূলদল বিদ্যালয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে নেমেছে, সমিতির অকুতোভয় সদস্যরা প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে চাকরির তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর খণ্ডিত বাংলায় জাতীয় কংগ্রেস একই সাম্রাজ্যবাদী পথ অনুসরণ করলে সমিতিকে আবার আন্দোলন-সংগ্রামে নামতে হয়। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগের আঘাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবাংলায় যে লক্ষ লক্ষ নরনারী উদ্বাস্তু হয়ে দলে দলে আসতে শুরু করে তাদের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক সমাজের অনেকে ছিলেন। এরাই সেই উদ্বাস্তু অঞ্চলগুলোতে নতুন নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এর ফলশ্রুতিতে সমিতির সংগঠনের ব্যাপ্তি ঘটে এবং সাংগঠনিক চিন্তাভাবনার গুণগত পরিবর্তন হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি শতবর্ষ পূর্তির সমাবেশ মঞ্চ থেকে সেই আহ্বান ধ্বনিত হলো - যে কোনো মূল্যে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং সাম্প্রদায়িকীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সাধারণের বিদ্যালয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য সমিতি জান কবুল লড়াই জারি রাখবে।