E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২৯ মাঘ, ১৪২৭

আর্থিক সমীক্ষা ও বাজেট দেশের মানুষের অর্থনীতি কোথায়?

ঈশিতা মুখার্জি


প্রতি বছর দেশের সংসদে পেশ হয় আর্থিক সমীক্ষা ও বার্ষিক বাজেট। দেশের মানুষ দেশের অর্থনীতিকে একভাবে চেনেন। চেনেন তার প্রতিদিনের জীবনযাত্রার বেঁচে থাকার যন্ত্রণা দিয়ে। এই মুহূর্তে দেশের মানুষ দ্বিমুখী বিপর্যয়ের সম্মুখীন। গত বছরেই জানা যায় যে, দেশে মন্দা এসে গেছে। তারপর কোভিড ১৯ এলো। মানুষ তো এমনিতেই কাজ হারাচ্ছিল। তা আরও বেড়ে গেল কোভিডের ধাক্কায়। পেট্রল-ডিজেল সহ রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এ দেশে ক্ষুধা, বেকারি রেকর্ড ছাড়াল। এই পরিস্থিতিতে আর্থিক সমীক্ষা এবং বাজেট থেকে দেশের মানুষের কী প্রত্যাশা ছিল? কেন্দ্রের বিজেপি–আরএসএস সরকার এই বাজেটের আগেই যে ভাবে মানুষের এই দ্বৈত সঙ্কটের মোকাবিলা করার কথা বলেছিল, তাতে মানুষের বোধহয় বিশেষ কিছু আশা করার ছিল না।

কী পেলাম এই দুটি দলিল থেকে? প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে,বর্তমান সরকারের আমলে দেশের আর্থিক সমীক্ষা থেকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোনমতেই বোঝা যায় না। বাজেট পেশের আগে যে আর্থিক সমীক্ষা প্রকাশিত হলো তাতে এক আর্থিক উন্নতির বা অধোগতির গল্প শোনানো হলো। বলা হলো দলিলের শুরুতেই যে, দেশের অর্থনীতির রেখাচিত্র উপরের দিকে উঠছে। V রেখাচিত্রের মতো দেশের জাতীয় উৎপাদনের হারের বৃদ্ধি ঘটবে বলে বলা হলো। ২০২০-২১ সালের অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে এপ্রিল থেকে জুন মাসে জাতীয় উৎপাদন ২৩.৯শতাংশ সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল, এবং দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সঙ্কোচন ছিল ৭.৫শতাংশ। অতিরিক্ত সঙ্কোচন থেকে শুরু করলে সবসময়েই যে কোনো সঙ্কোচনকে কম দেখানো গাণিতিক নিয়মে সম্ভব। কিন্তু সঙ্কোচন অব্যাহত রয়েছে। সাধারণ মানুষের কাজ হারানোকে অতি সহজেই কোভিডের জন্য বলে বলে দেওয়া হয়েছে এই সমীক্ষায় । কিন্তু একবারও বলা হলো না যে, কোভিডের আগেই এই ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিতে কাজ হারানো যে গত ৪০ বছরের রেকর্ড তা সিএমআইই-র তথ্যেই আমরা সবাই জেনেছিলাম।

এই সমীক্ষা লেখা হয়েছে প্রাক্-সমীক্ষার তথ্যগুলিকে প্রায় অস্বীকার করে। সরকার নাকি ব্যতিব্যস্ত ছিল এই চিন্তায় যে, এই পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন না জীবিকা কোন্‌টা রাখবে সে চিন্তায়। সমীক্ষা জানাল যে, সরকারের “মানবিক” কর্মসূচির ফলেই আজ জীবন এবং জীবিকা দেশের মানুষ দুটিই নাকি রাখতে পারছে। এটি একটি সর্বৈব মিথ্যা ভাষণ। সরকারের নীতির ফলে জীবন বা জীবিকা কোনোটাই রাখা যায় নি দেশের মানুষের। কোভিড সংক্রমণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই স্থান নিয়েছিল ভারত অনেক দিন থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর মুখে ছিল সবসময় অবৈজ্ঞানিক নির্দেশাবলি। ওদিকে দেশে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল খুব খারাপ, এবারের বাজেটে সরকারি ব্যয় স্বাস্থ্যখাতে কমিয়েও দিয়েছে সরকার।

কোভিডের সাথে যে স্মৃতি দেশের মানুষ কোনদিন ভুলতে পারবেন না তা হলো রেললাইনের উপর রুটির ছবি এবং ট্রেনের তলায় পড়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের লাশ। কতজন পরিযায়ী শ্রমিক দেশে আছেন, কতজন বাড়ি ফিরলেন, কতজন আবার কাজের খোঁজে গেলেন - এ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই এই সমীক্ষায়। এই তথ্যেরই প্রয়োজন ছিল আমাদের দেশে। উলটে এমন কথাও বলা আছে যে, শ্রম কোড আর কৃষি বিল–এই দু’টির জন্যই দেশ আবার আর্থিক উন্নতির মুখ দেখবে। যে বিলগুলি কালাকানুন বলে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত, যে বিল দেশকে কর্পোরেটের কাছে তুলে দেওয়ার বিল বলে পরিচিত, সেই বিলকে স্বাভাবিকভাবে সিলমোহর দিল এই দলিল।

বাজেট প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সমীক্ষা নিয়ে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, এই সমীক্ষা দেশের সরকারি পরিসংখ্যানকেও অস্বীকার করেছে। সমীক্ষার আগে প্রকাশিত পরিসংখ্যানের উল্লেখ না করে লকডাউন কোভিড সংক্রমণ কত কমিয়ে দিয়েছে, এবং মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, সে নিয়ে পাতার পর পাতা খরচ করা হয়েছে। দেশের মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা একেবারে এর বিপরীত। যে রাজ্য কোভিড মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থায় উন্নত সেই রাজ্যের উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে উত্তর প্রদেশ আর বিহারের কথা। অথচ কেরালার স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং কোভিড মোকাবিলা যে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে, তার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি সমীক্ষায়।

তাহলে লকডাউনের প্রশংসা, কোভিড মোকাবিলা নিয়ে মিথ্যাচার দিয়ে এই সমীক্ষার প্রথম অংশ পাতার পর পাতা ভিত্তিহীন গাণিতিক রেখাচিত্র, পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচ, নয়া ধ্রূপদী অর্থনীতির অবাস্তব তত্ত্ব দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে যার সাথে দেশের মানুষের বেঁচে থাকার কোনো যোগ নেই। কিসের জন্য প্রকাশিত হলো এই দলিল? লকডাউন এবং সেই কারণে আর্থিক উন্নয়নের কথা শোনানোর জন্য? এখনো আমাদের স্মৃতি এত দূরে চলে যায় নি। কোভিডের সাথে যে স্মৃতি দেশের মানুষ কোনদিন ভুলতে পারবেন না তা হলো রেললাইনের উপর রুটির ছবি এবং ট্রেনের তলায় পড়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের লাশ। কতজন পরিযায়ী শ্রমিক দেশে আছেন, কতজন বাড়ি ফিরলেন, কতজন আবার কাজের খোঁজে গেলেন - এ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই এই সমীক্ষায়। এই তথ্যেরই প্রয়োজন ছিল আমাদের দেশে। উলটে এমন কথাও বলা আছে যে, শ্রম কোড আর কৃষি বিল–এই দুটির জন্যই দেশ আবার আর্থিক উন্নতির মুখ দেখবে। যে বিলগুলি কালাকানুন বলে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত, যে বিল দেশকে কর্পোরেটের কাছে তুলে দেওয়ার বিল বলে পরিচিত, সেই বিলকে স্বাভাবিকভাবে সিলমোহর দিল এই দলিল।

আমাদের সকলের মনে আছে কিছুদিন আগে অক্সফ্যাম প্রকাশিত একটি রিপোর্টের কথা যার নাম ছিল –বৈষম্যের ভাইরাস। সেখানে জানা যায় যে, একজন অদক্ষ শ্রমিক ১০,০০০ বছরে যা আয় করে আম্বানি তা করে ১ ঘণ্টায় এই কোভিডকালে। আম্বানির এক সেকেন্ডের আয় তাদের তিন বছরের আয়ের সমান। কোভিডের সময়ে দেশের কোটিপতিদের আয় বেড়েছে ৩৫শতাংশ। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ১,৭০,০০০ মানুষ প্রতিঘণ্টায় কাজ হারিয়েছেন। এই সমীক্ষায় অবশ্য বলা আছে যে, আর্থিক বৈষম্য নিয়ে সরকারের অত মাথাব্যথা নেই যতটা আছে দারিদ্র্য নিয়ে। দারিদ্র্য কমানোর একমাত্র পথ দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটানো - এমন অবাস্তব কথাই বলা আছে এই সমীক্ষায়। অবাস্তব, মিথ্যা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এই সরকারের।

সরকারের বক্তব্য স্পষ্ট। দেশের মানুষ নিজের ভালো বোঝে না। নোটবন্দির পর থেকেই এই বিষয়ে সরকার একটি কথাই বলে চলেছে। শ্রম কোড, কৃষি বিল নিয়েও এক বক্তব্য। কেউই নিজের ভালো বোঝে না। তাই বাজেটেও সরকারের এই চরিত্রই বেড়িয়ে পড়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেই দিলেন যে, এই বাজেট ঐতিহাসিক। একদিক দিয়ে তো এই কথা ঠিক। এই প্রথম সরকার জনকল্যাণের দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। কোভিড পরিস্থিতিতে যখন মানুষের জীবন-জীবিকা সঙ্কটে, সেইসময়ে সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সবকিছুর দায় থেকে সরে এসে কর্পোরেটের হাতে দেশকে সঁপে দিল। দিল্লির সীমান্তে মাসের পর মাস অবস্থান করছেন দেশের কৃষিজীবী মানুষ ও তাদের পরিবারবর্গ। একটাই দাবি তাদের - কৃষি বিল প্রত্যাহার করুক সরকার। এই আন্দোলন আন্তর্জাতিকস্তরে ঐতিহাসিক রূপ নিচ্ছে; আম্বানি, আদানি, আর প্রধানমন্ত্রীর নাম একসাথে উঠে যাচ্ছে মানুষের স্লোগানে। কেন? তার কারণ নির্বাচিত সরকার তার দেশের মানুষকে না দেখভাল করে শুধুমাত্র দেখভাল করছে এই কোটিপতিদের। তাই তো বাজেটে জল থেকে, জঙ্গল থেকে, খনি থেকে, চা-কফি বাগান থেকে সব সম্পদই তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটের হাতে। বাজেটের আগে পেশ করা হয়েছিল তিনটি মিনি বাজেট কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। সেই মিনি বাজেট আসলে ছিল দেশের মানুষকে ঋণ নিতে প্রলুব্ধ করা। সহজ ব্যবস্থায় ঋণ দিতে এগিয়ে এসেছিল সরকার মানুষকে নাকি বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে। এটি কিন্তু সরকারি ব্যয় সেই অর্থে ছিল না।

এই মিনি বাজেটের ছায়া দেখা গেল আসল বাজেটে, যেখানে বলা হলো যে, এই বাজেটের অন্তর্গত ওই মিনি বাজেটগুলি। স্পষ্টভাবে না বললেও এই কথা বাজেট পরিসংখ্যানে প্রকাশিত। কী করল সরকার বাজেটে দেশের মানুষের জন্য? দেখা গেল, বাজেটে আর্থিক ঘাটতি মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬.৮শতাংশ। মনে হতে পারে যে, সরকার জনকল্যাণে বেশি ব্যয় করছে বলে এই ঘাটতি। ঘটনা তা নয় ।সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ে নি, আগামী বছরেও বাড়বে না বলে ঘাটতি। সরকারের রাজস্ব আয় গত বছরে প্রস্তাবিত ছিল ২০,২০,৯২৬ কোটি টাকা। কিন্তু এ বছর রাজস্ব আয় বাজেটে দেখানো হয়েছে ১৭,৮৮,৪২৪ কোটি টাকা। মুদ্রাস্ফীতি ধরলে আসলে প্রকৃতঅর্থে রাজস্ব সংগ্রহ কমে যাবে। বহুবার কোভিড পরিস্থিতির সময়ে কথা উঠেছে - কেন সরকার অতিধনীদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপায় না এবং সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করার কাজে এগিয়ে আসে না। এর ফলে সরকারের ঋণের পরিমাণ আগামী বছরে বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যয় এক বছরে ২৬,৮৮,৮৯৭ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৬,৭২,৬০৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ স্পষ্ট সরকারি ব্যয় কমছে।

বাজেটে সঙ্কেচন হয়েছে বিপুলভাবে। রেশনব্যবস্থায় বরাদ্দ গতবছরেও যা হয়েছিল অর্থাৎ ৪,৩৮,৬৪৮ কোটি টাকা তার চেয়ে এবার কমিয়ে হয়েছে ২,৫৩,৯৭৫ কোটি টাকা। যেখানে মানুষ অভুক্ত, আয় নেই, সেখানে সরাসরি রেশনব্যবস্থার উপর কোপ পড়ল। রেগা বা একশ দিনের কাজেও বরাদ্দ ছাঁটাই। বরাদ্দ এক ধাক্কায় ৭৩,০০০ কোটি টাকা থেকে ৬১,৫০০ কোটি টাকায় নেমে গেল। কাজের গ্যারান্টি থেকে সরে এলো সরকার। যে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ নিয়ে অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় এতো বড়াই করলেন, তার ক্ষেত্রেও সেই এক পরিস্থিতি। এই মন্ত্রকে বরাদ্দ হয়েছে ৫৩,৮০৪ কোটি টাকা, গত বছর ব্যয় হয়েছিল ৬৩,৭৭৭ কোটি টাকা। তবে কী অর্থমন্ত্রী যা বললেন বাজেট বক্তৃতায় তা অর্ধসত্য বা মিথ্যা? শিক্ষার বাজেটও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢালাও বেসরকারিকরণের কথা বলা আছে বীমা, ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির।

এই বাজেট তাহলে কোন্ অর্থে সাধারণ মানুষের? এ তো আগাগোড়াই দেশের ধনীতম অংশ বা কর্পোরেট পুঁজিপতিদের জন্য। আগামীদিনে এই ধরনের আর্থিক সমীক্ষা বা বাজেট যাতে তৈরি না হয় সেই বিষয়ে দেশের মানুষকেই বিকল্প উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ বুঝতে পারছে, তাই তো চলছে দেশব্যাপী প্রতিবাদ প্রতিরোধ। আগামীদিনে এই প্রতিরোধ আরও কঠোর না হলে দেশের মানুষের বাঁচার উপায় থাকে না।