৫৮ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১২ মার্চ, ২০২১ / ২৭ ফাল্গুন, ১৪২৭
তৃণমূল জবাব দাও
ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানের হাল কী?
সুপ্রতীপ রায়
নির্বাচনের আগে প্রকল্পের বন্যা। তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার প্রকল্পের পর প্রকল্প ঘোষণা করেছেন গত তিন মাসে। কিন্তু পূর্বের ঘোষিত প্রকল্পগুলির অবস্থা কি? এর উত্তর বিধানসভা নির্বাচনে দিতে হবে তৃণমূলকে।
নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূল বলছে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পের ফলে মানুষ নাকি চিকিৎসার সুযোগ পাবেন। কিন্তু রাজ্যবাসী এটা দেখছেন গত একদশকে অনেক ঘোষণা, প্রতিশ্রুতি-শিলান্যাস হলেও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার কোনো উন্নতি হয়নি। আমজনতার কাছে সরকারি চিকিৎসা কার্যত আয়ত্তের বাইরে। এটা স্মরণে রাখা দরকার বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজ্যের ৭২ শতাংশ মানুষ সরকারি চিকিৎসার সুযোগ পেতেন। বর্তমানে তা নেই।
মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসপাতালে যেকোনো সময় ঢুকে চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের ধমক, চমক, বদলি, সাসপেন্ড করতে লেগেছিলেন। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বামফ্রন্ট আমলের থেকে আরও ভাল স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেসব প্রতিশ্রুতির কিছুই রক্ষিত হয়নি। একটি কাজ তিনি সাফল্যের সঙ্গে করেছেন - যে সমস্ত অভিজ্ঞ, দক্ষ ও যোগ্য চিকিৎসক তাঁর অনুগত হননি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
আমাদের রাজ্যে হাসপাতালে গরিব মানুষের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্রীয় মেডিক্যাল স্টোর মারফত তালিকাভুক্ত ওষুধ কিনে সরবরাহের ব্যবস্থা আছে হাসপাতালে। তৃণমূলী আমলে এই জরুরি ব্যবস্থাটিকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। ফলে হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে ওষুধ ও সরঞ্জাম রোগীরা পাচ্ছেন না।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দেওয়ার জন্য সিএসএস-র মাধ্যমে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ক্যাটালগ আইটেম প্রস্তুত করা হয়। তার জন্য টেন্ডার দিয়ে প্রস্তুতকারক কোম্পানির নাম ও দাম প্রকাশ করা হয়। সরকারি হাসপাতালগুলিকে এই সব ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনা ও বিনামূল্যে রোগীদের সরবরাহ করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। বাম আমলে এইভাবেই গরিব রোগীরা সহায়তা পেতেন। বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রোগীরা এ ধরনের সহায়তা থেকে বঞ্চিত।
রাজ্যবাসীর নিশ্চয়ই মনে আছে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলিতে চালু করা হয়েছিল ফেয়ার প্রাইস শপ। এগুলির হাল কি? ন্যায্যমূল্যের ওষুধ সরবরাহের বদলে দরিদ্র রোগীদের প্রচুর দাম দিয়ে ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। রোগীদের বঞ্চিত করে ফেয়ার প্রাইস শপগুলিতে চলছে কোটি কোটি টাকার ওষুধ বিক্রির ব্যবসা। সরকারি নির্দেশগুলিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জেনেরিক নামের বদলে নিজেদের পছন্দ ও সুবিধামতো ব্রান্ডেড নামের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানগুলিতে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন হাসপাতালের ফেয়ার প্রাইস শপে ব্রান্ডের ওষুধের বিভিন্ন ধরনের দাম নেওয়া হচ্ছে।
ফেয়ার প্রাইস শপগুলিতে জেনেরিক নামের ওষুধ রাখার কথা। কিন্তু রোগীদের তা দেওয়া হয় না। যদিও ক্যাশমেমোতে থাকে জেনেরিক নাম। একই প্রেসক্রিপশন নিয়ে রোগীরা বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন ব্রান্ডের ওষুধ পান - এও এক তাজ্জব ব্যাপার।
আবার ফেয়ার প্রাইস শপগুলিতে ক্রেতাদের ওষুধের দাম এম আর পি বা সর্বাধিক বিক্রয় মূল্যের উপর যে রিবেট বা ছাড় দেয় সেখানেও রয়েছে ভিন্নতা। বিভিন্ন হাসপাতালে এই ছাড়ের হার ভিন্ন। ফেয়ার প্রাইস শপগুলি রিবেট দিয়ে যে দামে কোনো ব্রান্ডের ওষুধ বিক্রি করছে, অন্য কোম্পানির সেই একই কম্পোজিশনের ওষুধ তার থেকে কম দামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। আসলে ছাড়ের নামে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে।
ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ওষুধের গুণমান যাচাইয়ের রিপোর্টও দেয় না। এই দোকানগুলিতে ২৪ ঘণ্টা ফার্মাসিস্টও থাকে না। ফেয়ার প্রাইস শপগুলিতে সাধারণ কর্মচারীরাই ওষুধ সরবরাহ করেন। ফলে জেনেরিক নাম চিহ্নিত করায় বিভ্রান্তি ঘটে চলেছে। ভুল ওষুধ সরবরাহের ঘটনার অভিযোগও প্রচুর। ফেয়ার প্রাইস শপগুলি থেকে অনামি ও অতি নিম্নমানের এবং পরীক্ষিত নয় এমন ব্রান্ডের ওষুধও বিক্রি করা হয়।
আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চহারে সর্বোচ্চমূল্য বাড়িয়ে তার ওপর ছাড় দিয়ে ইচ্ছামতো দাম নেওয়া হয়। উচ্চমাত্রায় ছাড় দিয়েও, বিনা ছাড়ে বিক্রি হওয়া খোলা বাজারের ওষুধের থেকে ফেয়ার শপের দাম অনেক বেশি। অত্যন্ত নিম্নমানের ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি সহ রোগীকে ভুল ওষুধ সরবরাহের ঘটনাও ঘটছে। শাসকদলের অনুগত হলেই সাতখুন মাপ। একই ব্যক্তি বা একই কোম্পানিকে একাধিক হাসপাতালে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকার। যদিও টেন্ডারের ভিত্তিতে এভাবে একাধিক হাসপাতালে ব্যবসার সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তৃণমূলী আমলে সবই সম্ভব।
প্রকৃতপক্ষে রাজ্য সরকার পিপিপি মডেলের নামে সরকারি হাসপাতালগুলিতে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলার পরে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে রোগীদের হাসপাতালে অবস্থিত ওই দোকান থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। ওষুধ সরবরাহ নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার একাধিক দৃষ্টান্ত থাকলেও সরকার নির্বিকার।
ফলে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প নিছক নির্বাচনী চমক। রাজ্যে গরিব মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার স্বার্থে চাই বিকল্প সংযুক্ত মোর্চা সরকার।