৫৮ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১২ মার্চ, ২০২১ / ২৭ ফাল্গুন, ১৪২৭
‘বাংলার মেয়ে’ কোন্ তৃণমূলের নেত্রী?
সন্দীপ দে
খোলা আকাশের নিচে সালকু সোরেনের লাশ
সালকু সোরেনের কথা মনে আছে? ধরমপুরে সিপিআই(এম) অফিসের সামনে যাঁর লাশ খোলা আকাশের নিচে পড়েছিল সাতদিন! তাঁর মৃতদেহ সৎকার করতে দেয়নি মাওবাদী জল্লাদেরা। তাঁর ‘অপরাধ’ ছিল এলাকায় সিপিআই (এম)’র অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ধরমপুর সংলগ্ন কাঁকড়াদাঁড়া গ্রামের এই প্রবীণ মানুষটি ছিলেন নানা প্রয়োজনে সবার অত্যন্ত প্রিয় অভিভাবকের মতো। তাঁকে বারে বারে পার্টি ছেড়ে দেবার জন্য হুমকি ও ভয় দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি সবকিছুকেই অগ্রাহ্য করেছেন। সেটা সহ্য হয়নি দুর্বৃত্তদের। তাই ২০০৯ সালের ১০ জুন, ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি’র আড়ালে তৃণমূল-মাওবাদীরা দুপুরে মিটিঙয়ের নাম করে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় তাঁকে। তারপর খুন করে তাঁর মৃতদেহ ফেলে রাখে রাস্তায়।
শহিদ কমরেড সালকু সোরেনের মরদেহ খোলা আকাশের নিচে।
তখন কেবল ধরমপুর নয়, গোটা জঙ্গলমহল জুড়ে চলছিল জনসাধারণের কমিটির নেপথ্যে তৃণমূল-মাওবাদীদের বীভৎস সন্ত্রাস। এলাকার পর এলাকা অবরুদ্ধ, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্তব্ধ। এমনই একটি অবস্থায় পার্টি কর্মীরা তাঁদের প্রিয় কমরেডের মৃতদেহ উদ্ধার করে পোস্টমর্টেমের জন্য পার্টি অফিসের সামনে রেখেছিল। কিন্তু তখন যৌথ বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় হিংস্র সন্ত্রাস চালিয়ে পার্টিকর্মী-সমর্থকদের এলাকাছাড়া-গ্রামছাড়া করে। তাই কমরেড সালকু সোরেনের মৃতদেহ সৎকার করা যায়নি। বাড়ির লোকজন মৃতদেহ সৎকার করতে চাইলে বাধা দেয় ঘাতক বাহিনী। এভাবেই খোলা আকাশের নিচে মৃতদেহ পড়ে থেকে পচন ধরে এবং এলাকা জুড়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে সাতদিন পর তাঁর মৃতদেহ সৎকার করা সম্ভব হয়। সেদিন এমনই এক চূড়ান্ত অমানবিক-ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন এলাকার মানুষ সহ রাজ্যবাসী। রাজ্যের ক্ষমতা দখলের নেশায় জঙ্গলমহল জুড়ে এই কুৎসিত বীভৎসতার জন্ম দিয়েছিল আজকের এই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস।
মৃতদেহ পোঁতা খালের জলে
ধরমপুর পার্টি অফিসের পাশ দিয়ে কিছুটা গেলেই কৃষ্ণনগর গ্রাম। তৃণমূল-মাওবাদী যৌথবাহিনীর হিংস্র সন্ত্রাসের এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদগ্ধ স্মৃতি আজও বয়ে চলেছে এই গ্রাম। ২০০৯ সালের ১৬ জুন, রাতেরবেলা গ্রামে হানা দেয় জনসাধারণের কমিটি নামধারী হাজার খানেক তৃণমূল-মাওবাদী সশস্ত্র দুর্বৃত্ত। ওরা গ্রামে ঢুকে ভয়ঙ্কর দৌরাত্ম্য শুরু করে এবং গ্রামেরই কেশব মানা, ধীরাজ মানা, সঞ্জয় মাহাতো, মোহন সিং, দেবব্রত সোরেন, মলয় মাহাতো এবং দীনবন্ধু সোরেনকে জোর করে নিয়ে যায়। বলে মিছিল শেষে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু তাঁরা আর ফেরেন নি। পার্টি কমরেডরা বেশ কিছুদিন পর নির্দিষ্ট কিছু সূত্রে জানতে পারেন এই নিরীহ মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁদের লাশ অদূরে আদিবাসীপাড়া মোহনপুরের খালে পুঁতে দিয়েছে জল্লাদেরা। সিপিআই(এম)’র কর্মী-সমর্থক হওয়াই ছিল এই নিরীহ গ্রামবাসীদের ‘অপরাধ’।
সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন মৃত কেশব মানার মেয়ে-বোন-বৌমারা। কেশব মানা ছিলেন ধরমপুর লাইব্রেরির পিওন। সিপিআই(এম) লোকাল কমিটির সদস্য, জনদরদি এই মানুষটি ছিলেন এলাকার সবার প্রিয়। তাঁর বছর ষোলোর ভাইপো ধীরাজ সদ্য মাধ্যমিক পাস করেছিল। সে প্রায় সব সময়ই থাকত তাঁর সঙ্গে। এই ছোট্ট ছেলেটিকেও ঘাতকবাহিনী সেদিন বন্দুক দেখিয়ে ‘মিছিল’ করতে নিয়ে গেয়েছিল। কিন্তু তারও আর ফেরা হয়নি। সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা কেশব মানার স্ত্রী শান্তি মানার গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে হাতে-কানে যেটুকু গয়না ছিল, তাও কেড়ে নিয়েছিল। এই হিংস্র দুর্বৃত্তরা মাঝে মাঝেই গ্রামে হানা দিত, অত্যাচার, লুঠপাট চালাত। এদের ফতোয়ায় গ্রামের খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়েছে, গরিব মানুষকে মজুর খাটতে দেওয়া হয়নি, চাষবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেশব মানার স্ত্রী-ছেলে দু’জনেই আজ প্রয়াত। বাড়ির সদস্যরা নিদারুণ কষ্ট-যন্ত্রণার মধ্যে স্বজন হারানোর দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে বুকে আগলে রেখে দিন গুজরান করছেন।
সালকু সোরেনের মা ছিতামণি সোরেন এবং দু’ভাই ফাগু সোরেন ও কারমু সোরেন।
শহিদ কমরেড মোহন সিংয়ের স্ত্রীর অভিজ্ঞতাও মর্মান্তিক। দুই ছেলেকে নিয়ে খুবই কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করতে হচ্ছে তাঁকে। স্বামীর নিখোঁজ হবার সার্টিফিকেট না থাকায় কোনো সরকারি সাহায়্য মেলেনি। একশো দিনের কাজ বন্ধ অনেকদিন ধরেই। যেটুকুওবা হয়েছে তাও একজন সবার নাম লিখে মজুরির টাকা সব তুলে নিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে তৃণমূলের মদতে এলাকায় যে হিংসা-সন্ত্রাস-অরাজকতার আবহ তৈরি হয়েছিল, সেই ভয়াবহ পরিবেশ আজ না থাকলেও তৃণমূলের জমানায় গ্রামের গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের সঙ্কট এতটুকু দূর হয়নি। এই গ্রামগুলির সর্বত্র আজও প্রকট সেই সঙ্কট-যন্ত্রণারই প্রতিচ্ছবি।
পথের ধূলায় পড়ে থাকে শিক্ষকের মৃতদেহ
২০১০-এর মহালয়ার দিন কুলটিকরি এলাকা থেকে ফিরছিলেন প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক গুরুচরণ মাহতো। বেলা চারটেয় মিটিং আছে বলে তাকে মারধর করে জোর করে নিয়ে যায় জনসাধারণের কমিটি। তিনি আর ফিরে আসেন নি। খয়েরবনী গ্রামের লোকদের বলে দেওয়া হয়েছিল কেউ যেন যোগাযোগ না করে। শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় বাঁকশোলের দেবীচকে।
স্ত্রী নীলিমা মাহাতো শোনাচ্ছিলেন সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা। গুরুচরণ মাহাতো ছিলেন এলাকায় সিপিআই(এম)’র অন্যতম সংগঠক। তাই জনসাধারণের কমিটি ক্ষুব্ধ হয়েছিল তার উপর। পার্টি ছেড়ে দেবার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে বারবার। তাঁর কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করা হয়েছিল। অবশেষে প্রাণটাও কেড়ে নেয় তৃণমূল-মাওবাদী ঘাতকরা। নীলিমা মাহাতো বলছিলেন স্বামীর মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধের জিনিসপত্র কিনতে দেয়নি, দোকানদের উপর হুলিয়া জারি করা হয় যাতে কোনো জিনিস বিক্রি না করে। সামাজিক বয়কট, ধান কাটতে বাধা দেওয়া, জমি-জিরেত কেড়ে নেওয়ার মতো নানা অবিচার-অত্যাচারের মুখে পড়তে হয় তাঁদের। এমনকি ঘরদোর সব ভেঙে দিয়েছিল ওরা। গুরুচরণকে খুন করার পরও চলেছে সন্ত্রাস। এই ভয়াবহতার কবল থেকে বাঁচতে বছর দুই ঘরে তালা মেরে দুই ছেলেকে নিয়ে অন্যত্র থাকতে হয়েছিল নীলিমাকে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও আজও কোনো সাহায্য মেলেনি। বুকে গভীর যন্ত্রণা নিয়ে নীলিমার কণ্ঠে উঠে এলো - ‘‘রাত হলে মনে হতো আর সকাল দেখতে পাবো না, দিন হলে মনে হতো - দিনটা বোধহয় আর পেরোবে না।’’
সদ্য বিবাহিতা পুতুলরানির স্বামী হারানোর যন্ত্রণা
পাটাশিমূল পঞ্চায়েতের অন্তর্গত রাধাগোবিন্দপুর। টোটন পরিহারী এলাকার জনপ্রিয় পার্টিকর্মী, পোশাকি নাম শুভব্রত। রাতবিরেতে গ্রামের মানুষের যেকোনো সমস্যায় সে হাজির। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে অকাতরে গরিব মানুষকে সাহায্য করে গেছেন। এমন মানবদরদিরাই তো চক্ষুশূল অন্ধকারের জীবদের কাছে। তাই তথাকথিত জনসাধারণের কমিটির আবডালে থাকা তৃণমূল-বিজেপি’র ঘাতকেরা বাঁচতে দেয়নি এলাকার সবার প্রিয় টোটনকে। ২০১০ সালের ১৯ অক্টোবর, গ্রামে মিছিল করে যৌথবাহিনী। সেদিন থেকে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। আসলে ওকে অপহরণ করা হয়। সে আর ঘরে ফেরেনি। তখন চারপাশে এতটাই আতঙ্কের পরিবেশ যে থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করাও সম্ভব হয়নি। সদ্য বিবাহিতা তরুণী পুতুল বুকের গভীরে আশঙ্কা আর যন্ত্রণার পাহাড় চেপে একদিন–দু’দিন করে এক সপ্তাহ-একমাস–ছ’মাস পেরোনোর পর ভয়-ভীতি কাটিয়ে থানায় মিসিং ডায়েরি করেন। দশ মাস পর মৃতদেহের সন্ধান মেলে, তবে তখন মৃতদেহ চেনা তো দূরের কথা কিছু হাড়গোড় শুধু অবশিষ্ট ছিল। স্ত্রী পুতুলের দাবি মেনে ডিএনএ টেস্ট করা হয়। প্রায় দশমাস পর সেই ডিএনএ রিপোর্টে জানা যায় সেই দেহাবশেষ টোটন পরিহারীরই।
সেই সময় সদ্যজাত শিশুকে বুকে আগলে রেখে স্বামী হারানোর দুঃসহ বেদনা নিয়ে যন্ত্রণার প্রহর গুনতে হয়েছে পুতুলরানিকে। তারপর ধীরে ধীরে জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ের পাশাপাশি শিশুপুত্র সৌম্যশুভ্রকে বড়ো করা, পড়াশোনার ব্যবস্থা করে এগিয়ে যাবার পথ করে নিতে হয়েছে তাঁকে।
শহিদ টোটনের কাকা ষাটোর্ধ্ব স্বপন পরিহারীর কণ্ঠেও উঠে এলো সেই সন্ত্রাস-বিদ্ধ সময়ের কথা। তাঁর কথায় বামপন্থী রাজনীতি করাটাই ছিল তখন সবচেয়ে বড়ো ‘অপরাধ’। ছত্রধর মাহাতো, শশধর মাহাতো এবং উমাকান্ত মাহাতোর নেতৃত্বে গ্রাম দখল, সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার ছিল ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ওদের মিছিলে গ্রামবাসীদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর মিছিল শেষে তালিকা ধরে ধরে সিপিআই(এম) কর্মীদের বাছাই করে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হতো। আজও সেই নৃশংস অত্যাচারের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই।
হতদরিদ্র ক্ষৌরকর্মীও খুন যৌথবাহিনীর হাতে
পাটাশিমূল সংলগ্ন উত্তরাগ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাজেন মান্না ক্ষৌরকাজের জন্য গিয়েছিল পাশের পারুলিয়া গ্রামে। তারপর আর ফেরা হয়নি তাঁর। এটাও ২০১০ সালের ঘটনা। ঘটনার ৪/৫ দিন পর সাঁকরাইল থানার পালইডাঙার রাস্তায় রাজেনের সাইকেলটি পাওয়া যায়। দাদা হরি মান্নার কাছ থেকে জানা যায়, ভাই বাড়ি ফিরে না আসায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেন তাঁরা। কিন্তু কোনো সন্ধান মেলেনি। শেষ পর্যন্ত বছর পঁচাত্তরের মা বীণাপাণি মান্না কোনো সূত্রে খবর পেয়ে ঝাড়্গ্রাম হাসপাতালের মর্গে গিয়ে তাঁর ছেলেকে শনাক্ত করেন। ছেলে হারানো বৃদ্ধা আজও বিশ্বাস করতে পারেন না তাঁর ছেলের মতো একজন নিরীহ অল্প বয়সী তরুণকে কেউ এভাবে খুন করতে পারে! রাজেনের ‘অপরাধ’ ছিল সে সিপিআই(এম) কর্মীদের সাথে ঘোরাঘুরি করত। কেবলমাত্র এই কারণে তৃণমূলীদের মদতে তাকে খুন করে মাওবাদীরা।
এই গ্রামেরই পার্টিকর্মী বিজনবিহারী মাহাতোকেও একই কারণে খুন হতে হয়েছিল তৃণমূল-মাওবাদী খুনে বাহিনীর হাতে। সেটাও ২০১০ সালের ঘটনা। রাজেন খুন হবার পর আবারও গ্রামে আসে যৌথ ঘাতকবাহিনী। ১৫/২০ জনের সশস্ত্র বাহিনী মিটিঙয়ের কথা বলে তুলে নিয়ে যায় বিজনবিহারীকে। তারপর গোয়ালমাড়ার পিচ রাস্তায় মৃতদেহ ফেলে রেখে যায়। শহিদ বিজনবিহারীর বাবা প্রয়াত মনোরঞ্জন মাহাতোও ছিলেন এলাকায় সিপিআই(এম) নেতা। বাবার দেখানো পথেই ছেলে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাম আন্দোলনের সঙ্গে। গ্রামের মানুষের সুবিধা-অসুবিধা, নানা প্রয়োজনে সবসময় এগিয়ে যেতেন বিজনবিহারী। মানুষের স্বার্থে কাজের সূত্রেই তিনি ছিলেন এলাকায় জনপ্রিয়। তাই তৃণমূল-মাওবাদী দুষ্কৃতিরা পরিকল্পনা করেই হত্যা করে তাঁকে।
ঘাতকদের গুলি পার্টি কর্মীর মাথা ভেদ করে এসে লাগে স্ত্রীর হাতে।
২০১০ সালের ৮ নভেম্বর এই বীভৎস ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছিল পাটাশিমূল গ্রামের মানুষদের। কানাইলাল রায় ছিলেন সিপিআই(এম)’র শাখা সম্পাদক। পাটাশিমূল গ্রামের প্রাক্তন প্রধান।পঞ্চায়েত সমিতিরও সদস্য ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর উপর আক্রোশ জমা হয়েছিল তৃণমূল ও তাদের ভাড়াটে মাওবাদী জঙ্গীদের। স্ত্রী বাসন্তী রায় সহ গ্রামের মানুষ ভুলতে পারেননি সেদিনের ভয়াবহ ঘটনার কথা। স্ত্রী বাসন্তী বলছিলেন, সেদিন জমিজরিপ চলছিল। সেখানে জনসাধারণের কমিটির দুর্বৃত্তরা এসে বাড়ির অদূরে ডেকে নিয়ে কানাইলালকে। তারপর তাঁকে মুখ বেঁধে যখন বাইকে তুলতে যায়, তখন স্ত্রী বাসন্তী দৌড়ে গিয়ে বাধা দেয়। ওই সময়েই গুলি চালায় ঘাতকেরা। সেই গুলি কানাইলালের মাথার খুলি ভেদ করে সটান গিয়ে লাগে বাসন্তীর হাতে এবং হাত ফুটো হয়ে যায়। ওদের আরেকটি গুলি কানাইলালের ছাতিতে গিয়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তাঁর। এই খুনের ঘটনা ঘটিয়েও ক্ষান্ত হয়নি তৃণমূল-মাওবাদী জল্লাদেরা। কানাইলালের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুট করেছে, জমির ধান কাটতে দেয়নি, গ্রামের লোকের সঙ্গে মেলামেশায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এমনকি শ্রাদ্ধ করতেও বাধা দিয়েছে। এই অবস্থায় দুই পুত্রকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে এক বছরের বেশি সময় আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে কাটাতে হয়েছে বাসন্তীকে। শুধু তাঁরাই নন, গ্রামের আরও অনেককেই ঘরছাড়া হয়ে কাটাতে হয়েছে দীর্ঘকাল। তৃণমূল-মাওবাদীদের হিংস্র বর্বরতার এমনই অসংখ্য ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি ছড়িয়ে আছে গোটা জঙ্গল মহল জুড়ে।
রাজ্যের ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে মাওবাদী হিংস্র বাহিনীর সাহায্যে দিনের পর দিন এমনই ভয়াবহ সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে তীব্র অরাজকতা-দৌরাত্ম্য চালিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এভাবে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত জঙ্গল মহলে তৃণমূল-মাওবাদীদের হিংস্রতার বলি হওয়া এবং নিখোঁজের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো। এছাড়া নন্দীগ্রাম-খেঁজুরি সহ গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় এই যৌথ বাহিনীর হাতে খুন হতে হয়েছে প্রায় ৭০ জনেরও বেশি সিপিআই (এম) নেতা–কর্মী-সমর্থককে। রাজ্যের ক্ষমতা দখলের নেশায় উন্মত্ত তৃণমূল কংগ্রেস এভাবেই সিপিআই(এম) নিধনযজ্ঞে মেতে রাজ্যে হিংসা-অরাজকতা-খুন- সন্ত্রাসের রাজনীতির ভিত্তি গড়েছে। বাংলা আজ তারই খেসারত দিচ্ছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সহ নানা জায়গায় তৃণমূলের এই খুন-সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষ শরিক ছিল বিজেপি-ও। ওরাও সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের খুনের অভিযানে শামিল হয়ে তাদের রক্তে হাত রাঙিয়েছে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করছে।
এই তৃণমূল-বিজেপি উভয় দল এখন তাদের অতীতের খুন-সন্ত্রাসের রাজনীতির কুৎসিত কালিমা, বর্তমানের যাবতীয় অপকীর্তি ঢেকে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। উভয় দলই যে কোনো মূল্যে চাইছে রাজ্যের মসনদ দখল করতে।
বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ পর্যন্ত শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্বৃত্তদের হাতে ২২৫জন সিপিআই(এম) নেতা-কর্মী-সমর্থককে খুন হতে হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আজ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূলের এই হিংস্র বর্বরতার ইতিহাস, তাদের জঘন্য কার্যকলাপ সব ভুলে গিয়ে কয়েকটি বামপন্থী দল এবং কিছু মহল ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে এই তত্ত্বই সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে যে, সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি-কে রুখতে সবাইকে জোট বাঁধতে হবে। এবং এতে কৌশলে তৃণমূলকে সঙ্গে নেওয়া ও সমর্থনের কথা আওড়ানো চলছে। কিন্তু ইতিহাস এই কথাই প্রমাণ করে যে, উগ্র সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিস্ট দলকে রুখতে হলে সামনের গণতন্ত্রবিরোধী-স্বৈরাচারী শক্তিকেও পরাস্ত করাটা অত্যন্ত জরুরি। পশ্চিমবঙ্গে বাম-গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চা সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই চরম দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং গণতন্ত্র বিরোধী-স্বৈরাচারী তৃণমূল কংগ্রেস - দুই দলকেই পরাস্ত করে মানুষের স্বার্থে বিকল্প সরকার গড়ার গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে শামিল হয়েছে।