৫৮ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১২ মার্চ, ২০২১ / ২৭ ফাল্গুন, ১৪২৭
ব্রিগেডের মাঠে মিথ্যের বেসাতি করলেন মোদী
অর্ণব ভট্টাচার্য
২৮ ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ’র ডাকে ঐতিহাসিক ব্রিগেড সমাবেশের পর ৭মার্চ বিজেপি’র ডাকে যে ব্রিগেড সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো তা জনসমাগমের দিক থেকে সংযুক্ত মোর্চার ব্রিগেডের যে ধারেপাশে আসতে পারেনি তা দেখেছেন সকলেই। অথচ এই ব্রিগেড সমাবেশের আসল চেহারা যাতে প্রকাশিত না হয় তার জন্য বিজেপি’র তাবড় নেতারা এবং আইটি সেলের ভাড়াটে কর্মীরা বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশের ছবিকে তাদের নিজেদের সভার ছবি বলে চালিয়ে দিয়েছে। আসলে এই শঠতা ও মিথ্যাচার বিজেপি’র ডিএনএ’র মধ্যে রয়েছে যার বাইরে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। জনসমাগমের দিক থেকে না হোক অন্তত মিথ্যা কথা বলা এবং ভুয়ো প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটানোর ব্যাপারে রেকর্ড করেছে বিজেপি’র ডাকা ব্রিগেড। সেক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং মিথ্যে অপবাদ দিয়ে যে তৃণমূল নেতারা ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘‘পরিবর্তন’’ ঘটিয়েছিলেন তাদেরই অনেককে মঞ্চে বসিয়ে ‘‘আসল পরিবর্তনে’’র ডাক দিলেন নরেন্দ্র মোদী। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নরেন্দ্র মোদী জনগণের সামনে উদাত্ত আহ্বান জানালেন সোনার বাংলা গড়ার জন্য। তিনি দাবি করলেন যে, তার দলের কর্মীরা নাকি প্রত্যেক মুহূর্ত জনগণের জন্য বাঁচবে। তাদের মন জয় করবে কাজ দিয়ে, সেবা দিয়ে। জনগণের জন্য তারা নাকি নিজেদের সমর্পণ করবে! সারদা-নারদা কেলেঙ্কারির নায়ক শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়দের মঞ্চে বসিয়ে জনগণের জন্য মন-প্রাণ সমর্পণের স্বপ্ন ভালোই দেখালেন মোদী। আসলে বরাবরই নরেন্দ্র মোদী স্বপ্নের ফেরিওয়ালা তা সে স্বপ্ন যতই অলীক হোক না কেন। ব্রিগেডের মাঠে এসেও ঠিক একইভাবে তিনি স্বপ্ন ফেরি করার চেষ্টা করলেন যাতে সাধারণ মানুষ তার এই কথার তোড়ে ভেসে গিয়ে বিজেপি’কে সমর্থন করেন।
সোনার বাংলা গড়বে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলার সংস্কৃতি বাংলার প্রগতিশীলতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই একাজ নাকি তারা করবেন! বাংলার সংস্কৃতি তো কোনো দাঙ্গাবাজকে অনুমোদন দেয় না। বাংলার সংস্কৃতি মিলনের সংস্কৃতি। বাংলার সংস্কৃতি চৈতন্য-লালন-রবীন্দ্র-নজরুলের সংস্কৃতি যেখানে বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই। আর বিজেপি সেই দল যার রাজনীতির ভিত্তি ঘৃণা আর বিদ্বেষ। বাংলার যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে তার সম্পূর্ণ বিপরীতে রয়েছে বিজেপি’র ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদী সংস্কৃতি। তাই প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে একটিবারও রাজ্যের ২৭ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাম মুখে পর্যন্ত আনেননি।
প্রধানমন্ত্রী গত ১০ বছরে বাংলার পিছিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে নতুন করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বাংলার ছেলেমেয়েরা বাংলায় যাতে কাজ পায় তার ব্যবস্থা করবেন একথা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনও অসম্ভব দাবি করেছেন যে,বাংলা থেকে গত ৭৫ বছরে যা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তারা নাকি উনি ফেরত দেবেন। ৭৫বছরের দরকার নেই, বাজপেয়ী জমানায় বাংলার যে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেগুলি উনি আবার চালু করে দিতে পারবেন? উনি কী ফেরত দিতে পারবেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দুর্গাপুরের এমএএমসি কারখানা ও টাউনশিপ? নরেন্দ্র মোদী কী ফিরিয়ে দেবেন ন্যাশনাল ইন্সট্রুমেন্ট, ভারত অ্যালুমিনিয়ামের মতো এরাজ্যের ২২টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা যা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সম্পদ ছিল অথচ যেগুলিকে জলের দরে কর্পোরেটের হাতে বেচে দেওয়া হয়েছে?
পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনার কথা এলে এরকম অনেক অস্বস্তিকর সত্য উঠে আসবে যার মুখোমুখি হতে পারবেন না নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে গাড়ি তৈরির কারখানা গুজরাটের সানন্দে চলে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের জন্য সেই আন্দোলনের অন্যতম শরিক ছিল বিজেপি। সে সময় রাজনাথ সিং এসে ধরনা মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছেন। সেই অপরাধের কী সাজা হবে? গুজরাটের সানন্দ থেকে কী সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা ফিরে আসবে? এই আন্দোলনের জেরে গত দশবছর যেভাবে বাংলার শিল্পায়নের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হলো তার কী প্রতিকার হবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলার সর্বনাশ করার অপরাধের শাস্তি মাথা পেতে নিতে কী রাজি আছে বিজেপি?
আজ তৃণমূল কংগ্রেসের যে নেতাদেরকে দলে নিয়ে বিজেপি তাদের নিজেদের দলভারি করছে তাদের সকলের অপরাধের যদি বিচার করতে হয় তাহলে বিজেপি দলটাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। তাই এখন সাধু সাজার ভান করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আবার প্রতারণার শিকার করতে চাইছে তৃণমূলের বিটিম বিজেপি। তাই বাংলাজুড়ে মানুষ আওয়াজ তুলছেনঃ ‘‘ফুল বদলে কী হবে? মুখগুলো তো এক’’।
নরেন্দ্র মোদী ডবল ইঞ্জিনের গল্প শুনিয়েছেন অর্থাৎ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারে একদল থাকলে উন্নয়ন নাকি তরতরিয়ে হবে! তাহলে তো বিহার কিংবা মধ্যপ্রদেশের মানুষের কোনো সমস্যা থাকার কথা না। অথচ দেশের মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে বেশি উন্নত যে রাজ্যটি তার নাম কেরালা যেখানে বামপন্থীরা দীর্ঘকাল ধরে সরকার চালাচ্ছে। ডবল ইঞ্জিনের আসল নমুনা দেখছে ত্রিপুরা! আর্থিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দেশের অন্যতম সফল ও শ্রদ্ধেয় মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের নেতৃত্বে ত্রিপুরাকে ভারতের অন্যতম সুশাসিত রাজ্যে পরিণত করেছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু সেখানে আজ বিজেপি’র অপশাসনে জেরবার সাধারণ মানুষ। শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, আদিবাসী মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন, যুব সম্প্রদায় কর্মহীন এবং গণতন্ত্রকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৮সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটলুটের কথা আমরা জানি। কিন্তু সেই ভোটের নগ্ন ইতিহাসকে ছাপিয়ে গিয়েছে বিজেপি-শাসিত ত্রিপুরায় পঞ্চায়েত ভোট। শাসকদলের এতটাই গাজোয়ারি যে, বিজেপি ত্রিপুরাতে শাসকজোটের অংশীদার আইপিএফটি-কে পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়নি। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী বাদল চৌধুরীর উপরে শারীরিক আক্রমণ করা থেকে শুরু করে নানারকমের অন্যায় এরা নির্বিচারে করে চলেছে। অথচ এরাই একসময় আরএসএসে’র প্রচারকদের দিয়ে সোনার ত্রিপুরা গড়ার মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল।
ব্রিগেডের সভায় প্রধানমন্ত্রী ঝুপড়িবাসীকে আবাসনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন অথচ বলে দেননি এ কীভাবে সম্ভব। কারণ, যাদের নিজস্ব জমি নেই তাদের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বা ইন্দিরা আবাস যোজনার মতো কোনো সরকারি প্রকল্পে ঘর পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে রেল, পোর্টট্রাস্টের মতো বিভিন্ন সংস্থার কাছে যে বিপুল পরিমাণ জমি পড়ে রয়েছে সেই সমস্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করবার কথা বলতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী।কিন্তু সে’রকম প্রতিশ্রুতি তিনি দিতে পারবেন না, কেননা এই সমস্ত সরকারি সংস্থার জমি এখন শিল্পপতিদের জলের দরে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গরিব ঝুপড়িবাসীদের জমির অধিকার ছাড়াই পাকাবাড়িতে থাকার স্বপ্ন দেখানো ভাঁওতা ছাড়া আর কী?
প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবাংলায় চাকুরির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত নিয়োগের কথা বলে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। অথচ বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি করেছিল যা ব্যাপম দুর্নীতি নামে পরিচিত সেই দুর্নীতির তুলনীয় ঘটনা ভারতে খুব কম হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল থেকে শুরু করে সরকারি উচ্চপদস্থ বিভিন্ন কর্তারা এই কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত ছিলেন। ২০১২ সাল থেকে এই কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু হওয়ার পর কোনো-না-কোনোভাবে এই কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত এমন ৩২জন এখনো পর্যন্ত অস্বাভাবিকভাবে মারা গিয়েছেন। বিজেপি-শাসিত কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা ভারতের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা। দুর্নীতির প্রশ্নে এমন ট্র্যাক রেকর্ড যে দলের সেই দলের নেতার মুখে স্বচ্ছ নিয়োগের প্রতিশ্রুতি মানায় না।
তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সযত্নে লালিত জমিতে ফসল ফলাতে মরিয়া আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠন বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনে তারা যে সাফল্য পেয়েছিল তাকে পুঁজি করে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা তাদের লক্ষ্য। আর তার জন্য যেকোনোরকম অপকৌশল অবলম্বন করতে পিছপা হচ্ছেনা মোদীর বাহিনী। তবে ব্রিগেডের সমাবেশে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি যে মিথ্যের মায়াজাল রচনা করেছে তা জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতার ধাক্কায় চূর্ণ হয়ে যাবে। মিথ্যা, কুৎসা, প্রতারণাকে পরাস্ত করে বাংলা এগোবে প্রগতির পথে।