৫৮ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১২ মার্চ, ২০২১ / ২৭ ফাল্গুন, ১৪২৭
:: পরিবেশ আলোচনা
কেন্দ্র ও রাজ্য বাজেটে পরিবেশের সর্বনাশের ঘণ্টা
তপন মিশ্র
মুখে স্বচ্ছ আর স্বনির্ভর ভারতের ধ্বনি কিন্তু কাজে পরিবেশের সর্বনাশের ঘণ্টা বাজাল মোদী সরকার। এইবারের (২০২১- ২২) কেন্দ্রীয় বাজেটে এই ঘণ্টা ধ্বনি স্পষ্ট শোনা গেল। পরিবেশ রক্ষার জন্য বাজেটের মূল কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখে নিলে মোদী সরকারের পরিবেশ রক্ষার দ্বিচারিতা আমাদের কাছে স্বচ্ছ হয়ে যাবে। অন্যদিকে আমাদের রাজ্যের বাজেটে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি এতোটাই উপেক্ষিত যে তা আলোচনারও যোগ্য নয়। উপেক্ষার এই বিষয়গুলি জানার জন্য কারোর পরিবেশবিদ বা পরিবেশবিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। বাজেটে পরিবেশ রক্ষার জন্য ব্যয়বরাদ্দর দিকে নজর দিলেই সরকারের অসদিচ্ছা কতটা গভীর তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
(১) ২০২০-২১ সালে পরিবেশ ও বনমন্ত্রক (মিনিস্ট্রি অব এনভায়রনমেন্ট ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ)-এর মোট ব্যয়বরাদ্দ ছিল ৩১০০ কোটি টাকা। এবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে এই মন্ত্রকের ব্যয়বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ২৮৬৯.৯৩ কোটি টাকা। হয় সরকারের মনে হয়েছে যে, টাকার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে না হয় দেশে পরিবেশের সমস্যা কমেছে তাই ব্যয়বরাদ্দ কম করলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজে ভাটা পড়বে না। পরিবেশ রক্ষায় দুটি বিষয় এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির জন্য বিনিয়োগ এবং দ্বিতীয়ত, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা উদ্বাস্তু (ক্লাইমেট চেঞ্জ রিফিউজি) হবেন তাদের রক্ষা করা এবং বিকল্প ব্যবস্থার জন্য অর্থ বরাদ্দ জরুরি। একথা বলাই বাহুল্য যে, পরিবেশ ক্ষয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক মানুষ। যখন বিশ্বজুড়ে পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয় হচ্ছে এবং মূলত দুটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে তখন এই ব্যয় হ্রাস এক ঘৃণ্য প্রয়াস।
(২) গতবছরের (২০২০-২১) বাজেটের তুলনায় দেশের ৪২টি শহর যেখানে বায়ুদূষণ অতিরিক্ত মাত্রায় পৌঁছে গেছে সেখানে বায়ুদূষণ রোধের বাজেট কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। এই শহরগুলির মধ্যে কলকাতা, দিল্লি সহ সমস্ত বড়ো বড়ো এবং জনবহুল শহর রয়েছে। আপনার আমার মনে হতেই পারে যে, তাহলে নিশ্চয়ই এই সব শহরে বায়ুদূষণ নিম্নগামী। আসল কথা হলো একদমই ভিন্ন। এবছর শীতে দিল্লি এবং কলকাতার বায়ুদূষণ মাত্রা (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) এতটাই বেশি ছিল যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। দিল্লির ন্যাড়া পোড়ানোর সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কোনো সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিষয়টি অনেকগুলি রাজ্যের সমস্যা হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের যে উদ্যোগ নেওয়া উচিত তা তারা করছে না। এ কেবল দিল্লির সমস্যা নয়, কলকাতাসহ অন্য শহর ও গ্রামাঞ্চলে এই সমস্যা দিনে দিনে বাড়বে। ন্যাড়ার পুনর্ব্যবহারের জন্য সরকারি বিনিয়োগ জরুরি। এব্যাপারে সরকার নীরব। তা ছাড়াও রয়েছে পরিবহণ ব্যবস্থা, বিশাখাপত্তনমের এলজি কেমিক্যাল, তুতিকোরিনের স্টারলাইটের মতো কারখানাগুলি থেকে দূষক গ্যাস ছড়ানোর সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার সঠিক দিশার অভাব।
(৩) গত বছরের বাজেটের তুলনায় এবারে দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের (ক্লাইমেট চেঞ্জ-অ্যাকশন প্ল্যান) ব্যয়বরাদ্দ প্রায় ১০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এই বরাদ্দ মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রান্তিক মানুষের সাহায্য ও কিছু বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থার জন্য ব্যবহার করার কথা। সরকারের মনে হতেই পারে যে, পৃথিবীর সব জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনা অব্যাহত থাকলেও আমাদের দেশে এই পরিবর্তন স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের হিমবাহের ধসে পড়ার সমস্যা, ভৌম জলের অভাবের কারণে ঘনজনবসতি পূর্ণ এলাকায় জলের হাহাকার, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্লাবন ইত্যাদির মতো সমস্যাকে মোকাবিলা করার সদিচ্ছা এই বাজেটে সরকার দেখায়নি।
(৪) দেশে বাঘ সংরক্ষণের জন্য যে ব্যাঘ্র প্রকল্প (প্রোজেক্ট টাইগার) রয়েছে গত বছরের তুলনায় তাতে ব্যয়বরাদ্দ কমেছে ৫০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে ব্যয়বরাদ্দ ছিল ৩৫০ কোটি টাকা, ২০২০-২১-এ তা কমে দাঁড়াল ৩০০ কোটি টাকা, ২০২১-২২-এ কমে দাঁড়িয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। এই ক্রমাগত হ্রাসের কারণ বোধহয়, আমাদের দেশের বাঘ মোদী জমানায় আরও বেশি সুরক্ষিত মনে করছে। বাঘ সংরক্ষণের বিষয়টি কেবল ব্যাঘ্র প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ হলো আমাদের দেশে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাঘের উপযোগী আবাসস্থলের সংরক্ষণ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চলে উন্নয়ন ও খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য অরণ্য ধ্বংস হলেও সেই ক্ষতিপূরণ করতে সরকার আগ্রহী নয়। সমস্ত বিষয়টি এখন কর্পোরেটদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের দেশের ঘন বনাঞ্চলের পরিমাণ কমছে।
(৫) অন্যান্য বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ যেমন হাতি সংরক্ষণ (প্রোজেক্ট এলিফ্যান্ট), গন্ডার সংরক্ষণ (রাইনো কনজারভেশন) ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বরাদ্দ মোট ২ কোটি টাকা কমেছে (৩৫ কোটি টাকা থেকে ৩৩ কোটি টাকায় নেমেছে)। একারণে সম্ভবত রেললাইনে হাতি কাটা পড়ে বা মেদিনীপুর শহরে হাতি ঢুকে পড়ে। কেবল এই সমস্যা নয়, বন্যপ্রাণের সঙ্গে মানুষের সংঘাত (ম্যান-ওয়াইল্ডলাইফ কনফ্লিক্ট) এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, আদিবাসী এবং অন্যান্য অরণ্যের আশেপাশের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এর জন্য চাই বন্যপ্রাণের আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং তাদের করিডর (যাতায়াতের স্বাভাবিক পথ) তৈরি। ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস পেলে এই সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের রাজ্যের উত্তরের ডুয়ার্স-তরাই অঞ্চলে এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে।
(৬) দেশে সবুজায়ন প্রকল্প (ন্যাশনাল মিশন ফর গ্রিন ইন্ডিয়া)-র জন্য গতবছরের ৩১১ কোটি টাকার তুলনায় ব্যয়বরাদ্দ এ বছরে কমে দাঁড়িয়েছে ২৯০ কোটি টাকা অর্থাৎ ২১ কোটি টাকা কম। মনে হচ্ছে যে, আমাদের দেশে সবুজায়নের চাহিদা কমেছে। আসলে সরকার দেশে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ বনাঞ্চলের প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বারবার এই সবুজায়নের কথা শোনা যায়। আন্তর্জাতিক আলোচনায় (ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বাজেট বরাদ্দের সময় সরকার কর্পোরেট নির্দেশিত পথেই চলেছে।
(৭) জাতীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি (ন্যাশনাল অ্যাফরেস্টেশন প্রোগ্রাম)–তে ব্যয়বরাদ্দ গত বছরের ২৪৬ কোটি টাকার তুলনায় এবারে ২৩৫ কোটি টাকায় কমে এসেছে। মনে হয়, সরকার নীতিগতভাবে যেহেতু ঠিক করেছে যে, কর্পোরেটদের দিয়ে বনসৃজনের কাজ হবে তাই বরাদ্দ কম করলেই চলে। কর্পোরেটদের লক্ষ, তাদের উপযোগী গাছ লাগানো। কিন্তু আমদের দেশের প্রায় ৪০ কোটি বনবাসী যে জৈব বৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল, বিবিধ আঞ্চলিক প্রজাতির বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা রক্ষার বিষয় এই বাজেটে স্থান পায়নি।
এতো কু-কর্মের মধ্যে কিছু মনভোলানো বরাদ্দ বৃদ্ধিও আছে। যেমন জাতীয় উপকূলবর্তী অঞ্চল কর্মসূচি - ন্যাশনাল কোস্টাল মিশনের জন্য বরাদ্দ গত বছরের ১০৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০০ কোটি টাকা হয়েছে। তবে সৎ হোক বা অসৎ হোক এর একটা উদ্দেশ্য আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশখাতে সরকারি বরাদ্দ যে বাড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এখানে কিন্তু আরেকটি বিষয় লুকিয়ে আছে। ন্যাশনাল কোস্টাল মিশনের কাজ হলো - সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহের সংরক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে স্থিতিশীল উন্নয়নের পথ প্রশস্থ করা।
একটু ফ্ল্যাশ ব্যাকে যেতে হবে নাহলে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির সদিচ্ছা বুঝতে অসুবিধা হবে। আমাদের দেশে ১৯৮৬ সালের পরিবেশ আইনে দেশের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলকে কোস্টাল রেগুলেশন জোন (সিআরজেড নোটিফিকেশন)-এর মধ্যে আনা হয়। পরবর্তীকালে কোস্টাল রেগুলেটরি জোন অ্যাক্ট তৈরি করে এই অঞ্চলের সংরক্ষণের নানান ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এসবের গভীরে না গিয়েও বলা যায় যে, পরিবেশ রক্ষা এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রতল বৃদ্ধির আশঙ্কায় তীরবর্তী মানুষকে বাঁচাতে এই আইনের খুব দরকার ছিল। এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার এই আইনের কড়া প্রয়োগের চেষ্টা করে এবং এক্ষেত্রে দীঘা-শঙ্করপুর অঞ্চলের উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০১১-র পর সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ২০১৪ সালের পর মোদী সরকার ক্ষমতায় এলে এই আইন তাদের মনঃপূত হয়নি। এর কারণ হলো, আইন অনুযায়ী সমুদ্রতীরে সংরক্ষণের জন্য হাইটাইড লেভেল থেকে ন্যূনতম ৫০০ মিটারে যেকোনো পরিকাঠামো তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এমনটা বহাল থাকলে আদানির পোর্ট এলাকায় মজুতদারির জন্য বড়ো বড়ো গুদামঘর, পর্যটনের নামে সমুদ্র ঘেঁষে বিলাসবহুল ব্যবস্থা করা আটকে যায়। ফলে ২০১৪ সালে শৈলেশ নায়েক কমিটি তৈরি করে আইনের পরিবর্তনের সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১৯ সালে সিআরজেড নোটিফিকেশন ২০১৯ নতুন করে তৈরি হয় এবং এই সব বাধা-নিষেধ শিথিল করে দেয়। এখন যা করণীয় তা হলো, এই রাঘববোয়াল কর্পোরেটদের সমুদ্র উপকূলে বিনিয়োগের সুযোগ পৌঁছে দিতে পরিকাঠামো তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। তাই ঘুরপথে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি, নগরায়ণ ইত্যাদি জরুরি ছিল।
আমাদের রাজ্যে যে বাজেট মুখ্যমন্ত্রী ট্রেড মিলে হাঁটতে হাঁটতে তৈরি করলেন ও অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতার কারণে বিধানসভায় পেশ করলেন তার মোট পরিমাণ প্রায় ২,৯৯,৬৮৮ কোটি টাকা। সেখানে পরিবেশ দপ্তরের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৯৭.৪৬ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট পরিমাণের এতোটাই নগণ্য (মাত্র ০.০৩২৫%) যে বলতে লজ্জা হয়। আমাদের রাজ্যে পরিবেশ দপ্তরের বিভিন্ন বিভাগে যে পরিকাঠামো রয়েছে তা এমনিতেই অপ্রতুল। সময়ের সঙ্গে এই পরিকাঠামো কমেছে বই বাড়েনি। সেই পরিকাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখতে যতটুকু অর্থ দরকার রাজ্য বাজেটে সেই ব্যবস্থাই নেই।
যখন পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমাদের দেশে তখন সরকারের পরিবেশরক্ষায় উদ্যোগ কমছে। যেমন অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি ভাওঁতা আমাদের দেশের আম-ভোটারদের বিভ্রান্ত করে, এক্ষেত্রেও তারই ছায়া স্পষ্ট। এবারে এই ভাওঁতার যোগ্য জবাব দেওয়ার সময় এসেছে।